মতামত

অগ্নিকাণ্ডে মালামাল লোপাট বনাম ভাইরাল হওয়া পুলিশ সদস্য

রাজধানীর নিউমার্কেট সংলগ্ন নিউ সুপার মার্কেটে অগ্নিদুর্ঘটনায় উদ্ধার কার্যক্রমে কয়েকজন পুলিশ সদস্য
ছবি: সংগৃহীত

শনিবার ভোরে ফোনে ঘুম ভেঙে গেল। সাহ্‌রি খেয়ে কিছুক্ষণ আগেই ঘুমিয়েছিমাত্র। চোখ লেগে আসায় ফোন কেটে দিলাম। এক বন্ধুর ফোন। কিছুক্ষণ পর আবার ফোন। বুঝলাম না, কাহিনি কী? কোনো জরুরি কিছু নয়তো, নাকি কোনো বিপদ-আপদ! প্রচণ্ড ঘুম নিয়ে রিসিভ করতেই শুনলাম, ‘বন্ধু, আগুন লাইগা তো সব পুড়ে যাইতেছে। ওভারব্রিজের লগে মার্কেটটা জ্বইলা যাইতেছে। মানুষ এত খারাপ ক্যা, সব মালামাল লুটপাট করতেছে!’ এতটুকু বলেই কেটে দিল। কী বলল, কিছু বুঝলাম না। তাড়াতাড়ি ফেসবুক ও নিউজ সাইটে ঢুকলাম, কিছু পেলাম না। তাঁকে আবার ফোন দিলাম, তা–ও ধরল না। ফলে আবার ঘুমিয়ে পড়লাম।

সকালে অফিসে যাওয়ার জন্য ঘুম থেকে ওঠার পর জানলাম, নিউমার্কেটের সঙ্গে লাগোয়া বিপণিবিতান নিউ সুপার মার্কেটে মার্কেটে আগুন ধরেছে। আগুন তখনো নিয়ন্ত্রণে আসেনি। যে বন্ধু ফোন দিয়েছিল, সে-সহ আরও কয়েকজন ওই মার্কেটের গলিতেই কতবার আড্ডা দিয়েছি। প্রতি রোজার মাসেই দু–এক রাত দেরি করে ওদিক থেকে ফিরি। কয়েকজন দোকানদার ভাইবেরাদরের সঙ্গেও ভালো পরিচয় আছে। ফলে, তাঁদের জন্য দুশ্চিন্তা তৈরি হলো।

৪ এপ্রিল প্রায় দুই সপ্তাহ আগে একইভাবে আগুনে পুড়ে ছারখার হয়ে গেল ঢাকার আরেক ঐতিহ্যবাহী বঙ্গবাজার মার্কেট। অফিসে আসতে আসতে ভাবছিলাম, বারবার কেন একই ধরনের ঘটনা ঘটছে। একই সময়ে কেন এ আগুন লাগছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও সবার এ প্রশ্ন। ফায়ার সার্ভিসের কার্যক্রম, পানির উৎস বের করতে করতে আগুন নিয়ন্ত্রণে দেরি হওয়া, ঢাকার হারিয়ে যাওয়া পুকুর, অগ্নিনিরাপত্তা তৈরি না হওয়া, উৎসুক জনতার ভিড়—সবকিছুকেই ছাপিয়ে যায় রাজনৈতিক বক্তব্য। বিরোধী দল সরকারকে দায়ী করে, সরকার বিরোধী দলকে দায়ী করে, মন্ত্রী নাশকতার গন্ধ পান—সবই বুঝলাম, কিন্তু এসব দুর্ঘটনার কোনো তদন্ত প্রতিবেদন আর প্রকাশ পায় না। সেখানে যেসব সুপারিশ দেওয়া হয় বা যেসব সতর্কতা দেওয়া হয়, তার কিছুই মানা হয় না। ফলে নানা তর্কবিতর্ক, দোষারোপের রাজনীতি, সন্দেহ, নাশকতা, ষড়যন্ত্র ইত্যাদি কোনো কিছুই আগুনের লেলিহান শিখাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।

আগুন নিয়ন্ত্রণে এলেও শনিবার রাত পর্যন্ত ধোঁয়া বের হচ্ছিল মার্কেটটি থেকে। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা তখনও নিরলসভাবে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছিলেন

২.

আগুনই বোধ হয় সভ্যতার শুরু থেকে একমাত্র শক্তি, জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তির চূড়ান্ত উৎকর্ষ সত্ত্বেও যাকে পরাস্ত করা যায়নি। তবে নিয়ন্ত্রণ করা যে সম্ভব, সে ব্যাপারে কোনো দ্বিমত নেই। এর জন্য শুধু অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিত করাই একমাত্র উপায় নয়, আরও বেশি প্রয়োজন জবাবদিহির চর্চা ও সদিচ্ছা। এর উদাহরণ আমাদের সামনেই আছে। রানা প্লাজা ট্র্যাজেডিকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক মহলের চাপে নেওয়া উদ্যোগে পোশাক খাতে বড় কোনো অগ্নিকাণ্ড এখন হয় না বললেই চলে।

সারা দিন সংবাদমাধ্যম মারফত আমরা দেখলাম, ব্যবসায়ী, দোকানদার ও কর্মচারীদের আহাজারি ও বুকফাটা কান্না। আগুন নেভাতে ও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ, র‍্যাব, বিজিবি—সবার সম্মিলিত এক যুদ্ধ। দোকানদার ও কর্মচারীরা নিরাপদে মালামাল সরানোর জন্য পাগলপ্রায়। যে যেভাবে পারছেন, মালামাল উদ্ধার করছেন। সেখানেই ঘটে লুটপাটের ঘটনা। প্রথম আলোর খবরেই আমরা দেখলাম। যেসব দোকানে আগুনই লাগেনি, সেসব দোকানের মালামাল গায়েব হয়ে গেছে। নিউ সুপার মার্কেটের সামনে অন্তত ৩০টি দোকানের মালামাল খোয়া গেছে বলে জানিয়েছেন ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা। খবরটা ভোরে ফোন দেওয়া বন্ধুর শেষ কথাটাই মনে করিয়ে দিল।

এমন বড় কোনো দুর্ঘটনায় একদল মানুষ থাকে সুযোগসন্ধানী, উদ্ধারের নামে সবকিছু লুটে নেয়। সম্প্রতি শিবচরে ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনায় ১৯ জন নিহত হওয়ার ঘটনায়ও এমন একটি বিষয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছিল। আহত ও রক্তাক্ত হয়ে পড়ে থাকা যাত্রীর পকেট থেকে বিপুল অঙ্কের টাকা ও মুঠোফোন ছিনিয়ে নিয়ে উধাও হয়ে যান কথিত উদ্ধারকারী। নিউ সুপার মার্কেটেও তেমনটি ঘটল।

তবে এ ক্ষেত্রে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে মালামাল উদ্ধার করে প্রশংসা কুড়িয়ে নিয়েছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। মাথায় মালামালের বস্তা, মুখে বাঁশি, ঘামে ও ফায়ার সার্ভিসের ছোড়া পানিতে ভিজে একাকার ইউনিফর্মের বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্যের ছবি ও ভিডিও আমরা দেখি। কেউ কেউ তাঁদের মানবিক পুলিশ ও জনতার পুলিশ বলে আখ্যা দেয়।

পুলিশ নিয়ে আমরা প্রায় সময় সমালোচনা দেখি—বন্দুকযুদ্ধ, ছিনতাই, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, হেফাজতে মৃত্যুসহ আরও অনেক কিছুতেই তাদের নাম জড়িয়ে পড়তে দেখি। ভয়াবহ অগ্নিদুর্ঘটনায় সেই পুলিশের উদ্ধার কার্যক্রমে এমন ঝাঁপিয়ে পড়াটাই যেন অন্য রকম এক দৃশ্যের জন্ম দিল।

করোনার দমবন্ধ সময়ে ঝুঁকি নিয়ে পুলিশের নানা সেবামূলক কাজের জন্য ‘মানবিক পুলিশ’ শব্দবন্ধটি বেশ চোখে পড়েছিল, এবার উচ্চারিত হলো ‘জনতার পুলিশ’। পুলিশকে তো সাধারণ মানুষ এভাবেই দেখতে চায়, সেটি আবারও প্রমাণিত হলো। আর এই ভয়াবহ গরমের মধ্যে, আগুন ও প্রচণ্ড ধোঁয়ার মধ্যে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা উদ্ধারকার্যক্রম চালাতে গিয়ে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়ছিলেন। বরাবরের মতোই ‘ঢাল-তলোয়ারবিহীন’ এসব ফায়ার-ফাইটারের সাহসিকতার তারিফ করতেই হয়। এ ছাড়া আমরা কীই–বা করতে পারি।

বড় কোনো দুর্ঘটনায় একদল মানুষ থাকে সুযোগসন্ধানী, উদ্ধারের নামে সবকিছু লুটে নেয়। সম্প্রতি শিবচরে ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনায় ১৯ জন নিহত হওয়ার ঘটনায়ও এমন একটি বিষয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছিল। আহত ও রক্তাক্ত হয়ে পড়ে থাকা যাত্রীর পকেট থেকে বিপুল অঙ্কের টাকা ও মুঠোফোন ছিনিয়ে নিয়ে উধাও হয়ে যান কথিত উদ্ধারকারী। নিউ সুপার মার্কেটেও তেমনটি ঘটল।

৩.

রাতে অফিস শেষ করে গেলাম নিউমার্কেট এলাকায়। আজিমপুর কবরস্থানের রোড ধরে নিউমার্কেটের পেছনের গলি দিয়েই যেতে হলো ঘটনাস্থলে। ওই গলি দিয়ে এগোতেই পড়ে নিউ সুপার মার্কেট, যেটি আবার আলাদা আলাদা ভবনে কয়েকটি ব্লকে ভাগ করা। এ বা বি ব্লকে সম্ভবত আগুনটা লাগে। কাছাকাছি যতই এগোই, ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি ও তাদের তৎপরতা চোখে পড়ল। আগুন নিভে গেছে, তবে ভবনের নানা জায়গা থেকে ধোঁয়া উড়ছে। ফায়ার সার্ভিসের এক কর্মীর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বেশির মালামাল কাপড়চোপড়। সেগুলো পুড়ে যাওয়া আর পানিতে ভিজে যাওয়ার কারণে ধোঁয়া বের হচ্ছে এবং সেগুলো তাঁরা পরিষ্কার করছেন।

মার্কেটের এক পুরোনো ও বড় ব্যবসায়ীর সঙ্গে আলাপ হলো। দুই যুগ আগে থেকে এ ভবনে ব্যবসা তাঁর। মার্কেটে বয়োজ্যেষ্ঠ মালিক ও ব্যবসায়ীকে সবাই ‘মহাজন’ নামেই সম্বোধন করে। তো এই মহাজনের তিনটি দোকানই পুড়ে শেষ। পুড়ে যাওয়া ভবনের সামনেই দাঁড়িয়ে তাঁর একটি দোকান দেখিয়ে দিলেন। আফসোস করে বললেন, তিনতলায় এ দোকান একেবারে মুখে, একেবারে ফায়ার সার্ভিসের হাতের নাগালে, সেটাতে আগুনও জ্বলছিল বেশি, কিন্তু বাঁচানো যায়নি। ফায়ার সার্ভিসের কার্যক্রম নিয়ে আক্ষেপও প্রকাশ করলেন। সেই যে ভোরে বের হয়েছেন, এখনো ঘরে ফেরেননি। এত দিনের তিলে তিলে গড়ে তোলা স্বপ্ন পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া শোক তাঁকে কোনোভাবেই ফিরতে দিচ্ছে না ঘরে। সে সময় আরও দোকানদার ও কর্মচারীর দেখা পেলাম। ডি ব্লকের ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে তাঁদের সঙ্গে কথা বলছিলাম। তাঁদের সবাই ঘটনার সময় উদ্ধার কার্যক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। মালামাল লুট হওয়ার ঘটনা জানালেন তাঁরা।

মার্কেট ভবনটি সঙ্গেই লাগোয়া ঢাকা কলেজের বড় পুকুর। সেদিকের দেয়াল ভেঙে জেনারেটরের সাহায্যে পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। মহাজন বললেন, ‘সকালে এই দেয়াল ভাঙার কাজটা করতে অনেক দেরি হয়ে গেছে। দ্রুত সেটি করা গেলে ক্ষয়ক্ষতি আরও এড়ানো যেত।’

ঝুঁকিপূর্ণ পদচারী সেতুটি ভাঙার সময় আগুনের সূত্রপাত বলে ব্যবসায়ীদের অভিযোগ। যদিও সিটি করপোরেশন সেই অভিযোগ নাকচ করে দিয়েছে এবং এ নিয়ে গুজব না ছড়ানোর আহবান জানিয়েছে।

সবার কাছে জানতে চাইলাম, কী কারণে আগুন লাগতে পারে? তাঁরা সবাই মার্কেটের সঙ্গে লাগোয়া পদচারী–সেতুর ভাঙার বিষয়টি সামনে আনলেন। এ সেতু দিয়ে মার্কেটের তৃতীয় তলায় যাওয়া যায়। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সঙ্গে কয়েক দিন ধরে সেতুটি ভাঙা নিয়ে ব্যবসায়ীদের ঝামেলা চলছিল। তাঁদের কাছ থেকে জানতে পারলাম, আগের বছরে রমজানেও কিছুদিন ঝুঁকিপূর্ণ সেতুটি বন্ধ রাখা হয়েছিল। তখন ব্যবসায়ীরা সিটি করপোরেশনকে অনুরোধ করেছিলেন কয়েকটি দিন পর, মানে ঈদের পরেই সেটি ভাঙার জন্য, যেহেতু এই সময়টাতে বছরের সবচেয়ে বেশি ব্যবসার সুযোগ আর মার্কেটে ঢুকতে ক্রেতারা সেতুটি ব্যবহার করেন। সিটি করপোরেশন সেতুটি উন্মুক্ত করে দিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু এরপর সারা বছর সুযোগ থাকলেও সেটি ভাঙার জন্য জোরালো উদ্যোগ নেয়নি। দোকানদার ও কর্মচারীদের প্রশ্ন, সিটি করপোরেশন সারা বছর কোথায় ছিল?

পরদিন প্রথম আলোর প্রতিবেদনেও ব্যবসায়ীদের এমন অভিযোগ ও ক্ষোভ দেখতে পাই। তাঁদের ভাষ্য হচ্ছে, শনিবার ভোরে সিটি করপোরেশনের তত্ত্বাবধানে পদচারী-সেতু অপসারণের কাজ শুরু হয়। পদচারী-সেতুতে বিদ্যুতের যে সংযোগ রয়েছে, তা মার্কেটের সঙ্গে যুক্ত। এ বিদ্যুৎ লাইন বিচ্ছিন্ন না করে কাজ করার সময় আগুনের সূত্রপাত হয়। তাদের মতে, সিটি করপোরেশনের লোকজন বিনা নোটিশে সেতুটি ভাঙতে আসেন। মার্কেটের নিরাপত্তারক্ষীরা তাঁদের অনেকবার নিষেধ করেন। কাজ করার আগে অন্তত বিদ্যুৎ-সংযোগ বন্ধ করে নিতে বলেন। সিটি করপোরেশনের লোকজন কারও কথা না শুনে সিঁড়ি ভাঙা শুরু করেন। এর কয়েক মিনিটের মধ্যেই হঠাৎ মার্কেটের নিচতলা ও তিনতলায় বিকট শব্দ হয় এবং ধোঁয়া বের হতে থাকে।

যদিও সিটি করপোরেশন বলছে, পদচারী-সেতু ভাঙার সঙ্গে আগুন লাগার কোনো সম্পর্ক নেই। আগুন লাগার আধা ঘণ্টা আগে তাঁদের কাজ শেষ হয়ে যায়। আগুন লাগার স্থানও যথেষ্ট দূরে।

তবে পদচারী–সেতুর সামনে দাঁড়িয়ে দেখলাম, সিঁড়িটি পুরোপুরি ভাঙা হয়নি। এমনকি ভাঙা অংশও ভালোমতো সরানো হয়নি।

পানিতে একাকার গলির মধ্যে দাঁড়িয়ে শুনছিলাম, ব্যবসায়ী ও কর্মচারীরা তাঁদের বক্তব্যেই অনড়। তাঁদের বললাম, সিটি করপোরেশন কিন্তু কোনো ধরনের গুজব না ছড়াতে আহবান করেছে। আর তদন্ত, অনুসন্ধানের আগে তো এত কিছু বলা যায় না। তবে তদন্ত প্রতিবেদন আদৌ পাওয়া যাবে কি না, সেটি হেসেই উড়িয়ে দিলেন তাঁরা। সকালে মালামাল সরানো, দোকান বাঁচানোর চেষ্টার বিশাল এক যুদ্ধে ক্লান্ত মানুষগুলোর হাসিটা উপহাসই মনে হলো। আরেকটা সাহ্‌রির সময় হয়ে আসছে। তাঁদের কাছ থেকে বিদায় নিলাম। পেছনে পড়ে থাকল তাঁদের উপহাসের হাসি।

  • রাফসান গালিব প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী