সালমা খাতুন (ছদ্মনাম) ‘জেনারেল লাইনে’ পড়াশোনা করেছেন। চাকরি করেন নরসিংদীর মনোহরদী উপজেলার একটি মাদ্রাসায় প্রভাষক (বাংলা) পদে। তাঁর বাসা রাজধানীর তেজকুনিপাড়ায়। দুই ছেলে দ্বিতীয় ও পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। স্বামী চাকরি করেন একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে, অফিস বিমানবন্দর এলাকায়।
সালমা খাতুন সকাল ছয়টায় মনোহরদীর উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হন। ফেরেন রাত সাড়ে আটটা কি নয়টায়। সাম্প্রতিক সময়ে স্বামী তাঁকে চাকরি ছেড়ে দেওয়ার জন্য জোরাজুরি করছেন। বলছেন, ‘এত কষ্ট করার দরকার নেই। বাসায় থাকো।’ কিন্তু সালমা খাতুন চাকরি ছাড়বেন না। তবে তিনি আশায় ছিলেন বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের (এনটিআরসিএ) ‘চতুর্থ গণ বিজ্ঞপ্তি’ হলে আবেদন করে ঢাকার মধ্যে কিংবা কাছাকাছি কোনো কলেজে সুপারিশ পেয়ে আসতে পারবেন। তাঁর বয়স ও মেধা—সবই অনুকূলে ছিল। কিন্তু সরকারের আমলাদের কলমের খোঁচায় তাঁর আশার মৃত্যু ঘটতে চলেছে।
এ দেশে প্রতিটি চাকরির আবেদনের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট নিয়ম অনুসরণ করা হয়। হঠাৎ সেসব নিয়ম যেমন তৈরি হয়নি, তেমনি এগুলো রাতারাতি বন্ধ করে দেওয়াও যায় না। এটাই দস্তুর। কিন্তু শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মতো একটা বৃহৎ মন্ত্রণালয় বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগে এমন কাণ্ড ঘটিয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা এনটিআরসিএর নিয়োগ পরিপত্রের ৭ নম্বর ধারা সাময়িক স্থগিত করে ৬৮ হাজার ৩৯০ জন শিক্ষকের নিয়োগের বিজ্ঞাপন (যা চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তি নামে অভিহিত) ছাপানো হয়েছে।
এনটিআরসিএর নিয়োগ পরিপত্রের ৭ নম্বর ধারায় আছে, এর আগে বেসরকারি স্কুল ও কলেজে চাকরিরত ‘ইনডেক্সধারী শিক্ষকগণ’ আবেদন করতে পারবেন। সব প্রার্থীর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে যোগ্য হলে তিনিও নিয়োগের সুপারিশ পাবেন। কিন্তু চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তিতে ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের কোনোভাবেই এমনকি আগের চাকরিতে ইস্তফা দিয়েও আবেদনের সুযোগ রহিত করা হয়েছে। এমনকি কোনোভাবেই তাঁরা যেন আবেদন করতে না পারেন, সেভাবেই অনলাইনে ছক সাজানো হয়েছে। তারপরও যদি কেউ আবেদন করেন, তবে তাঁর আগের এমপিও বাতিল করার সুপারিশ এনটিআরসিএ করবে বলেও বিজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছে।
মূলত, ২০২২ সালের ১৪ নভেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি পরিপত্র জারি করে। সেখানে ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের সমপদে আবেদনের সুযোগ সাময়িক স্থগিত করা হয়। এটা অনুসরণ করেই গণবিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে। সরকার বেসরকারি স্কুল ও কলেজের শিক্ষকদের নিয়োগের জন্য এনটিআরসিএর মাধ্যমে নিবন্ধন পরীক্ষা গ্রহণ করে। এ পর্যন্ত ১৬টা নিবন্ধন পরীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে। তাতে যাঁরা নিবন্ধন পেয়ে বিভিন্ন সরকারি স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চাকরি পেয়ে এমপিওভুক্ত হয়েছেন, তাঁদের একটা ইনডেক্স (মাউশি, মাদ্রাসা ও কারিগর অধিদপ্তর থেকে) দেওয়া হয়, সেসব শিক্ষককে ইনডেক্সধারী শিক্ষক বলা হয়।
পরিচিত মহলে অনেকেই এ রকম শিক্ষক রয়েছেন। তাঁদের কাছ থেকেই বিষয়টি জেনেবুঝে এই মতামত কলাম লেখার জন্য কলম ধরেছি। ইতিমধ্যে আন্দোলনও শুরু হয়েছে। রাজধানীর ইস্কাটন রোডে এনটিআরসিএ কার্যালয়ের সামনে গণসমাবেশ করেছেন ইনডেক্সধারী শিক্ষকেরা।
এনটিআরসিএ প্রতিষ্ঠা লাভ করে ২০০৫ সালে। ২০১৩ সাল পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো স্থানীয় কমিটির মাধ্যমে তাদের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে এনটিআরসিএ থেকে নিবন্ধিত ব্যক্তিদের নিয়োগ দিতে পারত। তখন সংগত কারণেই বদলির বিষয়টি ওঠেনি। পরে নানা মহল থেকে স্থানীয় কমিটির বিরুদ্ধে অর্থ লেনদেনসহ নানা আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। ২০১৩ সালের পর দুর্নীতি বন্ধে সরকার পরিপত্র জারি করে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় গণবিজ্ঞপ্তি দিয়ে শিক্ষক নিয়োগ করে। আর এবার পরিপত্রের ৭ নম্বর ধারা সাময়িক স্থগিত করে দেশের শিক্ষা খাতে সবচেয়ে বড় নিয়োগ বিজ্ঞাপন দিয়েছে।
যেসব শিক্ষক এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন, তাঁদের বদলির কোনো সুযোগ নেই। নিবন্ধনের সময় যে পছন্দ দেওয়া হয়, সেখানেই চাকরি করতে যেতে হয়। খুব ভালো স্কোর না করলে নিজ জেলায় চাকরি করা যায় না। এ কারণে দেখা যায়, শিক্ষকদের অনেকে দূরদূরান্তে গিয়ে চাকরি করছেন। বাড়ি হয়তো কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারী, তিনি চাকরি করছেন চট্টগ্রামের সন্দ্বীপে। আবার বাড়ি হয়তো সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ, চাকরি করতে হয় হাওরের বিশ্বম্ভরপুরে।
কুড়িগ্রামের বাসিন্দা মোহাম্মদ আলী, যিনি চাকরি করছেন সন্দ্বীপে, তিনি সম্প্রতি প্রথম আলোতে পাঠকের কলামে লিখেছেন, ‘আমি যে এলাকায় চাকরি করি, সেখানকার আঞ্চলিক ভাষা বুঝতে আমার খানিকটা কষ্ট হয়। বিশেষ করে আমার স্থানীয় সহকর্মীরা যখন মিটিং কিংবা নিজেরা কথোপকথন করেন, তখন কিছুই বুঝতে পারি না। আমি কেবল ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকি।’
প্রথম কথা হলো, এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের বদলির সুযোগ থাকা উচিত। শিক্ষকেরা চাকরি করতে এক জেলা থেকে দূরের আরেক জেলায় যেতে পারেন, কারাবাস করতে নয়। দুঃখজনক হলো, এত বছরেও বদলির নীতিমালা তৈরি করতে পারেনি সরকার। এমন পরিস্থিতিতে কেবল গণবিজ্ঞপ্তির সময় শিক্ষকেরা আবেদন করে কর্মস্থল বদল করতে পারতেন বয়স ও মেধা থাকা সাপেক্ষে। কিন্তু চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তিতে স্পষ্টত সেই অধিকার ক্ষুণ্ন করা হয়েছে। সেই জায়গাগুলোয় একটু নজর দেওয়া যাক।
ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের বয়সের যোগ্যতাকে অস্বীকার করা হয়েছে। একজন নিবন্ধনধারী শিক্ষক পদের চাকরিপ্রার্থী ৩৫ বছর বয়স পর্যন্ত চাকরিতে আবেদন করতে পারেন। কিন্তু ইনডেক্সধারী একজন শিক্ষকের বয়স ৩৫–এর কম হলেও তিনি নতুন করে আবেদন করতে পারছেন না। মনে রাখা দরকার, প্রতিটি গণবিজ্ঞপ্তিতে কিন্তু সব প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ হয় না। আবার সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মান, সুযোগ-সুবিধা এক নয়। এমনকি জেনারেল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও মাদ্রাসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চাকরির কাঠামো, সুযোগ-সুবিধা, শহর ও গ্রামীণ স্কুলের সুযোগ-সুবিধায় বিস্তৃত পার্থক্য বিদ্যমান।
এমপিওভুক্ত শিক্ষকেরা নামকাওয়াস্তে এক হাজার টাকা বাড়িভাড়ার বাইরে আর তেমন সুযোগ-সুবিধা প্রতিষ্ঠান থেকে পান না। বিশেষ করে ঢাকার বাইরের স্কুলগুলোয় অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বেশ কম। তবে শহরের চিত্র কিছুটা ভিন্ন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় বিভিন্ন পরীক্ষার দায়িত্ব পালন থেকে আয় ও প্রতিষ্ঠানের আয় থেকেও তাদের কিছু অর্থপ্রাপ্তি ঘটে। সে ক্ষেত্রে প্রতিটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিই একেকটা সুযোগ। ভালো ও কাঙ্ক্ষিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়োগ লাভ করার সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হলেন ইনডেক্সধারী শিক্ষকেরা।
এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একজন সহকারী শিক্ষকের শুরুর বেতন সর্বসাকল্যে ১২ হাজার ৭৫০ টাকা। যদি নিজ বাড়িতে থেকে চাকরি করা যায়, তাহলে হয়তো এ টাকা দিয়ে দুটো ডালভাত জোটানো সম্ভব। যাঁরা নিজ জেলার বাইরে অনেক দূরে চাকরি করছেন, তাঁদের হিসাবটা মিলবে কি? শিক্ষকদের কাছে আমাদের চাওয়াও শেষ নেই, অনেকটা ‘তেলেও কম, ভাজাতেও মচমচা’র মতো।
আবার সব শিক্ষক যদি শহরের প্রতিষ্ঠানে আসতে চান, সেটাও সংগত নয়। কারণ, এতে গ্রামীণ প্রতিষ্ঠানগুলো পিছিয়ে পড়তে পারে। সেটা অবশ্য ভিন্ন তর্ক। সরকার হয়তো চেয়েছে নতুনদের সুযোগ দিতে। এটা অবশ্যই ভালো কথা। কিন্তু বয়স ও মেধা থাকা সাপেক্ষে ইনডেক্সধারীদের বঞ্চিত করা মানবাধিকারের পরিপন্থী।
ইনডেক্সধারীদের আবেদনের সুযোগ কেড়ে নেওয়ায় সবচেয়ে বেশি সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন সালমা খাতুনের মতো নারী শিক্ষকেরা। অনেকেই আশায় ছিলেন, নতুন বিজ্ঞাপনে আবেদন করে নিজের আবাসিকের কাছাকাছি চাকরি নেবেন। এখন যখন তাঁদের পরিবার জেনেছে যে বদলির সুযোগ নেই, অন্যদিকে নতুন করে আবেদনও করতে পারবে না, তাই সন্তান ও পরিবারকে সময় দিতে চাকরি ছেড়ে দিতে বলা হচ্ছে। নিত্য সইতে হচ্ছে গঞ্জনা। কয়েকজন নারী শিক্ষক টেলিফোন করে এমন কথাই বললেন।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী একজন নারী হয়েও বিষয়টা অনুধাবন করতে পারেননি। এনটিআরসিএর বড় বড় কর্মকর্তাও বিষয়টি দেখলেন ক্ষমতা ও দাম্ভিকতার জায়গা থেকে। যদি এমন কোনো নীতিমালা করার দাবি ওঠে যে প্রেষণে আসা এনটিআরসিএর কর্মকর্তাদের বদলির আর সুযোগ দেওয়া হবে না, সারা চাকরিজীবন এ দপ্তরেই কাটিয়ে অবসরে যেতে হবে, তখন তাদের কেমন লাগবে?
হঠাৎ বড় পরিবর্তন করার আগে অনেক ভাবা প্রয়োজন ছিল, সময় দেওয়া প্রয়োজন ছিল, আগে থেকে ঘোষণা দেওয়া জরুরি ছিল। ক্ষমতা থাকলেই সব করা সংগত নয়।
চতুর্থ গণবিজ্ঞপ্তিতে ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের আবেদনের সুযোগ বন্ধের সিদ্ধান্ত কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন মহামান্য আদালত। একই সঙ্গে ইনডেক্সধারীদের আবেদনের সুযোগ সাময়িক স্থগিতের সিদ্ধান্ত ছয় মাসের জন্য স্থগিত করা হয়েছে। কিন্তু এনটিআরসিএ আদেশ মানেনি। তারা আপিল করেছে। এ বিষয়ে এখনো শুনানি হয়নি। এখন পর্যন্ত ইনডেক্সধারীদের আবেদন করার জন্য এনটিআরসিএ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। আবেদন করতে গেলে অ্যাপে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না। এদিকে আবেদনের শেষ তারিখ কাছাকাছি চলে এসেছে, ২৯ জানুয়ারি।
এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একজন সহকারী শিক্ষকের শুরুর বেতন সর্বসাকল্যে ১২ হাজার ৭৫০ টাকা। যদি নিজ বাড়িতে থেকে চাকরি করা যায়, তাহলে হয়তো এ টাকা দিয়ে দুটো ডালভাত জোটানো সম্ভব। যাঁরা নিজ জেলার বাইরে অনেক দূরে চাকরি করছেন, তাঁদের হিসাবটা মিলবে কি? শিক্ষকদের কাছে আমাদের চাওয়াও শেষ নেই, অনেকটা ‘তেলেও কম, ভাজাতেও মচমচা’র মতো।
এ কলাম আর লম্বা করার প্রয়োজন নেই। যা বলতে চেয়েছি, আশা করি তা বোঝানো গেছে। শিগগিরই এ বিষয়ের যৌক্তিক সমাধান হবে—এমন প্রত্যাশা। কারও অধিকার যেন লঙ্ঘিত না হয়, সেদিকে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষ দৃষ্টি দেবে—এমন পদক্ষেপ দেখার অপেক্ষায় রইলাম।
কাজী আলিম-উজ-জামান প্রথম আলোর উপবার্তা সম্পাদক
alim.zaman@prothomalo.com