বই নিয়ে প্রাচীন রোমের দার্শনিক সিসেরো বলেছিলেন, ‘বই ছাড়া ঘর আত্মা ছাড়া শরীরের মতো’। জ্ঞানী ব্যক্তিদের বক্তব্য আমাদের প্রায়ই প্রভাবিত করে থাকে, প্রভাবিত করেছে খোদ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কেও। জীবনে বইয়ের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছে তারা। সরকারি কর্মকর্তাদের ‘জ্ঞানচর্চা ও পাঠাভ্যাস’ গড়ে তুলতে মাঠে নেমেছে। এ জন্য প্রায় সাড়ে ৯ কোটি টাকার বই কেনার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। এ পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে প্রশংসাযোগ্য। কিন্তু সমস্যা হলো, এ–সংক্রান্ত কোনো কমিটি, পাঠাগারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে বৈঠক, এমনকি এ বই কোথায় কীভাবে রাখা হবে, সেটা পর্যন্ত ঠিক না করে, লেখক হিসেবে সরকারি কর্মকর্তাদের প্রাধান্য দিয়ে বইয়ের একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছিল।
গত কয়েকদিন ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সরগরম ছিল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বই কেনা বিষয়ক তালিকাটি নিয়ে। প্রকল্পটি থাকলেও সমালোচনার মুখে বইয়ের তালিকাটি বাতিল করা হয়েছে। এখন এ বিষয়ে সভা, কমিটি হয়ে তারপর সিদ্ধান্ত হবে। বাতিল হলেও সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত লোকেদের এই আচরণ সমর্থনযোগ্য নয়। সচেতন মানুষ হিসেবে এ নিয়ে প্রশ্ন তোলাও আমাদের কর্তব্য। বিষয়টি নিয়ে খবর প্রচারিত না হলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় কি তাদের সিদ্ধান্ত পাল্টাত?
তালিকা বাতিল হওয়ার আগে ঠিক হয়েছিল এ প্রকল্পে মোট ১ হাজার ৪৭৭ বই কেনা হবে। এর মধ্যে শতাধিক বই অন্তত ২৫ জন উর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তার লেখা। অনেক বই আবার একই প্রসঙ্গের। হতে পারে যারা বই কিনে ‘শিক্ষা’ দিতে চেয়েছিলেন, তাদের কাছে ওই প্রসঙ্গগুলো ছিল অতীব গুরুত্বপূর্ণ। অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন দেশে কি আর কবি-লেখক নেই? তাদের উদ্দেশে কবি বলেছেন — ‘নিজেদের ঢোল নিজেদেরই পেটাতে হয়’। তবে, সরকারি কর্মকর্তারা কি ভালো লেখক হতে পারেন না? অবশ্যই পারেন। স্মরণ করিয়ে দিতে চাই আবু ইসহাক কিংবা শহীদুল জহিরের মতো বড় লেখকেরা ছিলের সরকারি কর্মকর্তা। কিন্তু তাঁদের বই প্রচারের জন্য এমন তালিকা তৈরি করার দরকার হয়নি।
শিক্ষাবিদ ও কথাসাহিত্যিক সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের কাছে বিষয়টি সম্পর্কে মতামত চাইলে তিনিও বলেছিন, পরিকল্পনার গোড়ায় গলদ। সব শুনে মনে হচ্ছে, বই পড়ানোর চেয়ে বিক্রির টাকা পকেটে যাওয়াই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
আসলে বই পড়া বা পড়ানো এখন আর সমাজ ও রাষ্ট্রে অতটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, গুরুত্বপূর্ণ হলো পকেটে টাকা যাওয়া। এ তরিকায় টু পাইস পকেটে গেলে মন্দার বাজারে বই পড়ার চেয়ে লাভ বেশিই হবে হয়তো। এ জন্য যাঁরা পকেটে টাকা ভরতে চাইছেন, তাঁরা এ বিষয়ের দিকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। যাঁরা পকেট ভরায় আগ্রহী, তাঁদের আগে থেকেই গাড়ি-ঘোড়ার অভাব নেই। ফলে নতুন করে পড়াশোনা করে বা করিয়েও কী লাভ হবে, সেটাও বোধগম্য নয়।
এমনিতে খিচুড়ি রান্না, আনারস চাষ, মসলা চাষ, পুকুর কাটা, নলকূপ বসানো, ক্যামেরা কিংবা লিফট ক্রয়ের জন্য আমাদের কর্মকর্তারা শনৈঃশনৈঃ দেশের বাইরে ভ্রমণ করে থাকেন। সেদিক থেকে চিন্তা করলে বই কেনার মতো অত্যন্ত জ্ঞানগর্ভ ও মহান একটা ব্যাপারে বিদেশে ‘উচ্চতর প্রশিক্ষণ’ থাকবে না, তা ভাবাই যায় না। সেটা হলে প্রকল্পটি হয়তো আরেকটু ঋদ্ধ হতো
প্রথম আলোয় ২৮ আগস্ট ছাপা হওয়া প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই যে সাড়ে ৯ কোটি টাকার বই কেনা হবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে, এর মধ্যে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. নবীরুল ইসলামের বই ২৯টি। এসব বইয়ের মধ্যে কবিতার বইয়ের সংখ্যাই বেশি। এই খবর প্রকাশের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনা–সমালোচনা শুরু হলে জনপ্রশাসন মন্ত্রনালয় থেকে বলা হয়, বইকেনার তালিকায় একজন লেখকের ২৯ টি বই থাকার বিষয়টি পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হবে। এরপর তালিকা সংশোধন কিংবা বাতিল করা হবে।
এরপর মন্ত্রণালয় তাদের কথা মতো তালিকাটি বাতিল করেছে। আমার ধারণা, তালিকার বাইরেও নবীরুল ইসলাম আরও অনেক বই রচনা করেছেন। কীর্তিমান এ লেখকের নাম এত দিন যাঁরা শোনেননি, তাঁরা হয়তো আমার মতোই কম্পিউটারের সামনে বসে আফসোস করছেন এখন। হা–হুতাশ করছেন বুক চাপড়ে। তবে আশার কথা হলো তালিকা বাতিল হলেও তাঁর অনেকগুলো বইয়ের ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আগ্রহী পাঠকেরা নিশ্চয়ই সেখান থেকে তথ্য নিয়ে বইগুলো সংগ্রহ করতে পারবেন।
কবিতা পড়ার লোক কম থাকলেও প্রতিবছর একুশে বইমেলায় যত বই বের হয়, তার অধিকাংশই কবিতার বই। কবিরা কবিতা পড়াতে চান, কিন্তু পাঠকেরা পড়তে চান না। ভেবেছিলাম মো. নবীরুল ইসলামের বইয়ের তালিকায় কবিতার বই বেশি থাকার ব্যাপারটা পাঠকদের আবার কবিতামুখী করবে। হয়তো এর মাধ্যমেই বাংলা কবিতার পালে সুদিনের হাওয়া লাগবে। কিন্তু নতুন সিদ্ধান্তে তাঁর বইগুলো বাদ পড়ে সে আশা ভঙ্গ হলো।
সভা না করে, কমিটি না করে এভাবে বইয়ের তালিকা করার ব্যাপারে নবীরুল বলেছেন, ‘কিছু হলেও বই সম্পর্কে আমার নিজের তো ধারণা আছে।’ সত্যিই, যিনি এতগুলো বই লিখেছেন এবং ‘রচনাগুণে’ যাঁর এতগুলো বই মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল, তাঁর তো বই সম্পর্কে ধারণা থাকবেই। তাঁর কাছে আবার কিসের কমিটি, কিসের মিটিং! এ ছাড়া তিনি বলেছেন, দেশের শিল্প-সাহিত্যজগতে যে সরকারি কর্মকর্তাদেরও অবদান আছে, তা সামনে আনা প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি। নিঃসন্দেহে এ উদ্যোগও মহান।
নবীরুল শুধু নিজে পরিচিত হয়েই ক্ষান্ত দিতে চাননি, অন্যান্য প্রতিভা অন্বেষণেও নিরলস কাজ করেছেন। কেননা, তালিকায় আরও কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তার নাম দেখা গিয়েছিল, যাঁরা লেখক হিসেবে পরিচিত নন কিংবা অল্প পরিচিত। এসব কর্মকর্তার পরিচিতি এখন সময়ের দাবি। সামনের দিনে ‘দেশের শিল্প-সাহিত্য জগতে সরকারি কর্মকর্তাদের অবদান’ শীর্ষক সেমিনারও হতে পারত সরকারি টাকায়। বিষয়টি স্কুল–কলেজ পর্যায়ের পাঠ্যসূচিতেও অন্তর্ভুক্ত হতে পারত।
জানা গেছে, কোটি কোটি টাকায় কেনা এইসব বই থাকবে শুধু সরকারি কার্যালয়ের পাঠাগারে। কার্যালয়ের কর্মকর্তা ও অফিস-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরাই শুধু পড়তে পারবেন। প্রশ্ন উঠেছে, অতি ব্যস্ত কর্মদিবসের মধ্যে তাঁরা কাজ করবেন না বই পড়বেন? নেহাত প্রশ্ন করার জন্যই করা, নইলে প্রশ্নকারীরা কি জানেন না, ‘যে অফিস করে, সে বইও পড়ে’! তবু আমি বলব, বই পড়ানোর সরকারি ও দরকারি এ কর্মসূচিতে একটা খামতি কিন্তু রয়েই গেল। ‘বই ব্যবস্থাপনা’ নিয়ে উচ্চতর ট্রেনিং নিতে কর্মকর্তাদের কোনো দল সপরিবার বিদেশ সফরে গিয়েছেন, এমন কোনো তথ্য আমাদের কাছে নেই।
এমনিতে খিচুড়ি রান্না, আনারস চাষ, মসলা চাষ, পুকুর কাটা, নলকূপ বসানো, ক্যামেরা কিংবা লিফট ক্রয়ের জন্য আমাদের কর্মকর্তারা শনৈঃশনৈঃ দেশের বাইরে ভ্রমণ করে থাকেন। সেদিক থেকে চিন্তা করলে বই কেনার মতো অত্যন্ত জ্ঞানগর্ভ ও মহান একটা ব্যাপারে বিদেশে ‘উচ্চতর প্রশিক্ষণ’ থাকবে না, তা ভাবাই যায় না। সেটা হলে প্রকল্পটি হয়তো আরেকটু ঋদ্ধ হতো। তবে আশার কথা হলো, পরবর্তী তিন বছর মন্ত্রণালয়টি একইভাবে সরকারি কর্মকর্তাদের ‘বই পড়াতে’ চায়। বিদেশ ভ্রমণের ব্যাপারটা ওই সময় তাঁরা প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত করে নেবেন বলে আশা রাখি। এটাও জানি, বিষয়টি মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য তখন তাঁরা মনে মনে আমাকে একটা ধন্যবাদ না জানিয়ে পারবেন না।
মেহেদি রাসেল কবি ও প্রাবন্ধিক
mehedirasel32@gmail.com