সুদানের সংকট যে গতিতে উন্মোচিত হচ্ছে, তা ইঙ্গিত দেয় যে, এই সংকট দীর্ঘদিন ধরে ভেতরে-ভেতরে গাঁজিয়ে উঠছিল। দেশটির আজকের পতিত দশা হলো ধারাবাহিক ব্যর্থতা, জটিলতা ও এমন আত্মসন্তুষ্টির ফল যা এত দিন ধরে জনমনে ঘুরপাক খাচ্ছিল এবং জনগণ ধরেই নিয়েছিল এই তুষ্টির অবস্থা চিরকাল অব্যাহত থাকবে।
কারা দেশ চালাবে—এই নিয়ে আধা সামরিক বাহিনী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (আরএসএফ) ও নিয়মিত সেনাবাহিনীর মধ্যে লড়াই বেঁধে যাওয়ার এবং দুই পক্ষের গুলির মাঝে পড়ার আগ-মুহূর্ত পর্যন্ত সুদানের জনগণের সেই আত্মতুষ্টির ঘুম ভাঙেনি। এখন রাজধানী খার্তুম ভয়ংকর রণক্ষেত্রে হয়ে উঠেছে। পুরো শহরে ট্যাংকের ছুটোছুটি, ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাত হানা, কুণ্ডলী পাকানো ধোঁয়ার উদগীরণের পরাবাস্তব দৃশ্য এখন বাস্তব হয়ে দেখা দিয়েছে।
প্রায় ৩০ বছর ধরে স্বৈরশাসন চালিয়ে সুদানকে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল করে দেওয়া এবং গণহত্যা চালিয়ে বহু মানুষ হত্যা করা প্রেসিডেন্ট ওমর আল বশিরকে একটি সামগ্রিক বিপ্লবের মাধ্যমে উৎখাতের পর দেশটিতে ক্ষমতার শূন্যতা তৈরি হয়েছিল। আরএসএফ নাকি সেনাবাহিনী দেশ চালাবে তাই নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে চার বছর ধরে ভেতরে-ভেতরে টানাপোড়েন চলছিল। অবশেষে তা সরাসরি সশস্ত্র লড়াইয়ে রূপ নিয়েছে।
গত দশ বছর ধরে আরব দেশগুলো গণতন্ত্রের আশায় তাদের একনায়কদের উৎখাত করার পর নিজেদের আশা পদপিষ্ট হওয়া দেখে আসছে। সুদানে সেই আরব দেশগুলোর ভয়ংকর মিছিলে শামিল হয়েছে। এসব দেশের মধ্যে আবদেল ফাতাহ আল সিসির শাসনাধীন মিসরের মতো দু-একটা সৌভাগ্যবান দেশ আছে যেগুলোতে পুরোনো শাসন পুনঃস্থাপিত হয়েছে (যদিও সেসব শাসকেরা আগের চেয়ে বেশি নৃশংস ও কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠেছে)। এসব দেশের মধ্যে লিবিয়া, ইয়েমেন ও সিরিয়ার দশা সবচেয়ে ভয়াবহ। এসব জায়গায় গৃহযুদ্ধ নেমে এসেছে এবং সেখানকার মানুষ শরণার্থী হয়ে ইউরোপে জীবনবাজি রেখে পাড়ি জমিয়েছে।
কিন্তু সুদানের দুর্দশা বহু আগে থেকেই পাওনা ছিল। গত সপ্তাহের ঘটনাবলির শুরুটা হয়েছিল ২০ বছর আগে; দেশটির পশ্চিমাঞ্চলীয় দারফুর এলাকায়। ওই সময় সরকারবিরোধী একটি বিদ্রোহকে বন্দুকবাজ ভাড়াটে ও খুনিদের দিয়ে সে সময় দমন করা হয়েছিল। বিদ্রোহ দমনকারী ওই সরকারপন্থী গ্রুপের সদস্যদের বলা হতো জানজাবিদ।
১৯৮৯ সালে ইসলামপন্থীদের সমর্থিত একটি অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা দখল করা সামরিক শাসক ওমর আল-বশির সে সময় দারফুরে তাঁর মূল্যবান প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনী পাঠাতে চাননি। এর বদলে তিনি দারফুরের আদিবাসী ও উপজাতীয়দের বিভেদ উসকে দিয়ে সেখানকার বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে জানজাবিদদের তার প্রক্সিসেনা হিসেবে লাগিয়ে দেন।
সুদানের ভাগ্য আটকে রাখার পেছনে আরও বড় বড় মহলের হাত আছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সুদানের ওপর এমন সব আনাড়ি নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যা খুব কম কার্যকর ভূমিকা রেখেছে; একই সঙ্গে সেসব নিষেধাজ্ঞা সুদানের সাধারণ মানুষের সরকারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর ক্ষমতাকে দুর্বল করে দিয়েছে।
ওই সময় দারফুরে লাখ লাখ মানুষ নিহত হয়। নারীদের পরিকল্পিতভাবে ধর্ষণ করা হয় এবং লাখ লাখ লোক বাস্তুচ্যুত হয়। দারফুরের গণহত্যা আন্তর্জাতিক মনোযোগ কেড়েছিল এবং ওমর আল বশিরের সরকারের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল ও তাঁকে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে তিনি দোষী সাব্যস্তও হয়েছিলেন। কিন্তু তাতে সুদানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন আসেনি। জানজাবিদদের প্রেসিডেন্ট বশির আধা সামরিক বাহিনীর মর্যাদা দিয়ে আরএসএফ নামে আলাদা একটি আনুষ্ঠানিক বাহিনী গড়তে দেন। এই বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন যুদ্ধবাজ নেতা মোহামেদ হামাদান দাগালো (তিনি ‘হেমেদতি’ নামে বেশি পরিচিত)।
বশিরকে হেমেদতি যত দিন সামরিক সুরক্ষা দিয়ে গেছেন তত দিন বশির হেমেদতিকে প্রভাবপ্রতিপত্তি ও সম্পদ কুক্ষিগত করতে কোনো বাধা দেননি। আর এই সম্পদ ও শক্তি আহরণের স্বাধীনতা হেমেদতির উচ্চাভিলাষকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল। এই উচ্চাভিলাষ থেকেই ২০১৯ সালে গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন তীব্র হলে হেমেদতি সেনাবাহিনীর সঙ্গে এক হয়ে বশিরকে গদি থেকে ফেলে দেন।
সুদানের ভাগ্য আটকে রাখার পেছনে আরও বড় বড় মহলের হাত আছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সুদানের ওপর এমন সব আনাড়ি নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যা খুব কম কার্যকর ভূমিকা রেখেছে; একই সঙ্গে সেসব নিষেধাজ্ঞা সুদানের সাধারণ মানুষের সরকারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর ক্ষমতাকে দুর্বল করে দিয়েছে।
২০১৯ সালের বিপ্লবের পর সুদানে যাতে গণতন্ত্র বিকশিত না হতে পারে সে জন্য উত্তর আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের অগণতান্ত্রিক সরকার ও রাজতন্ত্র সুদানের সেনাবাহিনী ও মিলিশিয়া উভয় শিবিরকেই মদদ দিয়ে আসছে। সর্বশেষ, সুদানের সোনা উত্তোলন ও নিরাপত্তা স্বার্থ ধরে রাখতে রাশিয়া সুদানের মিলিশিয়াদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে।
এই অবস্থায় সুদানে এখন যা ঘটছে তা অনিবার্যই ছিল। তবে এখনো সমাধানের হয়তো আশা আছে। কিন্তু তার আগে সুব সুদানি নাগরিককে বুঝতে হবে, নির্দিষ্ট কিছু লোকের শান্তি নিশ্চিত করার চিন্তা থেকে বেরিয়ে এসে সবার জন্য শান্তির ভাবতে হবে।
দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
নাসরিন মালিক দ্য গার্ডিয়ান-এর নিয়মিত কলাম লেখক