অনূঢ়া কুমারা দিশানায়েকে
অনূঢ়া কুমারা দিশানায়েকে

মতামত

চীন, ভারত, আইএমএফ— শ্রীলঙ্কার নতুন প্রেসিডেন্ট কোন পথে যাবেন

অনূঢ়া কুমারা দিশানায়েকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হওয়ার আগেই তাঁর চলনে–বলনে অন্য রকম আত্মবিশ্বাস চোখে পড়ার মতো ছিল। মানুষের সামনে তাঁর উপস্থিতি যেন বলে দিত, ‘২০২৪ আমার শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট হওয়ার বছর।’ তবে চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষণা না হওয়া পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কে জিতবে, তা নিয়ে সংশয় ছিল।

এই নির্বাচনে ৩৫ লাখ মানুষ ভোট দেননি। তাঁরা মোট ভোটারের ২১ দশমিক ৫ শতাংশ। এই ভোটাররা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেছেন। কোনো সিদ্ধান্ত নেননি। সংবাদমাধ্যম বলছে, সামনে সাধারণ নির্বাচনে তাঁরা কোন দিকে যাবেন, তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন বিশ্লেষণ দেখে মনে হয়, অনূঢ়া সম্ভবত ভবিষ্যতে চীনা এজেন্ডা অনুযায়ী চলবেন। এখানে ভারতের উদ্বেগের বিষয় আছে। অনূঢ়ার কথাবার্তায় যে ইঙ্গিত পাওয়া গেছে, তাতে মনে হয় যে শ্রীলঙ্কার ভবিষ্যৎ আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বৃহৎ পরিসরে ভারত প্রাধান্য পাবে না।

নির্বাচনের ঠিক আগে সংবাদমাধ্যমে একটি টক শোতে অনূঢ়া বলেছেন যে তিনি নির্বাচিত হলে আদানি গ্রিন এনার্জি লিমিটেডের কাছে হস্তান্তর করা বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিল করে দেবেন। প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, অতীতের দুর্নীতিবাজ আইনপ্রণেতাদের আইনের আওতায় আনার। দেশবাসী অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে তিনি নির্বাচনের আগে দেওয়া সব প্রতিশ্রুতি কীভাবে কতটা বাস্তবায়ন করেন, তা দেখার জন্য।

অনূঢ়া ন্যাশনাল পিপলস পাওয়ার নামে জোটের নেতৃত্ব দেন। তাঁরা চীন থেকে অনুপ্রেরণা পাবেন। ভারত থেকে নয়। কারণ, চীন ও শ্রীলঙ্কার বর্তমান নেতৃত্ব উভয়েই সমাজতন্ত্রের কিছু মূল্যবোধ ধারণ করেন। জনগণের জন্য কল্যাণমূলক কর্মসূচির প্রতি তাঁদের ঝোঁক রয়েছে।

চীনে রয়েছে একটি উন্নয়নশীল মিশ্র সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতি। আছে বাজারব্যবস্থার পাশাপাশি সরকারি হস্তক্ষেপ ও নীতিমালা দিয়ে নিয়ন্ত্রণ। এসব ক্ষেত্রে চীন শ্রীলঙ্কার ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে, সন্দেহ নেই। তবে চীনের মতো সস্তা শ্রমনীতি গ্রহণ নিয়ে চিন্তার ব্যাপার আছে। শ্রীলঙ্কা কি তার শ্রমশক্তিকে কম বেতন দিতে পারবে? অনূঢ়ার সমর্থকদের একটি বড় অংশ দৈনিক বেতনের কর্মী। এ বিষয় তাঁকে ভাবতেই হবে।

অনূঢ়া দারিদ্র্যবিরোধী কার্যক্রম করার পরিকল্পনা পেশ করেছেন জনগণের কাছে। রাজনীতিবিদ, আইনপ্রণেতা হিসেবে তাঁর পথচলার ইতিহাস কম দীর্ঘ নয়। সাধারণ পরিবারে জন্মে সাধারণভাবেই বড় হয়েছেন। সাধারণে যেসব জায়গায় যায়, তেমন সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই তিনি পড়ালেখা করেছেন।

শ্রীলঙ্কান হিসেবে আমরা শুধু আশা করতে পারি। অনূঢ়া যেতে পারেন আইএমএফের কাছে। ঋণ পরিশোধের জন্য আরও সময়ও চাইতে পারেন। আইএমএফ হয়তো বলবে যে ‘না, নতুন করে আলোচনার সুযোগ নেই। আপনার পূর্বসূরির সঙ্গে আলোচনা করে সব শর্ত ঠিক করা হয়েছে।’ নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি কি কোনো ছাড় আশা করতে পারেন? সেই সুযোগ মনে হচ্ছে খুব বেশি নেই।

তিনি জনতা বিমুক্তি পেরামুনা (জেভিপি) নামের দলের নেতা। তাঁর নেতৃত্বাধীন জোটটি ২১টি বিভিন্ন গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বকারী ব্যক্তিদের নিয়ে গঠিত। সে জোট ২০১৯ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আগে জেভিপি মনে করত যে নির্বাচনে তারা একাই ভালো করতে পারবে। কিন্তু নির্বাচনে খারাপ ফল করার পর জেভিপি সমমনা ব্যক্তি, গোষ্ঠী এবং দলের সঙ্গে জোট গঠনের বিষয়ে গুরুত্ব নিয়ে ভাবা শুরু করে।

অনূঢ়ার এখন বিজয়ী হওয়ার আনন্দে সময় নষ্ট করার সুযোগ নেই। আগের যে দলীয় রাজনীতির মেরুকরণ ছিল, জনগণ তাঁকে প্রত্যাখ্যান করেছে। শ্রীলঙ্কার রাজনীতির চেহারা অনেক বদলে গেছে। স্পষ্ট আর বাস্তব ইশতেহার চায়। চায় এমন ব্যক্তিকে, যঁারা তা বাস্তবায়ন করতে পারবেন। জোটে তেমন লোক আছেন। এখন তাঁদের সংসদে নিয়ে আসা হচ্ছে চ্যালেঞ্জ। 

অনূঢ়া এক কঠিন সময়ে রাজনীতি করছেন। মানুষ নতুন প্রেসিডেন্টের প্রতিটি পদক্ষেপ, তাঁর দেওয়া প্রতিটি নিয়োগ গভীরভাবে লক্ষ করছে। এ থেকেই রাজনীতিতে তাঁর চিন্তাভাবনা ও পরিপক্বতাকে যাচাই করা হবে। 

শ্রীলঙ্কান হিসেবে আমরা শুধু আশা করতে পারি। অনূঢ়া যেতে পারেন আইএমএফের কাছে। ঋণ পরিশোধের জন্য আরও সময়ও চাইতে পারেন। আইএমএফ হয়তো বলবে যে ‘না, নতুন করে আলোচনার সুযোগ নেই। আপনার পূর্বসূরির সঙ্গে আলোচনা করে সব শর্ত ঠিক করা হয়েছে।’ নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি কি কোনো ছাড় আশা করতে পারেন? সেই সুযোগ মনে হচ্ছে খুব বেশি নেই।

শ্রীলঙ্কাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া আর প্রশাসনে সমাজতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্য যুক্ত করে আইএমএফকে খুশি করা, দুটো একসঙ্গে কতটা সম্ভব? এ বিষয়ে নতুন প্রেসিডেন্ট যত দ্রুত সিদ্ধান্ত নেবেন, সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পথ খুঁজে বের করতে পারবেন, ততই মঙ্গল।

  •  রবি নাগাহাওয়াত্তে শ্রীলঙ্কার সাংবাদিক

  • ডেইলি মিরর থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ জাভেদ হুসেন