শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু হওয়ার পর দেশের বাইরে থেকে অনেকেই টেলিফোন করে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জানতে চেয়েছেন, কী হচ্ছে, দেশ কোন দিকে যাচ্ছে? তাঁদের কাছে প্রতিদিনের ঘটনার বর্ণনা দেওয়ার প্রয়োজন নেই। সব ঘটনাই তাঁরা জানেন। এমনকি যে কয় দিন ফেসবুক, ইন্টারনেট বন্ধ ছিল, তাঁরা দেশের খবর পেতেন। বরং আমরা একধরনের অন্ধকারে ছিলাম। সরকার আমাদের অন্ধকারে রেখেছিল।
যে প্রজন্মকে আমরা দেশ ও সমাজবিচ্ছিন্ন ভেবেছিলাম, সেই প্রজন্মই তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সবচেয়ে বেশি জীবন দিল। অনেক বছর পর দেখলাম শিক্ষার্থীদের প্রতি সংহতি জানিয়ে শিক্ষক, আইনজীবী, সাংবাদিক, সংস্কৃতিকর্মীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ দলে দলে রাস্তায় নেমে এসেছেন। পুলিশের গাড়ি থেকে শিক্ষার্থীদের ছাড়িয়ে নিতে গিয়ে শিক্ষক আহত হয়েছেন। আইনজীবীরা বলেছেন, ‘ওদের গ্রেপ্তার করার আগে আমাদের গ্রেপ্তার করতে হবে।’
যে নাগরিকেরা নানা বৃত্তে বিভক্ত ছিলেন, তঁারাও একত্র হয়ে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। ঢাকার বাইরে থেকে এক বন্ধু খুদে বার্তায় লিখেছেন, ‘আমরা ওদের নিয়ে যা যা ভাবতাম, পুরোটাই ভুল প্রমাণ করে দিয়েছে। পরেরটাও ওরা ঠিক করবে।’
শিক্ষার্থীরা ইতিমধ্যে সেটা প্রমাণ করেছেন। তাঁদের প্রতিটি কর্মসূচিতে নতুনত্ব আছে। আছে বৃহত্তর জনগণকে সম্পৃক্ত করার সম্মোহনী শক্তি ও সৃজনশীলতা।
আন্দোলন বলতে আমরা এত দিন মিছিল, সমাবেশ, অবরোধ, হরতালকেই বুঝতাম। কিংবা রাজনৈতিক মঞ্চে কে কত গরম বক্তৃতা দিতে পারেন। শিক্ষার্থীরা হরতাল অবরোধ না ডেকে বললেন, ‘বাংলা ব্লকেড’। এরপর তঁারা বললেন, ‘মার্চ ফর জাস্টিস’। শিক্ষার্থীসহ হাজার হাজার নিরীহ মানুষকে যে অন্যায়ভাবে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তার প্রতিকার চাওয়া হয়েছে, এই কর্মসূচির মাধ্যমে। তাদের আরেকটি কর্মসূচি ছিল, রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোজ বা বীরদের স্মরণ।
কয়েক বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রে এক শ্বেতাঙ্গ পুলিশের হাতে নির্মমভাবে নির্যাতিত হয়ে মারা যান কৃষ্ণাঙ্গ তরুণ জর্জ ফ্লয়েড। তাঁর মৃত্যুর পর সেখানে প্রচণ্ড আন্দোলন গড়ে উঠেছিল ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’। বাংলাদেশে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দেখেও মনে হয়, ‘স্টুডেন্টস ম্যাটার্স’।
এই শিক্ষার্থীরা আওয়ামী লীগ, বিএনপি, বাম কিংবা অন্য কোনো দলের ব্র্যাকেটবন্দী নন। তাঁরা আন্দোলন করেছেন ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য। আন্দোলন করেছেন দীর্ঘদিন ধরে তাঁদের ওপর চলে আসা অন্যায়ের বিরুদ্ধে। শিক্ষার্থীদের একটি ন্যায্য ও শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে যখন তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা হলো, বিশেষ তকমা দেওয়া হলো, তখনই ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে বিদ্রোহ দেখা দিল।
শিক্ষার্থীরা সুস্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছিলেন এই আন্দোলনে তাঁরা কেন রাজনৈতিক গোষ্ঠীর সম্পৃক্ততা চান না। তাঁদের আন্দোলন যেন তাঁদেরই করতে দেওয়া হয়। কিন্তু সরকারের মন্ত্রীরা তাঁদের মনের ভাষাটি বুঝতে না পেরে ছাত্রলীগকে মাঠে নামালেন।
সরকার বলপ্রয়োগ করে আন্দোলন দমন করতে গিয়ে একের পর এক ভুল করল। সবচেয়ে বড় ভুল হলো আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী ছয় সমন্বয়ককে নিরাপত্তা দেওয়ার নামে ডিবি অফিসে নিয়ে যাওয়া। তাঁরা হলেন নাহিদ ইসলাম, সারজিস আলম, হাসনাত আবদুল্লাহ, আসিফ মাহমুদ, আবু বাকের মজুমদার ও নুসরাত তাবাসসুম।
আমরা জানি, দণ্ডিত আসামিও অসুস্থ হলে তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা দেওয়া হয়। আর ওই ছয় সমন্বয়কের তিনজনকে হাসপাতাল থেকে ডিবি অফিসে নিয়ে আসা হলো। অন্য তিনজনকে বাসা থেকে। এর মধ্যে একজন নারী শিক্ষার্থীও আছেন। মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের নেতাদেরও সন্তান আছে। তাঁদের সন্তানদের বেলায় যদি এমনটি ঘটত, তা কি তাঁরা মেনে নিতে পারতেন?
পত্রিকান্তরে আমরা জানতে পারছি, ডিবি হেফাজতে থাকা ওই ছয় সমন্বয়ক টানা ৩২ ঘণ্টা অনশনে ছিলেন। এ বিষয়ে আইনজীবী মানজুর আল মতিন তাঁর ফেসবুক পোস্টে বলেন, ‘ডিবি হেফাজতে বন্দি ৬ সমন্বয়ক গত ৩২ ঘণ্টা ধরে অনশনে। আমি ভাবতাম তোরা নজরুল পড়িস নি! কত ভুল ভাবতাম রে! তোরাই তো একেকটা নজরুল! ৩৯ দিনের অনশনে নজরুল একাই ব্রিটিশ রাজের ভিত্তি নাড়িয়ে দিয়েছিলেন! তোরা তো অগুনতি নজরুল! কে ঠেকায় তোদের!’
মানজুর আল মতিন ও অপর এক আইনজীবী ছয় সমন্বয়ককে অন্যায়ভাবে আটক রাখা ও আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি ছোড়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে হাইকোর্টে রিট করেছিলেন। প্রথম দুদিন শুনানির পর এক বিচারক অসুস্থ হয়ে পড়লে তৃতীয় দিন আর শুনানি হয়নি। এর মধ্যে বিক্ষুব্ধ নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে ২৪ ঘণ্টার সময় বেঁধে দেওয়ার পরদিন ছয় সমন্বয়ককে ছেড়ে দেওয়া হয়।
কিন্তু এই ছয় দিনে ডিবি অফিসে তাঁদের সঙ্গে কী হয়েছে, আমরা জানি না। আমরা দেখলাম, তাঁরা একটি বিবৃতি দিয়ে আন্দোলনের কর্মসূচি প্রত্যাহার করলেন। তবে ছাড়া পাওয়ার পর গণমাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিতে তাঁরা বলেন, ডিবি হেফাজতে থাকাকালে গত ২৮ জুলাই রাতে এক ভিডিও বার্তায় আন্দোলন প্রত্যাহারের যে ঘোষণা তাঁরা দিয়েছিলেন, তা স্বেচ্ছায় দেননি। এতে বলা হয়, মূলত আন্দোলন ও নেতৃত্বকে ছত্রভঙ্গ করতেই ১৯ জুলাই থেকে সমন্বয়কদের গুম, গ্রেপ্তার, নির্যাতন ও হয়রানি করা হচ্ছে।...স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও ডিবির প্রধান নিরাপত্তার কথা বললেও তাঁদের আন্দোলন থেকে বিচ্ছিন্ন করে রাখার জন্যই হেফাজতে রাখা হয়েছিল।
ছয় সমন্বয়ক আরও অভিযোগ করেছেন, ডিবি কার্যালয়ে তাঁদের জোর করে খাবার টেবিলে বসিয়ে ভিডিও করা হয়। তাঁদের ছেড়ে দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে পরিবারকে ডেকে ১৩ ঘণ্টা বসিয়ে রাখা হয়। গণমাধ্যমে মিথ্যা বিবৃতি দেওয়ানো হয়। তাঁদের শিক্ষকেরা দেখা করতে এলেও দেখা করতে দেওয়া হয়নি। শিক্ষার্থীদের গ্রেপ্তার ও নির্যাতনের প্রতিবাদে ৩০ জুলাই রাত থেকে সমন্বয়কেরা ডিবি কার্যালয়ে আটক অবস্থায় অনশন শুরু করেন। অবশেষে সরকার তঁাদের ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।
আন্দোলনকালী ছয় সমন্বয়কের শেষ কথা, ছাত্র-নাগরিক হত্যার বিচার ও আটক নিরপরাধ ব্যক্তিদের মুক্তির দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে। এভাবে শিক্ষার্থীদের আটক রেখে, ভয়ভীতি দেখিয়ে যে কোনো আন্দোলন দমন করা যায় না, সেটাই আবার প্রমাণিত হলো। গতকাল শুক্রবার দেশজুড়ে সেটিই আমরা দেখলাম। ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, সিলেট, রাজশাহীসহ অনেক জায়গায় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নানা মত–পথের মানুষ রাস্তায় নেমে এসেছেন।
শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন আজ রাষ্ট্র সংস্কারের দিকেই যাচ্ছে।
● সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
sohrabhassan55@gmail.com