অর্থনীতির মূল্যস্ফীতি বনাম মন্ত্রীদের শব্দস্ফীতি

হার্ভার্ডের অর্থনীতির সহকারী অধ্যাপক সামান্থা রবিনস ২০১৬ সালে গবেষণা করে বলেছিলেন, স্বর্গের চেয়ে নরকের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) পরিমাণ বেশি। কারণ, নরকের প্রতিষ্ঠানগুলো অর্থনীতির দ্রুত প্রবৃদ্ধির জন্য বেশি সহায়ক।

এরও আগে ২০০৩ সালে হার্ভার্ডের আরও দুই অর্থনীতিবিদ আরেক গবেষণায় বলেছিলেন, স্বর্গের প্রত্যাশার চেয়ে নরকের ভয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য ভালো। কেননা নরক থেকে বের হওয়ার প্রত্যাশায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড গতিশীল হয়।

বিশ্ব অর্থনীতি আক্ষরিক অর্থেই এখন স্বর্গের সিঁড়িতে নেই, বরং নরকের রাজপথে আছে। বিশ্বের অন্তত সব বিশেষজ্ঞ, অর্থনীতিবিদ, নীতিনির্ধারক—সবাই তাই মনে করছেন। গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যানসাস সিটিতে বিশ্বের প্রধান সব কেন্দ্রীয় ব্যাংকার বর্তমান পরিস্থিতি মূল্যায়নে তিন দিনের একটি সম্মেলন করেছে।

জ্যাকসন হোল ইকোনমিক সিম্পোজিয়ামখ্যাত এ সম্মেলনে সবাই একমত হয়েছেন যে বিশ্ব অর্থনীতি গত কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের মধ্যে আছে।

সম্মেলনে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) উপব্যবস্থাপনা পরিচালক গীতা গোপীনাথ পরিষ্কারভাবে বলেছেন, আগামী পাঁচ বছরে সঠিক মুদ্রানীতি প্রণয়ন করাই হবে গত দুই দশকের তুলনায় সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। কেননা বিশ্ব ঢুকে পড়েছে উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময়ে, যা সহজে কমবে না।

সবাই এক বাক্যে মানছেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতিই এখন বিশ্বের সবচেয়ে বড় সমস্যা। তাই সব নীতি আলোচনাই এখন মূল্যস্ফীতিকে ঘিরে। গীতা গোপীনাথ আরও মনে করেন, মূল্যস্ফীতির চাপ আগামী আরও দুই বছর পর্যন্ত থাকতে পারে।

বিশ্বজুড়ে অর্থনীতিবিদেরা এখন বিতর্ক করছেন মূল্যস্ফীতি বেশি খারাপ না মন্দা বেশি খারাপ—এ নিয়ে। মূল্যস্ফীতি কমাতে গিয়ে অর্থনৈতিক মন্দা ডেকে আনা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই পথে বদ্ধস্ফীতি বা স্ট্যাগফ্লেশনও চলে আসতে পারে। অর্থাৎ উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও নিম্ন প্রবৃদ্ধি। এ রকম এক অবস্থায় বাংলাদেশের মানুষ মূল্যস্ফীতির চাপ নিয়ে তো বিপাকে আছেই, ভয়ানক শব্দস্ফীতি নিয়েও আছে মহাযন্ত্রণায়। এ থেকে রেহাই দরকার। এ পরিস্থিতিতে শঙ্খ ঘোষের সেই কবিতার কথা মনে করাই যথার্থ, ‘এত বেশি কথা বলো কেন?/ চুপ করো/ শব্দহীন হও’।

মহাসংকটে বিশ্ব অর্থনীতি

অর্থনীতি নিয়ে সঠিক পূর্বাভাস দেওয়ার ক্ষেত্রে তুর্কি বংশোদ্ভূত মার্কিন অর্থনীতিবিদ নুরিয়েল রুবিনির বিশেষ খ্যাতি আছে। তিনি কয়েক মাস আগেই সতর্ক করে দিয়ে বলেছিলেন, যারা মনে করে অর্থনীতি মৃদু মন্দার দিকে যাচ্ছে, তারা বড় বিভ্রান্তির মধ্যে আছে। বরং দুনিয়া বড় ধরনের সংকটের মধ্যে যাচ্ছে, যা সহজে ঠিক হবে না। রুবিনির কথাকেই সত্য বলে মানছেন প্রায় সবাই। ১৯৬৫ থেকে ১৯৮২ পর্যন্ত সময়কে বলা হয় ‘গ্রেট ইনফ্লেশন’।

কেননা সে সময় সারা বিশ্ব ছিল মূল্যস্ফীতির চাপের মধ্যে। একটা মন্দার পর সেই উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময়টা কেটে যায়। আর তা কমবেশি বজায় থাকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত। মূল্যস্ফীতি সংহত থাকার সময়টিকে বলা হয় ‘গ্রেট মডারেশন’। ২০২০ সালে শুরুতে করোনা, এরপর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ আবার উচ্চ মূল্যস্ফীতিকে ডেকে এনেছে। দেখা দিয়েছে চরম অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতা। আর অস্থির এই সময়কে এখন বলা হচ্ছে, ‘গ্রেট ভোলাটিলিটি’।

বর্তমান সংকট কোনো নির্দিষ্ট একটি দেশের সংকট না, বরং বলা যায় সংকটেরও বিশ্বায়ন ঘটেছে। এ অবস্থায় কেউ-ই ভালো নেই। সুতরাং কেউই মিথ্যা সান্ত্বনা দিয়ে বলছেন না যে সংকট শিগগিরই মিটে যাবে। আইএমএফ দুই মাস আগেই বলে দিয়েছে, বিশ্ব অর্থনীতির ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন ও অনিশ্চিত। কেউই মনে করেন না যে সংকটের দ্রুত সমাধান হবে। বরং সবাই সতর্ক করছেন, সংকট দীর্ঘস্থায়ী হবে এবং সেভাবেই প্রস্তুতি নিতে হবে।

এবারের অর্থনৈতিক সংকটের প্রথম শিকার শ্রীলঙ্কা। দেউলিয়া হওয়ার পর দেশটির সরকারের মুখপাত্র নালাকা গোদাহেয়া অভিযোগ করে বলেছিলেন, ‘দেশটির অর্থনৈতিক নীতি যাঁরা পরিচালনা করতেন, তাঁরা প্রেসিডেন্টকে পুষ্পসম চিত্র দেখিয়ে বিভ্রান্ত করেছিলেন।’

শ্রীলঙ্কার পরই বিপদে আছে পাকিস্তান। তবে শ্রীলঙ্কার মতো পরিস্থিতি আপাতত এড়াতে পেরেছে বলে স্বস্তি প্রকাশ করেছেন দেশটির অর্থমন্ত্রী। কোনো মিথ্যা আশ্বাস না দিয়ে জার্মানির অর্থমন্ত্রী জনগণকে বলেই দিয়েছেন যে সামনে কঠিন সময় আসছে।

জাপানের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, মূল্যস্ফীতির কারণে সাধারণ মানুষকে যন্ত্রণা পোহাতে হচ্ছে এবং তাঁর সরকার চেষ্টা করছে স্বস্তি দিতে। সব মিলিয়ে অর্থনীতির এবারের বৈশ্বিক সংকট নীতিনির্ধারকদের কপালে ভাঁজ ফেলে দিয়েছে। অর্থনীতি আবার কবে স্থিতিশীল হবে, কেউ-ই ধারণা করতে পারছেন না।

স্বর্গে কেবল বাংলাদেশ

বিশ্বব্যাপী সবাই চিন্তিত মূলত উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রভাব নিয়ে। কারণ, মূল্যস্ফীতি বাড়লে কষ্টে থাকে দেশের মানুষ। সবাই যখন নিজেদের দেশের মানুষের জীবনযাপন নিয়ে চিন্তিত, তখন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন বললেন, ‘বৈশ্বিক মন্দায় অন্যান্য দেশের তুলনায় আমরা বেহেশতে আছি।’

প্রায় একই সময় স্থানীয় সরকারমন্ত্রী বললেন, ‘গ্রামগঞ্জের কোনো মানুষ না খেয়ে নেই। প্রত্যেক মানুষ খেতে পারছে। প্রত্যেক মানুষের গায়ে জামাকাপড় আছে। আমি মনে করি না, আমরা খুব খারাপ অবস্থায় আছি।’ পরিকল্পনামন্ত্রী আবদুল মান্নানও কিছুদিন আগে বললেন, ‘জিনিসপত্রের দাম কিছুটা বেড়েছে সত্য, তবে জিনিসপত্রের দাম বাড়ায় এখনো কেউ মারা যায়নি।’

সরকারের মন্ত্রীরা যে কেবল স্বর্গের অর্থনীতির খবরই দিচ্ছেন তা নয়, যাঁরা অর্থনীতির সত্যিকার নীতিনির্ধারক, তাঁরা তো এক ধাপ এগিয়ে। তাঁরা কেউ-ই সংকট দীর্ঘ হবে মনে করেন না। প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদবিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীর আশ্বাস অনুযায়ী, চলতি সেপ্টেম্বর মাসেই বিদ্যুৎ-সংকট কেটে যাওয়ার কথা।

আবার গত ২৭ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার বলেছেন, ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি ও বৈদেশিক মুদ্রাবাজারের অস্থিরতা আগামী দু-তিন মাসের মধ্যে কেটে যাবে। একই আশ্বাস দিয়েছেন যোগাযোগমন্ত্রী, সরকারি দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। সম্ভবত দুনিয়ায় বাংলাদেশই একমাত্র দেশ, যার নীতিনির্ধারকেরা সংকট কেটে যাওয়ার এ রকম সুনির্দিষ্ট আশ্বাস দিতে পারছেন।

অর্থনৈতিক ঝুঁকি বা সংকট নিয়ে মন্ত্রী বা নীতিনির্ধারকদের এ ধরনের বক্তব্যের বাইরে কথাবার্তার আরও একটি ধারা আছে। তাতে বরং মানুষ বিভ্রান্ত হচ্ছে আরও বেশি। রাশিয়া থেকে তেল আমদানি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর দুই উপদেষ্টা দুই ধরনের বক্তব্য দিচ্ছেন।

বাণিজ্যমন্ত্রী ৯ ধরনের পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দিলেন, ওই দিনই এ নিয়ে কৃষিমন্ত্রী বললেন ভিন্ন কথা। জ্বালানি তেলের দাম ৫ টাকা কমানোর পর একই বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা বললেন, জ্বালানি তেলের দর বাড়িয়ে রাখাটাই ঠিক ছিল, দাম কমানো ঠিক হয়নি।

এবার যুদ্ধ শব্দস্ফীতির সঙ্গে

যেকোনো সংকটের সময় প্রথম শর্তই হচ্ছে সমস্যা স্বীকার করে নেওয়া। অস্বীকারের মনোভাব সংকটকে আরও বাড়ায়। মূল্যস্ফীতির চাপে যাঁদের জীবন পর্যুদস্ত, তাঁকে স্বর্গে থাকার গল্প না বলাই ভালো। তাতে বিভ্রান্তি ও বিরক্তি বাড়ে। আর বক্তব্যের সমন্বয়হীনতা অবিশ্বাস বাড়ায়। বিদ্যমান পরিস্থিতি সম্বন্ধে ভুল ধারণা দিলে ভুক্তভোগীরা প্রস্তুতিও নিতে পারেন না। সুতরাং সংকটের সময় নীতিনির্ধারকেরা কী বলবেন, সেটিকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়।

সংকটের সময় কীভাবে কথা বলতে হবে, তা নিয়েও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) বিশেষ একটি দিকনির্দেশনা আছে। সেখানে লেখা আছে, কী বলতে হবে তার পরিষ্কার ধারণা বা উদ্দেশ্য থাকতে হবে।

খারাপ সংবাদ বলতে হলেও তা পরিষ্কার এবং সুনির্দিষ্ট হতে হবে। তবে অবশ্যই সংকট নিরসনে অতি আশাবাদ বা প্রতিশ্রুতি দেওয়া যাবে না। আর সবাইকে কথা বলতে হবে একই সুরে। ভিন্ন ভিন্ন কথা বিভ্রান্তি আরও বাড়ায়। সুতরাং বক্তব্যের ও বক্তাদের মধ্যে সমন্বয় থাকাটা খুব জরুরি। সুতরাং যথাযথ প্রস্তুতি নিয়েই কথা বলতে হবে।

এখনকার অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে ‘পাবলিক কমিউনিকেশন ডিউরিং ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইসিস’ শিরোনামে আইএমএফের লেখাটি নীতিনির্ধারকদের কাছে বিতরণ করা জরুরি হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ আইএমএফের কাছে ঋণসহায়তা চেয়েছে। সুতরাং আইএমএফের এই নির্দেশনাটি বাধ্যতামূলকভাবেই পড়তে দেওয়া যায়। তাতে দেশ উপকৃতই হবে।

এদুয়ার্দো গালেয়ানো উরুগুয়ের একজন প্রখ্যাত সাংবাদিক ও লেখক। তিনি বলেছিলেন, ‘সর্বোত্তম ভাষা হলো নীরবতা। আমরা এখন এক ভয়ানক শব্দস্ফীতির সময়ে বাস করি, যা মুদ্রার স্ফীতির চেয়েও অনেক খারাপ।’ হয়তো বিভ্রান্তিকর কথাবার্তায় বা অতিকথনে বিরক্ত হয়েই এদুয়ার্দো গালেয়ানো কথাগুলো বলেছিলেন।

বিশ্বজুড়ে অর্থনীতিবিদেরা এখন বিতর্ক করছেন মূল্যস্ফীতি বেশি খারাপ না মন্দা বেশি খারাপ—এ নিয়ে। মূল্যস্ফীতি কমাতে গিয়ে অর্থনৈতিক মন্দা ডেকে আনা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই পথে বদ্ধস্ফীতি বা স্ট্যাগফ্লেশনও চলে আসতে পারে। অর্থাৎ উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও নিম্ন প্রবৃদ্ধি। এ রকম এক অবস্থায় বাংলাদেশের মানুষ মূল্যস্ফীতির চাপ নিয়ে তো বিপাকে আছেই, ভয়ানক শব্দস্ফীতি নিয়েও আছে মহাযন্ত্রণায়। এ থেকে রেহাই দরকার। এ পরিস্থিতিতে শঙ্খ ঘোষের সেই কবিতার কথা মনে করাই যথার্থ, ‘এত বেশি কথা বলো কেন?/ চুপ করো/ শব্দহীন হও’।

শওকত হোসেন প্রথম আলোর হেড অব অনলাইন

shawkat.massum@prothomalo.com