আমরা বিভিন্ন পেশার শিক্ষিত নাগরিকদের জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও দায়িত্ববোধ নিয়ে নানা সময়েই প্রশ্ন ওঠে। আমাদের এমন সব নাগরিকদের ঘরে অনেক সময় গৃহকর্মীদের ওপর নির্যাতনের খবর দেখা যায় সংবাদমাধ্যমে। তখন মনে হয় মানবাধিকার, শ্রমমর্যাদা, নাগরিক অধিকার—এসব কথা আমাদের পেশাজীবিতার সঙ্গে অনেক সময় প্রতিফলিত হয় না। আমরা সমাজকে এসব দেখাই, কিন্তু নিজ নিজ পরিসরে এসবের চর্চা করি কি? একদিকে রাষ্ট্রের সুবিধাগুলো গরিবের জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক নয়, অন্যদিকে আমরা অগ্রসর নাগরিকেরাও দায়িত্বশীল নই। আমাদের চিন্তার প্রায়োগিক ন্যায্যতা থাকা দরকার। প্রদীপের নিচে অন্ধকার না রেখে সমাজসংস্কার ও পরিবর্তনগুলো নিজ গৃহ থেকেই আগে শুরু করা দরকার।
ব্যক্তি কিংবা সমাজ—কাউকেই দোষারোপ না করে এখানে একটি খুব স্পর্শকাতর বিষয়ের অবতারণা করছি সংক্ষেপে। সেটি হচ্ছে—গৃহশ্রমিক কিংবা গৃহভৃত্য, আমরা যাঁদের বুয়া বা কাজের ছেলে ও কাজের মেয়ে ডাকি। সত্যিকারভাবে বলতে গেলে, ‘শুধু নিম্নমান, রুচিহীন ও শ্রমঘন’ কাজের জন্য স্বল্প বা উচ্চ যে বেতনেই হোক ‘আলাদা বা বিশেষ শ্রেণির’ শ্রমিক নিয়োগ নৈতিকতা, সভ্যতা ও আধুনিকতাবোধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
আমরা একটা মানবিক সমাজের স্বপ্ন দেখি, যেখানে উচ্চমান কিংবা নিম্নমান বলে কাজের কোনো শ্রেণি নেই। কেউ তথাকথিত ‘নিম্নমান ও রুচিহীন’ কাজের জন্য জন্ম নেয় না, তাই ‘নিম্নমান ও রুচিহীন’ বলে কোনো কাজকে কেউ ঘৃণা করবে না, বরং নিজের দরকারে কিংবা নিজের দ্বারা সৃষ্ট ‘নিম্নমান, রুচিহীন ও শ্রমঘন’ সব কাজ নিজেকেই করতে হবে—এমন বোধ দিয়েই আমাদের শিশুদের বড় করতে হবে। হ্যাঁ, প্রয়োজনে মানুষ একে অন্যকে সাহায্য করবে স্বেচ্ছাশ্রমে কিংবা অর্থের বিনিময়ে, শিশুদের বেলায় বাধ্যতামূলক শিক্ষার পাশাপাশি সাহায্যকারী হিসেবে কাজ করবে, কিন্তু সেটা যৌক্তিক ও আধুনিক একটি ফ্রেমওয়ার্কের ভেতর; যাতে সেবাগ্রহীতা কাজের পরিবেশ ও পারিশ্রমিক প্রদানে ন্যায্যতা নিশ্চিত করেন, কাজে নিরাপত্তা ও মানবিক বিষয়গুলোর বাধ্যবাধকতা পালন করেন এবং সেবাকর্মীও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয়ে পরে কাজে দক্ষ ও আন্তরিক হতে পারেন।
যেহেতু সমাজে ও পরিবারে ‘শুধু নিম্নমান, রুচিহীন ও শ্রমঘন’ কাজের তরে স্থায়ী বুয়া, কাজের ছেলে, কাজের মেয়ে নামক অযৌক্তিকভাবে নিম্ন রেটের শ্রমঘণ্টায় চালিত প্রথা রয়ে গেছে সুদীর্ঘ কাল, তাই এখানে উভয় পক্ষের প্রাপ্তি ও অধিকারকে ধর্তব্যে এনে বিষয়টির কাঠামোগত নিষ্পত্তি দরকার। গৃহকর্মী কিংবা গৃহশ্রমিকদের রেজিস্ট্রেশনের ব্যবস্থা দরকার। এটা দ্বিপক্ষীয় লাভ বয়ে আনবে। শ্রমিক যেমন তাঁর শ্রমের মর্যাদা পাবেন, তেমনি গৃহমালিকেরাও সম্পদ ও সন্তানের নিরাপত্তা এবং উচ্চমান কাজের বিষয়গুলোয় আশ্বস্ত হতে পারবেন।
এর বাইরেও ‘নিজের কাজ নিজেকেই করতে হয়’—এ রকম একটা স্বনির্ভরতা শিক্ষা দিয়েই আমাদের ছেলেমেয়েদের গড়ে তোলার একটা দায় আছে। মা–বাবা ঘুষ খেলে, দুর্নীতি করলে, অনাচার এবং অপসংস্কৃতির চর্চা করলে বাচ্চারা সেটাই শিখবে। বাবা ঘরে মাকে রান্নাবান্না ও ঘরের কাজে সাহায্য না করলে সন্তান এসব শিখবে না। বাবা ও মা নিজেরাই গৃহশ্রমিকের ওপর অন্যায় আচরণ এবং অসম্মানজনক ভাষার ব্যবহার করলে সন্তানেরাও তা দ্বারা নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত হবে।
আমাদের বাচ্চারা আসলে কী দেখে বড় হয়? তারা দেখে অনিয়ম, অরাজকতা, নৈরাজ্য, জোর যার মুল্লুক তার। দেখে, তাদের বাবাদের কেউ ঘুষখোর, কেউ দুর্নীতিবাজ বা ব্যবসায় ভেজাল দেয় বা অন্যকে ঠকায়। তারা দেখে সমাজের বড়লোক–ছোটলোকের বিভাজন। তারা দেখে শ্রমঘন কাজ করে ছোটলোকেরা এবং সেসব মানুষের সঙ্গে অন্যায় আচরণও, তারা দেখে দেশের সবাই আইন ভাঙার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত, অনেক মানুষ শ্রমঘন কাজকে অবজ্ঞা করে, গরিব মানুষদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য–অবজ্ঞা করে, তারা দেখে অন্যায় করেও এ সমাজে সহজে পার পেয়ে যাওয়া যায়। দেশের সব অনিয়ম তাকে হাসিমুখে মেনে নিতে শেখানো হয়। মানবিক, সৎ ও নিয়মানুবর্তী হওয়ার অভ্যাস সে সমাজ ও পরিবারে দেখে না বলে পরিবারের নিত্যদিনের নেতিবাচক চর্চাগুলো তার মধ্যে স্বাভাবিক হয়ে ওঠে।
আমাদের ভাবতে হবে কিংবা ভাবতে শিখতে হবে, ‘শুধু নিম্নমান, রুচিহীন ও শ্রমঘন’ কাজ যিনি করেন, তিনি দায়বদ্ধ অসহায় নিরাপত্তাহীন ক্ষমতাহীন ‘বুয়া’ বা অধুনা মানবদাস নন; বরং সমাজের আর দশজনের মতোই সাধারণ মানুষ, যিনি একজন সেবাদানকারী মানুষ, অর্থের ও সম্মানের বিনিময়ে সেবা সহায়তা দিচ্ছেন।
প্রয়োজন সাপেক্ষে শ্রম কেনা যায়, তবে মানবিক ও নৈতিক ফ্রেমওয়ার্কে নির্দিষ্ট আর্থিক খরচের বিপরীতে। পৃথিবীর বহু দেশে গৃহকর্মীর প্রচলন উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে সেখানে কেউ কারও দাস নয়; রান্না থেকে শুরু করে ঘর গোছানো, পরিষ্কার এবং সন্তান লালনপালনে গৃহের নারী-পুরুষ সদস্যরা সমান অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেন। এতে দেশগুলোর নাগরিক একদিকে স্বাবলম্বী হয়েছে, অন্যদিকে উৎপাদন বেড়েছে। মায়েদের বোঝা কমেছে, সন্তান ও সব বাবার দায়িত্ব বেড়েছে। সবাই নিজের কাজ নিজে করতে শিখছে, সন্তানেরা মা-বাবার কাজ দেখে নিজেরা নিজেদের দায়িত্ববোধ গড়ছে।
টেকসইভাবে দেশ উন্নত করতে হলে সব নাগরিককে শিক্ষার আওতায় আনতে হবে। কাজের ছেলে, কাজের মেয়ে শিক্ষাবঞ্চিত, তাদের শোষিত রেখে অপরাধহীন সমাজ গড়া অসম্ভব। যে অপরাধের শিকার তারা শৈশবে হচ্ছে, তা সমাজকে ফিরিয়ে দিতে চাইতে পারে পরিণত বয়সে। কাজের সহকারী পরিবার নিয়ে যে পরিবেশে থাকেন, এর মধ্য দিয়ে তাঁর চিন্তা ও মননে ভালো কিছু গড়ে ওঠা অসম্ভব। সন্তানকে উন্নত শিক্ষায়, উন্নত জীবনের তরে গড়ে তোলা এবং সমাজকে সেবা দেওয়ার মাহাত্ম্য তাঁর কাছে আশা করা মুশকিল। সমাজ ও দেশের দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই উন্নয়নে তাঁদেরও অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। শিক্ষাপরিকল্পনায় এসব বোধ আনা দরকার।
নগরে শ্রম নিবন্ধনের মাধ্যমে একটি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে সরকার। অপপ্রথার বিলোপে মানসিকতার কৃষ্ণপক্ষ নিরসন প্রয়োজন, যা একটি দীর্ঘমেয়াদি সামাজিক সংস্কার এবং এর শুরু সরকারকে করে দিতে হবে। নগরের মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা বা কাজের ছেলেমেয়ে ও সহকারীদের শ্রম নিবন্ধন যা করা যায়—
১. নিয়োগদাতা হিসেবে মালিকপক্ষ ও সেবাকর্মীদের বাধ্যতামূলক নিবন্ধনে লাগবে।
২. নগর এলাকায় অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্তন করে শিশুশ্রম প্রতিরোধী নীতিমালার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে হোম সার্ভিসে কাজের বিধান দরকার। অষ্টম শ্রেণি পাস না করা পর্যন্ত শিশুকে স্কুল চলাকালে কোনো ধরনের বিনিময়যোগ্য শ্রমে প্রবেশ করতে পারবে না (এ ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত করতে হবে, ধাপে ধাপে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত)। পরিবার সংকটাপন্ন হলে সরকারকে সামাজিক সুরক্ষা ভাতার মাধ্যমে দেখভাল করতে হবে। হ্যাঁ, পারিবারিক শ্রমের বেলায় কর্মমুখী শিক্ষার উপায় হিসেবে দক্ষতা তৈরির জন্য (কৃষি ও কৃষির উপখাত) শিশুশ্রম থাকতে পারে।
৩. সেবাকর্মী হিসেবে কাজে আসার পূর্বযোগ্যতা হিসেবে হাউস কিপিং ডিপ্লোমা অথবা হাউস কিপিং, হোম ম্যানেজমেন্ট, হাইজিন ও ক্লিনিংয়ের ওপর স্ট্যান্ডার্ড ট্রেনিং বাধ্যবাধক থাকবে। এটা সিটি করপোরেশন নিজে দেবে অথবা স্ট্যান্ডার্ড কমপ্লায়েন্স মেনে চলা হোম সার্ভিস কোম্পানির মাধ্যমে করবে। এ জন্য যুব উন্নয়নে স্বল্পমেয়াদি ডিপ্লোমা কোর্স থাকতে পারে। এ ডিপ্লোমা ও ট্রেনিং অবশ্যই ফ্রি হতে হবে অথবা নামমাত্র মূল্যে এর ব্যবস্থা করতে হবে।
৪. দৈনিক মোট কাজের ঘণ্টা, পেমেন্ট, পেমেন্ট ডেট ও ওভারটাইমের স্ট্যান্ডার্ড রেট নির্ধারণ করতে হবে। পেমেন্ট ডিজিটাল ব্যবস্থায় হতে পারে। নির্দিষ্ট দিন ছুটি, অসুস্থতাজনিত ছুটি, উৎসব ভাতা, স্বাস্থ্য ভাতা দিতে হবে—সেটা পরিমাণে যা-ই হোক। এ বোধ গড়তে হবে যে সবাই মানুষ, সবার জন্যই একই ধরনের সুযোগ–সুবিধা প্রযোজ্য।
৫. স্থায়ী হোম সার্ভিসের শ্রমিককে মানসম্পন্ন আবাসন ও পরিধান সুবিধা দিতে হবে। গৃহে সার্বক্ষণিক অবস্থানকারী গৃহকর্মীদের নিয়োগ দেওয়ার আগে রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক করার ব্যাপারটি খুবই অর্থবহ। গৃহে সার্বক্ষণিক অবস্থানকারী শ্রমিক একটি ন্যূনতম মানের আবাসন ও স্বাস্থ্য সুবিধা পাওয়ার দাবি রাখেন। শহরের ‘কস্ট অব লাইফ’ ভিত্তিতে ন্যূনতম মজুরি, থাকার মান, কাজের পরিবেশ ইত্যাদি দৈবচয়নে তদন্ত করতে হবে।
রেজিস্ট্রেশনের সময় গৃহকর্তাকে একটা আচরণবিধি মেনে চলার জন্য স্বাক্ষর করাতে হবে এবং সেটা মেনে চলতে উৎসাহিত করা হবে। আচরণবিধিতে গৃহে সার্বক্ষণিক অবস্থান করা গৃহকর্মীদের শ্রমঘণ্টা, আচরণগত বিষয়াদি, শ্রমিক অধিকারের বিষয়াদি, আবাসন ও স্বাস্থ্য সুবিধাবিষয়ক নির্দেশনা থাকবে। বিশেষ কাজের জন্য সেবাকর্মীকে বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথা আসতে পারে। শিশু দেখভালে নিয়োজিত ব্যক্তির বিশেষ ট্রেনিং থাকা চাই।
বাসার কাজে সাহায্যকারী ব্যক্তি যাতে গৃহে কাজের সময় কম পানি ও বিদ্যুৎ খরচ করেন, ওয়াশিং মেশিন, ড্রায়ার, ভ্যাকুয়াম ক্লিনার, কফি মেশিন, ফ্রিজ বা রেফ্রিজারেটর ইত্যাদি বিশেষ অ্যাপ্লায়েন্স সঠিকভাবে চালাতে পারেন, সে রকম প্রশিক্ষণ থাকবে। ফায়ার অ্যালার্ম কিংবা ফিউজ ব্রেকে করণীয় কিংবা ইমার্জেন্সিতে মেইন সুইচ বন্ধ করার সাধারণ কিংবা গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে পারেন। বাসার কাজকে টুলস বেজড করার উৎসাহ দেওয়ার কথা থাকতে পারে। সর্বোপরি নিয়মিত কাজগুলোর জন্য সুনির্দিষ্ট ভিত্তি তৈরি করা দরকার, যার ওপর গৃহশ্রমের নলেজ ম্যানেজমেন্ট গড়ে ওঠতে।
তবে সামাজিক, মানবিক পরিবর্তনে দীর্ঘ সময় লাগতে পারে। ক্ষয়ে যাওয়া মানবিক মূল্যবোধের জগতে ব্যক্তি ও পরিবার এটা কতটা সম্ভব করে তুলবে, সেটা বিতর্কসাপেক্ষ বলে আইনের শাসন দরকার। শ্রমকে যেদিন আমরা মর্যাদা দিতে পারব, সেদিন থেকেই তীব্র বৈষম্যের সমস্যা সমাধানের একটা পথ পাওয়া যাবে। আর এর সূচনা সরকারকেই করে দিতে হবে।
আমাদের ভাবতে হবে কিংবা ভাবতে শিখতে হবে, ‘শুধু নিম্নমান, রুচিহীন ও শ্রমঘন’ কাজ যিনি করেন, তিনি দায়বদ্ধ অসহায় নিরাপত্তাহীন ক্ষমতাহীন ‘বুয়া’ বা অধুনা মানবদাস নন; বরং সমাজের আর দশজনের মতোই সাধারণ মানুষ, যিনি একজন সেবাদানকারী মানুষ, অর্থের ও সম্মানের বিনিময়ে সেবা সহায়তা দিচ্ছেন। সমাজের একটি বৃহৎ অংশকে নিম্নমান আবাসনে রেখে, অভিজাতের জবান ও হাতের কাছে নির্যাতিত রেখে, রুচিহীন উচ্ছিষ্ট খাদ্যে, মানহীন শিক্ষায়, স্বাস্থ্যে ও পরিবেশে বেড়ে উঠতে দিয়ে অপরাধহীন সভ্য ও মানবিক সমাজ গড়ার স্বপ্ন কখনোই বাস্তবতা পাবে না। এ বোধ আমাদের তাড়িত করুক, বাংলাদেশ এগিয়ে যাক।
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব টেকসই উন্নয়নবিষয়ক লেখক