আমেরিকার গণতন্ত্র দেশটির আইন ব্যবস্থার মতোই দৃঢ়। দুর্নীতি রোধ ও নির্বাহী ক্ষমতাকে জবাবদিহিমূলক রাখতে এই দেশের প্রতিষ্ঠাতারা বিচার বিভাগকে কেন্দ্রীয় সরকারের তৃতীয় স্তম্ভ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন।
এ কারণেই গেল সপ্তাহে ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর নিজস্ব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ স্পেশাল-এ বিশেষ কৌঁসুলি জ্যাক স্মিথের সমালোচনা করায় সেটি গভীর উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০২০ সালে ট্রাম্প নির্বাচনী ফল উল্টে দিয়ে গদিতে থেকে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন—এমন অভিযোগে জ্যাক স্মিথ ট্রাম্পের বিরুদ্ধে চারটি মামলা করার আগেই ট্রাম্প স্মিথের বিরুদ্ধে ‘বিচারিক অসদাচরণের’ অভিযোগ করেছেন।
গত এপ্রিলে ম্যানহাটনের গ্র্যান্ড জুরি ব্যবসায়িক নথিতে ভুয়া তথ্য যুক্ত করার অভিযোগে ট্রাম্পকে ৩৪টি অপরাধমূলক অপরাধে অভিযুক্ত করেছিল। ওই সময়েও ঠিক একইভাবে ট্রাম্প প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন। তিনি তখন বিচার বিভাগ ও এফবিআইয়ের জন্য তহবিল বরাদ্দ দেওয়া বাতিলের আহ্বান জানিয়েছিলেন।
ট্রাম্প তাঁর দীর্ঘদিনের নেতিবাচক প্রচার কৌশলের অংশ হিসেবে এই দুটি প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন। এর মাধ্যমে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের আইনের শাসনকে খাটো করতে এবং তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অভিযোগ হিসেবে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। একসময় যাঁরা ট্রাম্পের আইনজীবী হিসেবে কাজ করেছেন, তাঁরাও আমাকে বলেছেন, এইভাবে যুক্তরাষ্ট্রের আইন ও বিচার বিভাগকে অবজ্ঞা করা হলে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি ব্যবস্থা ভেঙে পড়তে পারে। এমনকি যদি ট্রাম্প আদালতের বিচারে দোষী সাব্যস্তও হন, তারপরও ট্রাম্পের একনিষ্ঠ সমর্থকেরা মনে করতে থাকবেন, গোটা আইন ব্যবস্থা অন্যায়ভাবে শুধু ট্রাম্পকে রাজনৈতিকভাবে ঘায়েল করতে এই রায় দিয়েছেন।
আদালত প্রথাগতভাবে আইনি নজির অনুসরণ করে থাকে। সাম্প্রতিক রায়গুলোতে রক্ষণশীল সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারকেরা অতীতের রায়গুলোকে উল্টে দিয়েছেন যা নারীদের গর্ভপাতের অধিকার, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ইতিবাচক পদক্ষেপ, বন্দুকের বিধিনিষেধ এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠিত আইনের গ্যারান্টি দিয়েছে। বিশ্বজুড়ে রাজনৈতিক ও বিচারিক ক্ষেত্রের নাজুক সম্পর্ক এখন ভেঙে গেছে বা সেই সম্পর্ক চাপের মধ্যে রয়েছে।
একটি স্তরে, ট্রাম্পের বিস্ফোরক মন্তব্যের প্রভাব নিয়ে মার্কিন আইনজ্ঞরা তাঁদের উদ্বেগ জানাচ্ছেন। অন্য স্তর থেকে দেখলে দেখা যাবে, ওয়াশিংটনে আমরা যেসব কাণ্ডকারখানা দেখছি, সেটা আসলে সারা বিশ্বে চলমান প্রবণতারই একটি অংশ। আমরা হাঙ্গেরি থেকে পাকিস্তানে দেখতে পাচ্ছি দিন দিন বিচারকদের ক্ষমতা খর্ব করা হচ্ছে এবং নির্বাহী বিভাগকে উত্তরোত্তর শক্তিধর করা হচ্ছে।
এই পরিস্থিতি দেখাটা খুব কষ্টদায়ক। ১৯৮০ সাল থেকে আমি আদালতের সংবাদ সংগ্রহবিষয়ক সাংবাদিকতা করে আসছি। কয়েক দশক আগে আমার একজন সোর্স (যিনি ওয়াশিংটনের আইন প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ক্ষমতাধর একটিতে অতি উচ্চ বেতনে কাজ করতেন) আমাকে বলেছিলেন, জাতিসংঘকে সহায়তা করার জন্য তাঁকে চাকরি ছাড়তে হচ্ছে। তিনি বলেছিলেন, বৈশ্বিক স্বৈরতন্ত্র মাথাচাড়া দেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে কয়েকটি দেশের জন্য আমেরিকান স্টাইলের সংবিধান প্রণয়ন করতে হবে। আর এখন সেই আমেরিকার অনেক ভোটারই আমাদের দেশে গণতন্ত্র শেষ পর্যন্ত টিকতে পারবে কি না, সে বিষয়ে সংশয়াচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে। পাকিস্তান ও অন্যান্য দেশে বিচারকেরা গুপ্তহত্যার শিকার হচ্ছেন। গার্ডিয়ান পত্রিকার ভাষ্যমতে, হাঙ্গেরিতে ভিক্তর ওরবান বিচারিক ‘চেকস অ্যান্ড ব্যালান্সেস’ ধ্বংস করার ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ইরানে ভিন্নমতাবলম্বীদের ওপর সরকারি সহিংস দমন-পীড়নের প্রতিবাদে বিক্ষোভ করায় ২০২২ সালে সরকার কমপক্ষে ৪৪ জন আইনজীবীকে গ্রেপ্তার করেছে।
চীন ও ভারতের বিচারব্যবস্থাও প্রবলভাবে কোণঠাসা হচ্ছে। ২০২০ সালে ওয়াশিংটন পোস্ট–এ রানা আইয়ুবের লেখা একটি কলামের শিরোনাম ছিল, ‘ভারতের বিচারব্যবস্থা ধ্বংস করার কাজ প্রায় শেষের পথে।’ ১৯৯৭ সালে হংকংকে ব্রিটিশ সরকার চীনের হাতে তুলে দেওয়ার আগে চীন সরকার ‘এক দেশ, দুই ব্যবস্থা’খ্যাত একটি রূপরেখা মেনে চলার বিষয়ে অঙ্গীকার করেছিল, যা হংকংকে একটি আইনি স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দিয়েছিল। কিন্তু ২০২০ সালে চীন জাতীয় নিরাপত্তা আইন পাস করেছে। এর মধ্য দিয়ে তারা হংকংয়ের সেই স্বাধীনতাকে খর্ব করেছে এবং হংকংয়ে বসবাসকারী চীনা নীতির সমালোচকদের সাজা দেওয়ার এখতিয়ার দিয়েছে।
এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক বন্ধু ইসরায়েলও স্বাধীন বিচারকদের ক্ষমতা ক্রমাগত ছেঁটে ফেলছে, যা দেশটিতে গণবিক্ষোভের সৃষ্টি করেছে। মার্কিন আইনি ব্যবস্থার ওপর ট্রাম্প এমন সময় ক্ষোভ ঝাড়লেন, যখন সুপ্রিম কোর্টের প্রতি জন আস্থা ইতিহাসের সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে।
আদালত প্রথাগতভাবে আইনি নজির অনুসরণ করে থাকে। সাম্প্রতিক রায়গুলোতে রক্ষণশীল সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারকেরা অতীতের রায়গুলোকে উল্টে দিয়েছেন যা নারীদের গর্ভপাতের অধিকার, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ইতিবাচক পদক্ষেপ, বন্দুকের বিধিনিষেধ এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠিত আইনের গ্যারান্টি দিয়েছে। বিশ্বজুড়ে রাজনৈতিক ও বিচারিক ক্ষেত্রের নাজুক সম্পর্ক এখন ভেঙে গেছে বা সেই সম্পর্ক চাপের মধ্যে রয়েছে।
ট্রাম্পের হাত ধরে ওয়াশিংটনে যা ঘটবে, তা সেই বিচ্ছেদের পরিণতিকে আরও ত্বরান্বিত করবে। যুক্তরাষ্ট্র সুশাসনের বাতিঘর ছিল। কিন্তু সেই অবস্থাকে ট্রাম্প আরও ঝুঁকির দিকে নিয়ে যাচ্ছেন।
দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিতভাবে অনূদিত
জিল অ্যাব্রামসন নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকার সাবেক নির্বাহী সম্পাদক