মতামত

জনস্বার্থে মামলা: সব কাঁটা ধন্য করে নিশ্চিত হোক ন্যায়বিচার

গণগ্রেপ্তারের শিকার এই বাবার শিশুসন্তানকে আদর করার ছবিটি নাড়া দিয়েছিল পাঠকদের। ২৫ ডিসেম্বর ২০১৮। এক সময় গণগ্রেপ্তার নিয়েও এ দেশে জনস্বার্থে মামলা হয়েছিল
ফাইল ছবি

ধূসর শহুরে প্রাণহীন যাপন যেন অমোঘ নিয়তি। কেজো জীবনে সবুজাশ্রয়ী হওয়ার ব্যবস্থাপত্র এখন চিকিৎসকেরাই দিয়ে থাকেন। আমাদের শহুরে জীবনে প্রতি মুহূর্তে বাড়ছে কাজের চাপ, যে কারণে সবুজের প্রাসঙ্গিকতা ও প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হচ্ছে আগের চেয়ে বেশি করে। এই পরিপ্রেক্ষিতে বছরে দু–একবার গ্রিন রিট্রিট (সবুজ যাপন) খুবই দরকার। দূষণ, ধুলো-ধোঁয়া, ধ্বংস থেকে রক্ষা পাওয়ার প্রথম আশ্রয় সবুজ প্রকৃতি।

প্রথাগত আইনজীবীদের পেশাগত কারণে দেওয়ানি, ফৌজদারি অথবা কোম্পানি ম্যাটারে  বিচারপ্রার্থীর ব্যক্তিগত লাভ–ক্ষতির হিসাব নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়। আবার সেই একই আইনজীবীকে জনস্বার্থ বিঘ্নিত হওয়ার প্রতিবিধানে পাবলিক ইন্টারেস্ট লিটিগেশন বা জনস্বার্থ মামলা নিয়েও তৎপর হতে হয়। ‘প্রথাগত ল প্র্যাকটিসের বাইরে জনস্বার্থ মামলার মাধ্যমে যেমন সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা প্রকাশ পায়, আবার পেশাগত প্রশান্তিও নিশ্চিত হয়,’ বলেন জনস্বার্থে মামলার মাধ্যমে সুপরিচিত আইনজীবী মোস্তাক আহমেদ চৌধুরী।

মানুষের শারীরিক, মানসিক, সামাজিক ও আধ্যাত্মিক আশ্রয়স্থল হয়ে উঠছে থেরাপিউটিক রিলিফ (নিরাময়), তেমনি সরকারি নানা পদক্ষেপে জনস্বার্থ বিঘ্নিত হওয়ার পর সেই অনিয়মকে চ্যালেঞ্জ করে কিছু পরার্থপ্রিয় আইনজীবী পেশাগত দায়িত্বের অংশ হিসেবে জনস্বার্থ মামলায় প্রতিকার খোঁজেন। সেটিও একধরনের প্রফেশনাল থেরাপিউটিক রিট্রিট (পেশাগত নিরাময়)। উচ্চ আদালতে দুজন সম্মানিত বিচারপতি, আইনজীবী, এনজিও  প্রতিনিধি, সাংবাদিক ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের উপস্থিতিতে ছিল জনস্বার্থ মামলা বিষয়ে তিন দিনের প্রাণবন্ত এক অধিবেশন।

হাইকোর্ট বিভাগের মাননীয় বিচারপতি কে এম কামরুল কাদের, মাননীয় বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়ার উপস্থিতিতে সাম্প্রতিক নানা ইস্যুতে মতামত ও আইনি ব্যাখ্যা আর জনস্বার্থ মামলার প্রায়োগিক নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক আলোচনা তরুণ আইনজীবীদের প্রাণিত করেছে দারুণভাবে। মাননীয় বিচারপতিদ্বয় জনস্বার্থ মামলার নানা চ্যালেঞ্জ আলোচনা করেন। প্রথমে ব্যবহারজীবী হিসেবে, পরবর্তী সময়ে বিচারপতি হিসেবে বহু জনস্বার্থ মামলা পরিচালনার পুরোনো পুরোহিত বিচারপতি নিজামুল হক নাসিমের অভিজ্ঞতা বিনিময় ছিল প্রাণময়। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতি আর অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (এএলআরডি) মাঠ-বাস্তবতার উপস্থাপন অংশগ্রহণকারী আইনজীবীদের জন্য নতুন দায়িত্ব নেওয়ার অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করবে।

দ্য অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অব জাস্টিস ইজ দ্য ফার্মেস্ট পিলার অব গভর্নমেন্ট (বিচার  প্রশাসন সরকারের প্রধানতম স্তম্ভ), জর্জ ওয়াশিংটনের এই চিন্তার সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ না করে আইন বিভাগ না করে নির্বাহী বিভাগ। কারণ, আইন বিভাগ কর্তৃক প্রণীত আইনের ন্যায্যতা যাচাই আর প্রশাসনিক আদেশ (নির্বাহী আদেশ) ও ক্রিয়াকলাপের সঠিকতা বিচারের ভার বিচার বিভাগের ওপর অর্পিত সাংবিধানিক দায়িত্ব। এখানে জাস্টিস কেবল ধারণাগত অর্থে ব্যবহৃত হয়নি ‘অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অব জাস্টিস’ শব্দবন্ধে ন্যায়বিচারের  প্রায়োগিক দিক নির্দেশ করছে।

যেকোনো পরিস্থিতিতে বিচার পাওয়া মানুষের অধিকার, এটি সাংবিধানিক অধিকার। জুডিশিয়ারির বার্ষিক ক্যালেন্ডার অনুযায়ী, ডিসেম্বর মাসে কোর্ট বন্ধ থাকায় বিচার পাবেন না, এমন পরিস্থিতি ছিল। কয়েক দশকের এই অচলায়তন ভাঙা হয় জনস্বার্থ মামলার মাধ্যমে। দশকের পর দশক আমাদের এমন ছিল দেওয়ানি আদালতহীন ডিসেম্বর। আদালতে এখন সিভিল ভ্যাকেশন কোর্ট বিচার পরিচালনা করে থাকেন।

২০০৪ সালে বিরোধী দলের ডাকা জনসভার আগে তিন দিনে ঢাকায় সাত হাজারের বেশি  মানুষকে ডিএমপি অর্ডিন্যান্স ৮৬ ও ১০০ ধারায় গ্রেপ্তার করা হয়। এ ধরনের গণগ্রেপ্তারকে চ্যালেঞ্জ করা হয় দায়ের করা জনস্বার্থে মামলায়। হাইকোর্ট বিভাগ কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া এ ধরনের গ্রেপ্তার না করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নির্দেশ দেন। এই জনস্বার্থ মামলার পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমানে ডিএমপি অর্ডিন্যান্সের অধীনে গ্রেপ্তার কমে গেছে। এ মামলাগুলো ছিল শুরুর দিকের জনস্বার্থ মামলা।

কেবল জনস্বার্থে মামলার সাহায্য নিয়ে বিচার বিভাগীয় প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার সুনিশ্চিত করা সম্ভব নয়। অনাচারক্লিষ্ট আর্থসামাজিক ব্যবস্থা জনস্বার্থ লঙ্ঘনের মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়। তবে মনে রাখতে হবে, নীতিহীনতার বিরুদ্ধে পরিশোধন কেবল আইনি পথে মোকাবিলা করা সম্ভব নয়, এর জন্য চাই মানুষের আন্তরিক সচেতনতা।

জনস্বার্থ মামলার রায়ে আইনের শাসন আরও জোরদার করার ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য প্রতিফলন দেখা যায় না। রায় বাস্তবায়নে অবহেলার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের দায়মুক্তি দেওয়ার প্রবণতা রয়েছে। রাজনৈতিক কারণে যত্রতত্র নীতিগত সিদ্ধান্তের পরিবর্তন হয়। অনেক সময় সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে অযথা সময়ক্ষেপণ ও কম গুরুত্ব দেওয়া হয়। দক্ষ জনবল ও অর্থনৈতিক সক্ষমতার অভাবও এর কারণ।

জনস্বার্থ মামলার রায় বাস্তবায়নে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা, দায়ী ব্যক্তির বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ, নিম্ন আদালতের মামলায় বিচারকদের জনস্বার্থ মামলার বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদানসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। তবে সম্প্রতি সরকার জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট বেশ কয়েকটি আইন প্রণয়ন করেছে। এটা জনগণের কল্যাণে ভূমিকা রাখবে। ভারতের সাবেক প্রধান বিচারপতি ভি আর কৃষ্ণা আইয়ার তাঁর কনস্টিটিউশনাল মিসল্যানি বইয়ে বলেন, বিচার বিভাগের কাজ আইন প্রণয়ন করা নয়, আইনকে বলবৎ করা। জনস্বার্থ রক্ষার জন্য সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্ট যেভাবে বিভিন্ন মামলা গ্রহণ করে রায় দিতে উদ্যোগী হয়েছে, সে বিষয়ে বিচার বিভাগের এই অতিসক্রিয়তা কোটারি স্বার্থের মানুষ সহজে মেনে নিতে পারছে না।

কারখানা বর্জ্যের দূষণে যখন তুরাগে ভেসে উঠে মৃত জলজপ্রাণ আর তীরের মানুষ পেশা হারানোর শঙ্কায়, তখন নদীকে মনে হয় প্রাণসংহারী গরল ধারা, যখন ইটভাটায় পোড়ানো হয় বনের গাছ তখন ভাটাগুলোকে মনে হয় সবুজের শ্মশান, পাহাড়ে আর সমতলের স্বতন্ত্র জনজাতির বাসের আবাস আর চাষের ভূমি যখন ইকোনমিক জোন আর ইকোপার্কের জন্য বরাদ্দ দেয়, তখন মনে হয় এ এক আইনহীনতার ইকোসিস্টেম। তখন পাবলিক ইন্টারেস্ট লিটিগেশনের একেকটি পিটিশন যেন নিমজ্জমান মানুষের অনুচ্চ কথার কিংবা হারানো অধিকারের কোনো হৃদচেরা অভিসন্দর্ভ। আমাদের এই সময়ের তরুণ প্রজন্মকে (আইনজীবীরাও এর অন্তর্ভুক্ত) সিম্বল অব মর্বিডিটি (রুগ্‌ণতার প্রতীক) মনে করা হয় কিন্তু কিছু ভিন্ন চিন্তার আইনজীবী জনস্বার্থ মামলার মাধ্যমে এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে পোয়েটিক জাস্টিস (আদর্শ ন্যায়বিচার) নিশ্চিত করতে চান সব কাঁটা ধন্য করে।

  • এম এম খালেকুজ্জামান আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
    ই-মেইল: adv.mmkzaman@gmail.com