২০২২ সালের ৫ সেপ্টেম্বর যুক্তরাজ্যের কনজারভেটিভ পার্টির সদস্যরা তাঁদের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত করেছেন। লিজ ট্রাস তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী ঋষি সুনাককে বেশ বড় ব্যবধানে পরাজিত করেছেন। গত কয়েক বছরে যুক্তরাজ্যের রাজনীতিতে চীনের প্রাসঙ্গিকতা কমেছে। এই পরিবর্তনটা ঘটে ২০২০ সালে। সে সময় একগাদা সংকট সৃষ্টি হয়েছিল। এতে করে চীনের ভাবমূর্তি সম্পর্কে প্রচণ্ড নেতিবাচক ধারণা জন্ম হয়েছিল। কোভিড-১৯ মহামারির সত্য তথ্য চীন লুকোচ্ছে কি না, সেই ভয় তৈরি হয়েছিল। হুয়াওয়ে মোবাইল সেটের মাধ্যমে গুপ্তচরবৃত্তি করছে কি না সেই উদ্বেগও তৈরি হয়েছিল। এ ছাড়া হংকংয়ের জাতীয় নিরাপত্তা আইন ও চীনের জিনজিয়াং প্রদেশে রাজনৈতিক ‘পুনঃশিক্ষা’ শিবির প্রতিষ্ঠার কারণে ক্ষোভেরও জন্ম হয়েছিল।
২০২০-২১ সালে যুক্তরাজ্য সরকার প্রতিরক্ষা ও বিদেশনীতির ক্ষেত্রে নতুন করে পর্যালোচনা করে। নতুন এই পর্যালোচনায় চীনের দিক থেকে আসা হুমকির (যেমন: গুপ্তচরবৃত্তি, হ্যাকিং) বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়। তবে জলবায়ু পরিবর্তন কিংবা বাণিজ্যের মতো বিষয়ে সম্ভাবনাময় সহযোগিতার ওপর জোর দেওয়া হয়।
নেতৃত্ব নিয়ে প্রতিযোগিতা চলাকালে ঋষি সুনাক প্রথম ঘোষণা দেন চীন হচ্ছে যুক্তরাজ্যের ‘এক নম্বর’ হুমকি। যুক্তরাজ্যে পরিচালিত ৩০টির মতো কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউট বন্ধেরও ঘোষণা দেন তিনি। চীনের পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত ভাষা শেখার এসব প্রতিষ্ঠান চীনের প্রোপাগান্ডা প্রবেশের দরজা বলে মনে করেন অনেকে। প্রতিযোগিতার একেবারে শেষ সপ্তাহে এসে ট্রাস অপ্রত্যাশিতভাবে চীন প্রশ্নে তাঁর শক্ত অবস্থান ঘোষণা করেন। তিনি ঘোষণা দেন, পর্যালোচনার সিদ্ধান্ত তিনি বদলে দিতে চান। চীনের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা যুক্তরাজ্যের জন্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে লাভজনক—এমন অবস্থান থেকে সরে আসার কথা বলেন ট্রাস। তিনি স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেন, রাশিয়ার মতো চীনও যুক্তরাজ্যের জন্য পুরোপুরি হুমকি।
জিনজিয়ানের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘের সদ্য প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, সেখানে বড় ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে মানবাধিকার ও নিরাপত্তাকে রাজনৈতিক বিষয় হিসেবে বেছে নেওয়া নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। কিন্তু যুক্তরাজ্যের চিকিৎসা বিজ্ঞান, বিলাসপণ্য ও বৈধ সেবা খাতে ব্রিটিশ-চীন যৌথ বিনিয়োগের ভবিষ্যৎ কী হবে, তা নিয়ে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছানো জরুরি।
ট্রাস কিংবা ঋষি যাঁর বক্তব্য বিবেচনায় নেওয়া হোক না কেন—চীনকে তীব্র ভাষায় আক্রমণ তাঁরা করেছেন। কিন্তু চীন প্রশ্নে যুক্তরাজ্যের কৌশল কী হবে, তা নিয়ে স্পষ্ট কোনো ধারণা তাঁরা দেননি। চীনের প্রতি যুক্তরাজ্য যদি কঠোর অবস্থানে যায় তাহলে যে পরিস্থিতি তৈরি হবে, তা কীভাবে মোকাবিলা করা হবে, সে সম্পর্কে পরিষ্কার করে কেউ কিছু বলেননি। রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে ট্রাসের অবস্থান অবশ্যই উঁচু স্তরের।
কিন্তু এ অবস্থান খুব কম বিকল্পই সামনে আনে। চীন প্রশ্নে ২০২০ সালের অবস্থান যুক্তরাজ্যের স্বার্থের অনুকূল। কেননা চীনের মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে লন্ডন যেমন কথা বলতে পারে, আবার জলবায়ু সম্মেলনের আয়োজক হিসেবে চীনকে সম্মানিত অতিথির আসনেও বসাতে পারে। এখন যুক্তরাজ্য যদি আনুষ্ঠানিকভাবে রাশিয়ার মতো চীনকে শত্রুদেশ বলে বিবেচনা করে, তাহলে এ ধরনের ভারসাম্যপূর্ণ আচরণ আর করা সম্ভব হবে না।
ট্রাসের সুনির্দিষ্ট অবস্থান কী, তা নিয়ে এখনো ধাঁধা রয়েছে। ডানপন্থীদের জনপ্রিয় ব্লগ ‘কনজারভেটিভ হোম’ একটি অবস্থানপত্র প্রকাশ করেছে। তাতে বলা হয়েছে, ট্রাসের এই বাগাড়ম্বরে পরিকল্পনার ঘাটতি আছে। মধ্যডানপন্থী স্পেক্টাটর ম্যাগাজিন এক প্রতিবেদনে বলেছে, গ্রেটব্রিটেন-চায়না সেন্টারে (জিবিসিসি) সম্ভবত বিদেশি অর্থায়ন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে কেন্দ্রটি বিদেশি তহবিল পেয়ে আসছে। যুক্তরাজ্য-চীনসম্পর্কিত থিঙ্কট্যাংক জিবিসিসি। এর মোট খরচের একটি অংশ যুক্তরাজ্য সরকার বহন করে। বেসরকারি এ ধরনের একটি সংস্থায় সরকারি অর্থায়ন যুক্তরাজ্যের ক্ষেত্রে বিরল।
এখন এমন একমুহূর্ত যখন যুক্তরাজ্য সরকারকে চীন নীতি নিয়ে আরও সক্রিয়ভাবে ভাবা প্রয়োজন। চীন ও যুক্তরাজ্য সম্পর্ক নিয়ে প্রতিষ্ঠিত একটি সংস্থায় এখন যদি অর্থায়ন বন্ধ হয়ে যায়, তবে সেটা হবে যুক্তরাজ্যের জন্য বিব্রতকর। সৌভাগ্যের বিষয় হচ্ছে, চীন প্রশ্নটি এমন একটি বিরল ইস্যু যেটিকে কেন্দ্র করে যুক্তরাজ্যে রাজনীতিতে এখনো মেরুকরণ হয়নি। তবে এর মানে এই নয় যে চীন প্রশ্নে রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে বিভাজন নেই।
যাঁরা মূল্যবোধ ও নিরাপত্তাকে প্রাধান্য দেন আর যাঁরা মনে করেন, ব্রেক্সিট–পরবর্তী যুক্তরাজ্যের সঙ্গে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির সম্পর্ক বজায় রাখা জরুরি—দুই পক্ষের মধ্যে বিভাজন আছে। কিন্তু এই বিভাজন নির্দিষ্ট কোনো দলের অ্যাজেন্ডা হয়নি। কনজারভেটিভ ও লেবার দুই দলেই চীন প্রশ্নে এই বিভাজন রয়েছে। লেবার ও লিবারেল ডেমোক্র্যাটরা প্রধানত অর্থনীতির চেয়ে মূল্যবোধ ও নিরাপত্তার মতো প্রশ্নকে প্রাধান্য দেয়। তারাও ব্রেক্সিট-পরবর্তী অর্থনৈতিক বাস্তবতাকে অস্বীকার করছে না।
জিনজিয়ানের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসংঘের সদ্য প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, সেখানে বড় ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে মানবাধিকার ও নিরাপত্তাকে রাজনৈতিক বিষয় হিসেবে বেছে নেওয়া নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। কিন্তু যুক্তরাজ্যের চিকিৎসা বিজ্ঞান, বিলাসপণ্য ও বৈধ সেবা খাতে ব্রিটিশ-চীন যৌথ বিনিয়োগের ভবিষ্যৎ কী হবে, তা নিয়ে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছানো জরুরি।
যুক্তরাজ্য যদি চীনের ক্ষেত্রে আরও কঠোর অবস্থান গ্রহণ করে তবে লন্ডনকে দীর্ঘমেয়াদি অনেক প্রশ্নের সমাধান করতে হবে। এ বছরের শেষ দিকে যুক্তরাজ্য যদি কমপ্রিহেনসিভ অ্যান্ড প্রগ্রেসিভ অ্যাগ্রিমেন্ট ফর ট্রান্সপ্যাসিফিক পার্টনারশিপে (সিপিটিপিপি) যোগ দেয় তাহলে লন্ডনকে বেইজিং ও তাইপের সঙ্গে সম্পর্কের ধরন বদলাতে হবে। অস্ট্রেলিয়ার নতুন লেবার সরকারের সঙ্গেও নতুন করে সম্পর্ক নির্ধারণ করতে হবে, কেননা আগের কনজারভেটিভদের থেকে বর্তমান সরকারের বিদেশনীতি ভিন্ন। সম্ভবত সবচেয়ে অসাধ্য প্রশ্ন হচ্ছে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন কি যুক্তরাজ্যের নেতৃত্বে কর্তৃত্ববাদবিরোধী শাসনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ জোট গঠন করবে কি না।
মূল্যস্ফীতি, ইউক্রেন যুদ্ধসহ একগাদা চ্যালেঞ্জ এখন যুক্তরাজ্যের নতুন প্রধানমন্ত্রীকে মোকাবিলা করতে হবে। এর মধ্যে চীন প্রশ্ন নিঃসন্দেহে সবার ওপরে থাকবে।
রানা মিত্তার অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ও আধুনিক চীনের রাজনীতিবিষয়ক অধ্যাপক
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ মনোজ দে