স্বাস্থ্য খাতের সত্যিকারের উন্নতির জন্য স্বাস্থ্যব্যবস্থার কাঠামো ও আইনের রূপান্তরমূলক সংস্কার করতে হবে। এর পাশপাশি কাজের সংস্কৃতিতে জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। এসব কাজের ক্ষেত্রে নতুন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন কোন ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবেন তা নিয়ে এই লেখা।
মাননীয় স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণমন্ত্রীকে শুভেচ্ছা। তিনি দেশবরেণ্য চিকিৎসক, সবার শ্রদ্ধার পাত্র। আগামী পাঁচ বছর ১৭ কোটি মানুষের শরীর ও মনে ভালো রাখার দায়িত্ব পেয়েছেন তিনি। তার জন্য যথার্থ এই দায়িত্ব ও সম্মান।
কথায় আছে, ‘হোয়াট ব্রিংস ইউ হিয়ার, উইল নট টেইক ইউ দেয়ার’! কঠোর শোনালেও, নতুন স্বাস্থ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে স্বাস্থ্য খাত আগামী পাঁচ বছর কেমন করবে, সেই হিসাব কিন্তু শূন্য থেকে এবং ভিন্ন মানদণ্ডে শুরু হয়েছে।
আজকের স্বাস্থ্য খাত নিজেই জটিল ও দুরারোগ্য ‘রোগে’ আক্রান্ত। আমি একজন ‘স্বপ্নের-স্বাস্থ্যমন্ত্রী’র অপেক্ষায় আছি, যিনি স্বাস্থ্য খাতকে এই পরিস্থিতি থেকে বের করে আনবেন। যিনি নৈমিত্তিক কাজ দক্ষ আমলাদের হাতে ছেড়ে, একবিংশ শতাব্দীর উপযোগী, আধুনিক, বৈষম্যহীন ও স্বচ্ছ স্বাস্থ্য খাত তৈরির লক্ষ্যে, কারও নির্দেশের অপেক্ষায় না থেকে সংস্কার ও রূপান্তরমূলক সাহসী, নীতিনির্ধারণী ও দিকনির্দেশনামূলক ভূমিকা নেবেন।
স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়েছে, স্বাস্থ্যব্যবস্থার নয়
স্বাধীনতার পর, ধারাবাহিকভাবে জনগণের স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়েছে, এটা অনস্বীকার্য। গড় আয়ু, পুষ্টি, মৃত্যুহার ইত্যাদি প্রায় সব স্বীকৃত সূচকেই এই উন্নতি হয়েছে। কিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যসহ ভারত, নেপাল, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ইথিওপিয়া, মালাউই, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, লাওসসহ সমসাময়িক পৃথিবীর অনেক দেশেই এই উন্নতি হয়েছে। এটা বৈশ্বিক আর্থসামাজিক প্রবণতা(সেক্যুলার ট্রেন্ড)।
বাংলাদেশের জনগণের স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়েছে রেমিট্যান্স, নারীশিক্ষা ও কর্মসংস্থান, খাদ্য উৎপাদন ও যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতি—এই চারের সম্মিলিত প্রণোদনায়। এটা বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রবণতা।
বিশেষ করে গত ৩০ বছরে, স্বাস্থ্যের উন্নয়ন পরিকল্পিতভাবে হয়নি। কারণ, স্বাস্থ্য খাতের নিয়ন্ত্রণ কার্যত কার হাতে ছিল তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এই মোটাদাগের পর্যবেক্ষণের পরিপ্রেক্ষিতে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কাছে আমার প্রশ্ন, বৈশ্বিক ও বাংলাদেশের নিজস্ব আর্থসামাজিক উন্নয়নের প্রবণতা বা অগ্রগতি বাদ দিয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্যমন্ত্রীদের নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত বা কর্মসূচি স্বাস্থ্য খাতের উন্নতিতে কতটুকু প্রত্যক্ষ অবদান রেখেছে?
আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থার কাঠামো এই যুগের অনুপযোগী। ব্যবস্থাপনা সনাতন ও ব্যক্তির প্রভাবে অনেকটাই ভঙ্গুর। স্বতন্ত্র বা বিচ্ছিন্ন সাফল্য উদ্যাপনের চেয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর পুরো মনযোগ থাকতে হবে স্বাস্থ্যব্যবস্থার কাঠামো ও আইনের রূপান্তরমূলক সংস্কারের দিকে। এর পাশপাশি কাজের সংস্কৃতিতে জবাবদিহি নিশ্চিত করার কোন বিকল্প নেই।
নব্বইয়ের পর সাফল্য নেই
১৯৭০ থেকে ’৯০-এর মাঝামাঝি পর্যন্ত পরিবার পরিকল্পনা ও সম্প্রসারিত টিকা কার্যক্রম ছাড়া স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কোনো জনস্বাস্থ্য কর্মসূচি সত্যিকার অর্থে জাতীয় বাস্তবায়নের পর্যায়ে যেতে পারেনি। ডায়রিয়া ও যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির সাফল্যের পেছনে বেসরকারি সংস্থার কার্যকর কর্মকৌশল ও জনসম্পৃক্ততা ছিল মুখ্য।
নব্বই-পরবর্তী সময়ে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের সত্যিকার অর্জন কী? স্থবির হয়ে আছে মোট জন্মহার। প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ পরিবার পরিকল্পনা ব্যবহারকারী বাজার থেকে কিনে সামগ্রী ব্যবহার করেন। মাঠকর্মীরা বাড়ি বাড়ি যান না, ইউনিয়ন সেবাকেন্দ্রগুলো তৈরি হয়েছিল স্বাভাবিক প্রসবসেবার জন্য। সাকল্য ১ শতাংশ প্রসবও এখন সেখানে হয় না।
কমিউনিটি ক্লিনিক একটি প্রয়োজনীয় কাঠামোগত উদ্যোগ। কিন্তু প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র হিসেবে যে ভূমিকায় ক্লিনিকগুলোকে নেওয়া দরকার ছিল (যেমন স্ক্রিনিং, প্রতিরোধমূলক কাজ, কার্যকর রেফারেল), সেই লক্ষ্যে বিনিয়োগ না করে, হাতুড়ে চিকিৎসা ও ওষুধ বিতরণ কেন্দ্রে পরিণত করা হয়েছে। ক্লিনিকগুলো আসলেই স্বাস্থ্য উন্নয়নে কতটুকু ভূমিকা রাখছে তার কোনো বিজ্ঞানসম্মত মূল্যায়ন হয়নি।
নতুন স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সামনে সাফল্যের দীর্ঘ তালিকা হাজির করা হবে। একটু খুঁটিয়ে দেখলেই দেখা যাবে সেগুলো কেবলই চলমান, ‘হচ্ছে’ বা পরিকল্পিত ‘হবে’ বা সীমিত কার্যকারিতার প্রকল্প। এসব প্রক্রিয়ার তালিকা থেকে জনগণের প্রকৃত স্বাস্থ্য উন্নয়নের ‘হয়েছে’- এমন ফলাফল বোধগম্য হবে না। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছালাম কি না, সেই দায়বদ্ধতার জায়গায় নিয়ে যাওয়ার কাজটিই স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে করতে হবে।
সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতা
সংবিধানের ১৫ ও ১৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রের মৌলিক দায়িত্ব পুষ্টি, স্বাস্থ্যসেবা ও জনস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা। স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিশ্চয়ই জানেন, এ দেশের যেকোনো একজন নাগরিকের চিকিৎসার সর্বমোট ব্যয় যদি ১০০ টাকা হয়, তাঁর ৭৪ টাকাই সে নিজের পকেট থেকে দেয়। ব্যক্তিই চিকিৎসাসেবার সিংহভাগ খরচ বহন করছে। তাহলে সংবিধান রাষ্ট্রকে নাগরিকদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার যে দায়িত্ব দিয়েছে, দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রণালয় কি সেই সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করছে?
চিকিৎসা করতে গিয়ে নিম্নবিত্ত পরিবারগুলো সঞ্চয় ভেঙে, ঋণগ্রস্ত হয়ে দারিদ্র্যচক্রে ঢুকে যায়। ‘স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচি’ কেন সারা দেশে চালু হয়নি? অন্তত দরিদ্র মানুষের সুরক্ষার জন্য একটা কার্যকর স্বাস্থ্যবিমা চালু না হলে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা অর্জন কীভাবে হবে—এই প্রশ্নের জবাব মাননীয় মন্ত্রীকে খুঁজতে হবে। আমরা বিশ্বসভায় এ ব্যাপারে কথা দিয়ে এসেছি।
স্বাস্থ্য খাতে অর্থ নাই, কারণ অর্থই অনর্থ
বাজেট আসলেই স্বাস্থ্যমন্ত্রী বুঝবেন এই খাত কত অসহায়, বরাদ্দে কত ব্রাত্য। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে বাজেটের মাত্র ৫ শতাংশ বরাদ্দ, মাথাপিছু ব্যয় বছরে মাত্র ৫১ মার্কিন ডলার, আর স্বাস্থ্য খাতের খরচ জিডিপির মাত্র ২.৬ শতাংশ। সবচেয়ে কম বরাদ্দের দেশগুলোর একটি বাংলাদেশ।
বরাদ্দ চাইলে, অর্থ মন্ত্রণালয় প্রকাশ্যে বলবে, আপনার অর্থ দরকার নেই কারণ আপনি খরচ করতে পারেন না। আর অপ্রকাশ্য কথাটি শুনতে হলে স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে ছদ্মবেশ ধারণ করে এজি অফিসের বারান্দায় হাঁটতে হাঁটতে কান খাঁড়া করতে হবে। তিনি শুনতে পাবেন, সবাই ফিসফিস করে বলছে, ‘এই খাত দুর্নীতিবাজদের দখলে, তাদের টাকা দিয়ে লাভ নেই।’
সেবা দিচ্ছে নিয়ন্ত্রণহীন ব্যক্তি খাত
অধিকাংশ মানুষ স্বাস্থ্যসেবা নেয় মুনাফাভিত্তিক ব্যক্তি খাত থেকে (প্রাইভেট চেম্বার, ক্লিনিক, হাসপাতাল ইত্যাদি)। এই ব্যক্তি খাত কার্যত কোনো নিয়ন্ত্রণেই নেই। না গুণগত মানে, না মুনাফায়, না তথ্য প্রদানে—শূন্য জবাবদিহির মধ্যে বসবাস ও বিচরণ এদের। বেসরকারি হাসপাতালের ৮৪ শতাংশ সন্তান প্রসব হয় সিজারের (অস্ত্রোপচার) মাধ্যমে। অনৈতিক ব্যবসা হয় হাজার হাজার কোটি টাকার। নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ হিসাবে স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে দেখতে হবে, মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো অর্পিত দায়িত্ব পালন করছে কি?
যুক্তরাষ্ট্রে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করে ব্যক্তি খাত। কিন্তু রাষ্ট্র আইনের মাধ্যমে মান নিয়ন্ত্রণ করে ও বিশেষ জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে সুরক্ষা বিমা চালু রাখে। আবার যুক্তরাজ্যে রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম সক্ষম ও বিস্তৃত, যা সবার মানসম্পন্ন সেবাপ্রাপ্তি নিশ্চিত করে। আমাদের সংবিধানের স্পিরিট (চেতনা) দাবি করে, যুক্তরাজ্যের মতো পদ্ধতির কাছাকাছি কিছু একটা। কিন্তু বাস্তবে আমাদের দেশের বিভিন্ন পর্যায়ের সরকারি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলো মাত্র ১৮ শতাংশ মানুষকে স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছে (প্রসবসেবার হিসাবে)। সিংহভাগ সেবা ছেড়ে দেওয়া হয়েছে নিয়ন্ত্রণহীন ব্যক্তি খাতের কাছে। বেসরকারি ক্লিনিকে মৃত্যু হলে কিছুদিন হইচই হয়। স্বাভাবিকভাবে কোনো ক্লিনিক বন্ধ হয় না, লাইসেন্স নবায়নে কোনো সমস্যা হয় না। মন্ত্রণালয়কে কাজের ভান করতে হলেও নিদেনপক্ষে একটা মৃত্যু পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়।
বৈষম্য: প্রদীপের নিচে অন্ধকার
স্বাস্থ্যমন্ত্রী যখনই পরিসংখ্যান দেখতে চাইবেন, তখনই তাঁকে গড়ের গোলকধাঁধার মধ্যে ফেলার চেষ্টা হবে। যেমন মন্ত্রণালয় স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে এই দেখিয়ে মুগ্ধ করতে চাইবে যে, সারা দেশে প্রতিবছর মোট গর্ভবতীর মধ্যে ৯৩ শতাংশ গর্ভকালীন সেবা নেন। অথচ তাঁকে বলা হবে না যে, একই সূচক যদি সবচেয়ে দরিদ্র এক-পঞ্চমাংশের মধ্যে পরিমাপ করেন, তাহলে দেখবেন, মাত্র ৮ শতাংশ গর্ভবতী মানসম্পন্ন গর্ভকালীন সেবা পায়। এরই নাম শুভংকরের ফাঁকি। ‘স্বপ্নের-স্বাস্থ্যমন্ত্রী’ হিসেবে তাই স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কাছে প্রত্যাশা, এই ৯৩ শতাংশ সাফল্যে উদ্বেলিত না হয়ে তিনি নির্মোহভাবে ও সততার সঙ্গে ৮ শতাংশকে ভিত্তিরেখা ধরে কাজ শুরু করবেন।
ঘরেই উদাহরণ, তবু তৈরি হচ্ছে না সক্ষম প্রতিষ্ঠান
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাথমিক কাজ গবেষণা করে জ্ঞান সৃষ্টি করা। প্রতিষ্ঠার পর ২৬ বছরে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কয়টা গবেষণাপত্র ল্যানসেট বা সমমানের সাময়িকীতে ছাপা হয়েছে? স্বাস্থ্য খাতের কোন নীতি, কোন সিস্টেম তৈরিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণালব্ধ জ্ঞান বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে?
এ দেশে বিদ্যমান নিয়ম অনুসারে একবার ডাক্তারি পাস করলে বাকি জীবন আর কোনো মূল্যায়ন পরীক্ষা দিতে হয় না। টাকা জমা দিলেই লাইসেন্স নবায়ন করা যায়। চিকিৎসাসেবার মান নিশ্চিত করতে হলে, বিএমডিসির রূপান্তর ও বিস্তৃতি লাগবে। একই দেশ, কিন্তু বিএমডিসি বা বিএসএমএমইউ কেন বিসিপিএস কিংবা আইসিডিডিআর’বি এর মতো হয় না?
অবকাঠামো ও জনবল প্রতিষ্ঠানের প্রাথমিক ধাপ মাত্র। এর কার্যকারিতা ও সক্ষমতা আপনা-আপনি তৈরি হয় না। এগুলো অর্জন করতে হলে করতে এসব জায়গায় স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে অগ্রাধিকার বিবেচনায় বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
শূন্য সুশাসনে নৈতিকতাও নেমেছে শূন্যে
নতুন স্বাস্থ্যমন্ত্রীর মতো বেশ কিছু নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তি নিরলস পরিশ্রমে, নিঃস্বার্থ মানবতায়, চিকিৎসা, শিক্ষা, গবেষণা ও প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু বাকিরা কেন এদের মতো নয়? কারণ, দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা অদক্ষতা, অনৈতিকতা, ও দুর্নীতির চক্রে আটকা পড়েছে। পুরো ব্যবস্থাকে নষ্ট করে দিয়েছে।
এই দুষ্টচক্র সুস্থ গর্ভবতী নারী এলে, ভয় দেখিয়ে সিজার করে ফেলে। যেখানে কোনো ওষুধের দরকার নেই, সেখানে অ্যান্টিবায়োটিক আর প্রয়োজনহীন পরীক্ষা দিয়ে অসহায় মানুষকে নিঃস্ব করে। নিম্নমানের ওষুধ বাজারে ছাড়ে। অকল্পনীয় দামে যন্ত্রপাতি কেনে। ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি থেকে বিদেশ যাওয়ার টিকিট উপহার নেয়। সরকারি অফিসে নিজের ঘরে বসে থেকেই এনজিওদের কাছ থেকে প্রশিক্ষণের ভাতা নেয়। ঘুষ নিয়ে মানহীন ক্লিনিকের অনুমোদন দেয়। রোগী মারা যাওয়ার পরও ভেন্টিলেটর লাগিয়ে বিল বাড়াতে থাকে। এই তালিকা অনেক দীর্ঘ।
দুর্নীতি এবং অনৈতিকতামুক্ত সমাজ ‘ইউটোপিয়া’ (কাল্পনিক)। কিন্তু মন্ত্রণালয়ে সুশাসনের সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা, ভালো আইন তৈরি ও আইনের সর্বজনীন নিরপেক্ষ প্রয়োগের মাধ্যমে এই দুষ্টচক্রকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করার উদ্যোগ নিতে পারেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী।
তোমারে বধিবে যে, গোকুলে বাড়িছে সে
অতীতের কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে একটি ঝুঁকির ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর আগাম সতর্কতা হওয়া ভালো। কিছু বুঝে ওঠার আগেই স্বার্থান্বেষী আমলা, পেশাজীবীদের বিভিন্ন উপদল এবং শক্তিশালী ঠিকাদারেরা স্বাস্থ্যমন্ত্রীর মনোজগৎ ও কর্মজগৎ দখলের চেষ্টা করবে। মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ, ক্রয়, প্রকল্প প্রণয়ন— ইত্যাদিতে তারা হয়ে উঠতে পারে সক্রিয় ও মন্ত্রীর চেয়েও ক্ষমতাবান।
স্বাস্থ্যতথ্য: ব্যবহারেই কার্যকারিতা
ধাপে ধাপে সুশাসন ফিরিয়ে আনার অপেক্ষাকৃত সহজ একটা টোটকা হচ্ছে, সরকারি-বেসরকারি নির্বিশেষে, ব্যক্তি থেকে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে, চিকিৎসা থেকে ব্যবস্থাপনা পর্যন্ত সব তথ্য সংরক্ষণ ও বিশ্লেষণকে ডিজিটালাইজড ও আন্তসম্পর্কিত করা। স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে তথ্য সংগ্রহ ও ব্যবহার বন্ধ করার এবং সব সিদ্ধান্ত ডিজিটালাইজড তথ্যের বিশ্লেষণে নিতে বাধ্য করার উদ্যোগ নিতে হবে। নয়তো অর্থহীন ও বানানো তথ্য দেওয়া হবে।
নতুন স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে দেখানো হবে কীভাবে মাঠপর্যায় থেকে স্বাস্থ্যকর্মীরা প্রতিনিয়ত তথ্য সংগ্রহ করছে ও তা ডিএইচআইএস প্ল্যাটফর্মে দেখা যাচ্ছে। এতে যেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মুগ্ধ না হন। বরং স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে প্রশ্ন করতে হবে, মন্ত্রণালয়ের কয়টা পরিকল্পনা, বাজেট বা সিদ্ধান্ত সেই তথ্যের বিশ্লেষণের ভিত্তিতে নেওয়া হয়েছে? এর উত্তরট হচ্ছে, শূন্য।
আইনি কাঠামো ও সংস্কার
বিস্তারিত গবেষণা করে আইন কমিশন ২০১৬ সালে স্বাস্থ্য সুরক্ষা আইনের খসড়া তৈরি করেছে। তারপর ২০১৮ সালের সংক্ষিপ্ত খসড়াটি দীর্ঘদিন ঘুমিয়ে আছে। নতুন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মূল গবেষণা ও খসড়াটি পড়ে নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে আলোচনায় বসে, এটিকে পূর্ণাঙ্গ আইন ও প্রয়োজনীয় বিধিমালা প্রনয়নের উদ্যোগ নিতে পারেন। একজন টেকনোক্র্যাট মন্ত্রী হিসেবে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর প্রয়োজন হবে প্রভাবশালী রাজনীতিক, স্বাস্থ্য খাতের বিশেষজ্ঞ ও অংশীজনের সমন্বয়ে একটি শক্তিশালী ‘পলিসি প্রেশার গ্রুপ’ তৈরি করা।
আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থার কাঠামো এই যুগের অনুপযোগী। ব্যবস্থাপনা সনাতন ও ব্যক্তির প্রভাবে অনেকটাই ভঙ্গুর। স্বতন্ত্র বা বিচ্ছিন্ন সাফল্য উদ্যাপনের চেয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর পুরো মনযোগ থাকতে হবে স্বাস্থ্যব্যবস্থার কাঠামো ও আইনের রূপান্তরমূলক সংস্কারের দিকে। এর পাশপাশি কাজের সংস্কৃতিতে জবাবদিহি নিশ্চিত করার কোন বিকল্প নেই।
ইশতিয়াক মান্নান আন্তর্জাতিক সংস্থায় কর্মরত জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ।