ইউএনএইচসিআরের বাংলাদেশ অপারেশনের প্রধান সুম্বুল রিজভি
ইউএনএইচসিআরের বাংলাদেশ অপারেশনের প্রধান সুম্বুল রিজভি

মতামত

রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সঙ্গে স্থানীয় মানুষের সংহতি গড়ে উঠছে

পৃথিবীর ১২ কোটি মানুষ আজ সংঘাত অথবা নিপীড়নের কারণে বাস্তুচ্যুত। কেউ নিজ দেশে আর কেউ দেশের বাইরে। বিশ্বব্যাপী শরণার্থীদের তিন-চতুর্থাংশ আশ্রয় পেয়েছে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোয়।

বাংলাদেশও সে রকম একটি দেশ, যে আশ্রয় দিয়ে যাচ্ছে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে; আর শিগগিরই এই শরণার্থী পরিস্থিতির সাত বছর পূর্ণ হবে।

জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্রান্ডির ভাষায়, এই বাস্তুচ্যুতির একটি বড় কারণ ‘সংঘাতের সমাধানে কিংবা নতুন সংঘাত প্রতিরোধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ব্যর্থতা’।

২০১৭ সালে বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে নিপীড়িত এক জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় দিয়েছিল। কক্সবাজারের উদার সাধারণ জনগণ খাবার, পরনের কাপড়, থাকার জায়গা দিয়েছিল এই দুর্দশাগ্রস্ত মানুষগুলোকে; আর এরপর এতে যোগ দেয় জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর, জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা ও এনজিওগুলো।

কিছু শরণার্থী পরিস্থিতি হয় ১৯৭১ সালের মতো স্বল্পায়ু, আবার কিছু হয় লম্বা সময় ধরে। রোহিঙ্গারা নিজ দেশে ফেরার জন্য আকুল হয়ে থাকে, কিন্তু নিরাপত্তার অভাবে যেতে পারছে না।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, বিশেষ করে আঞ্চলিক সংগঠনগুলোকে অবশ্যই এ সংকটের একটি রাজনৈতিক সমাধান খুঁজতে কাজ করতে হবে।

তার আগপর্যন্ত রাষ্ট্রগুলো মানবতা ও সংহতি প্রদর্শন করতে পারে রোহিঙ্গাদের সুরক্ষা ও সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে।

সংকটের সাত বছর পর আমরা রাখাইনের ক্রমবর্ধমান সংঘাত দেখে শঙ্কিত। রোহিঙ্গারাও অপেক্ষা করছে কখন এই যুদ্ধ শেষ হবে, আর তারা শান্তিতে নিজ দেশে স্বেচ্ছায় ফিরতে পারবে।

রাখাইনের রোহিঙ্গা ও অন্যান্য বেসামরিক জনগণের জীবন আজ যুদ্ধের কারণে বিপর্যস্ত। রাষ্ট্রহীন এই রোহিঙ্গাদের আজ কোথাও যাওয়ার নেই!

গত মাসে ইউএনএইচসিআর মিয়ানমারের প্রতিবেশী দেশগুলোকে আহ্বান জানিয়েছে, যেন তারা বেসামরিক শরণার্থীদের নিরাপদ আশ্রয় দেয় এবং অনিরাপদ পরিস্থিতিতে ফেরত না পাঠায়।

যদিও রোহিঙ্গা পরিস্থিতির চিত্র ১৯৭১ সালের মতো নয়, তবু এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় সে সময়ের কথা, যখন প্রায় এক কোটি বাংলাদেশি ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল—মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়।

নিরাপদ আশ্রয়ের অধিকার সারা বিশ্বেই প্রযোজ্য, যা মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণার আওতাধীন। বহু শতাব্দী ধরে রাষ্ট্রগুলোও দুর্দশাগ্রস্ত মানুষদের নিরাপদ আশ্রয় দিয়েছে, আর তা এ অঞ্চলের বড় একটি ঐতিহ্য।

ঠিক ১৯৭১ সালের মতোই, সহিংসতা ও নিপীড়ন থেকে বাঁচতে মানুষ খুব সাধারণভাবেই নিরাপদ আশ্রয় পেতে চায়।

সুরক্ষার মানে হচ্ছে পালানোর সময় নিরাপত্তা ও আশ্রয় প্রদানকারী দেশে থাকার সময়ে নিরাপত্তা।

আন্তর্জাতিক সীমান্তের দিকে যেতে চাওয়া বেসামরিক জনগণকে ঠেলে বিপদের দিকে পাঠিয়ে দেওয়া, কিংবা বাংলাদেশের শরণার্থীশিবিরে আশ্রয় পেতে চাওয়া মানুষদের জোর করে বিপৎসংকুল স্থানে ফেরত পাঠানো—এগুলো এ অঞ্চলের মানবতা ও আশ্রয় দেওয়ার ঐতিহ্যের সম্পূর্ণ বিপরীত।

২০২২ সাল থেকে খুন, অপহরণ, লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা, শিশুদের ওপর আক্রমণসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিরাপত্তা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে।

এর জন্য দায়ী বিভিন্ন অপরাধী চক্র, যারা নিজের স্বার্থে হতাশায় নিমজ্জিত সাধারণ শরণার্থীদের পরিস্থিতির সুযোগ নিচ্ছে। শিক্ষা ও জীবিকামূলক কর্মকাণ্ডের সম্ভাবনা ক্ষীণ থাকায় তরুণ শরণার্থীদের লোভ দেখিয়ে বা জোর করে বিপথে নিয়ে যাচ্ছে এসব চক্র।

সীমানার ওপারের সংঘাতও ক্যাম্পের নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে আরও সঙিন করে তুলছে।

রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সুরক্ষায় জাতিসংঘ ও এনজিওগুলো কাজ করে যাচ্ছে। আর পাশাপাশি ইউএনএইচসিআর যথাযথ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বিভিন্ন ঘটনায় একসঙ্গে কাজ করে। কিন্তু এগুলো যথেষ্ট নয়।

অনিরাপত্তা রুখতে ও ঝুঁকিতে থাকা মানুষদের রক্ষা করতে সবাইকে একসঙ্গে আরও জোরালোভাবে কাজ করতে হবে। রোহিঙ্গাদের ৮০ শতাংশ নারী, শিশু ও বয়স্ক মানুষ অচিন্তনীয় অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছে।

তারা এখন চায় তাদের যেন বিশ্ব ভুলে না যায়, যেন তাদের পরিবেশটি নিরাপদ থাকে। একটি যৌথ শান্তি উদ্যোগের মাধ্যমে সামনে পরিস্থিতির উন্নয়নের আশা পাওয়া যাচ্ছে।

বছরের পর বছর ধরে বিদ্বেষমূলক আচরণ, সহিংসতা, জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের মুখে বেঁচে থাকা রোহিঙ্গাদের অবিশ্বাস্য সাহস দেখে আমি অনুপ্রেরণা পাই।

মিয়ানমার থেকে আসার সময় তাদের বেশির ভাগেরই মৌলিক শিক্ষা ও শহুরে দক্ষতা ছিল না। আজ তারা শিক্ষা, দক্ষতা বৃদ্ধি ও সামাজিক ক্ষমতায়ন কর্মসূচিগুলোতে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী।

নিজ উদ্যোগে তারা অনলাইন কোর্স, ইংরেজি ও কারিগরি প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। নিজেদের ভেতর রক্তদান কর্মসূচি, নারীদের জন্য ক্যাম্প লাইব্রেরি তৈরি, যুবকদের পরিবেশ ভাবনা—এ রকম আরও অনেক কিছু করছে তারা।

রোহিঙ্গারা ধীরে ধীরে নিজেদের জন্য কিছু করার মতো পরিস্থিতি তৈরি করেছে।

মানসিক স্বাস্থ্য কাউন্সেলিং, শরণার্থী নারীদের জন্য স্যানিটারি প্যাড তৈরি, ফটোগ্রাফি ও শিল্পের মাধ্যমে শরণার্থীজীবন তুলে ধরা করা, অগ্নিকাণ্ডের সময় আগুন নেভানো, প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে নিজেদের রক্ষা করা—এসব কাজে রোহিঙ্গারা ক্যাম্পে সবার আগে এগিয়ে আসছে।

উখিয়া-টেকনাফের স্থানীয় জনগণের সঙ্গে সুসম্পর্ক গত সাত বছরে রোহিঙ্গাদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে সাহায্য করেছে। তবে দুঃখের বিষয় হলো, গৎবাঁধা নেতিবাচক ধারণা ও গণবিষোদ্‌গারের মাধ্যমে নতুনভাবে রোহিঙ্গাদের ছোট করে দেখানো হচ্ছে।

সব ধরনের সমস্যা, মুদ্রাস্ফীতি, ইয়াবা ব্যবসা, জলবায়ুর প্রভাবসহ সবকিছুর জন্যই রোহিঙ্গাদের দায়ী করা হচ্ছে।

‘রোহিঙ্গা’ শব্দটিকে গালি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। তাদের দেখা হচ্ছে দাগি অপরাধী ও আদিম মানুষের মতো করে

‘রোহিঙ্গা’ শব্দটিকে গালি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। তাদের দেখা হচ্ছে দাগি অপরাধী ও আদিম মানুষের মতো করে।

কিন্তু ইতিহাস আমাদের দেখিয়েছে—শুনতে খুব সাধারণ হলেও—কোনো নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীকে নেতিবাচক ভাষা দিয়ে চিত্রায়ণের ফলাফল বিপজ্জনক হয়।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে সেই ক্ষতি আরও গুরুতর হতে পারে।

আমাদের চ্যালেঞ্জ অনেক। তবে সব মহলের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় আর লক্ষ্য এক রেখে আমরা অনেক বড় বাধা পেরিয়েছি।

২০২৩ সালে যখন অপর্যাপ্ত তহবিলের কারণে রোহিঙ্গাদের খাবারের রেশন ৩৩ শতাংশ কমে যায়, তখন ইউএনএইচসিআর ও মানবিক সংস্থাগুলো ব্যাপকভাবে প্রচারণা চালায়।

কারণ, আমরা জানি, এর ফলাফল অপুষ্টি ও স্বাস্থ্যঝুঁকি থেকে শুরু করে বাল্যবিবাহ, শিশুশ্রম এবং ভয়ানক সাগরযাত্রার মতো সুদূরপ্রসারী হতে পারে।

ফলাফলস্বরূপ, এ বছর বিশ্ব খাদ্য সংস্থা (ডব্লিউএফপি) পর্যাপ্ত তহবিল জোগাড় করতে সক্ষম হয়েছে; তাই জানুয়ারিতে রোহিঙ্গাদের মাসিক খাবারের রেশন ৮ ডলার থেকে ১০ ডলারে এবং পরে এ মাসে ১০ ডলার থেকে ১১ ডলারে বাড়ানো সম্ভব হয়েছে।

২০২৩ সালে যতটুকু তহবিল পাওয়া গিয়েছিল, তা বিশ্বের অন্যান্য শরণার্থী পরিস্থিতির তুলনায় ভালো ছিল। ২০২৪ সালেও রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য তহবিল জোগাড় করতে সবার সহায়তা প্রয়োজন।

বিশ্বব্যাংকের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন তহবিলে কক্সবাজারের স্থানীয় জনগণ ও রোহিঙ্গা শরণার্থীরা আরও উপকৃত হবে। বৃহৎ শরণার্থী জনগণকে আশ্রয় প্রদানকারী উন্নয়নশীল দেশগুলোর সহায়তায় ইউএনএইচসিআর ও বিশ্বব্যাংকের মাঝে রয়েছে একটি সমঝোতা স্মারক। আর এর ভিত্তিতে ৭০০ মিলিয়ন ডলারের সহজ শর্তের ঋণ এ পরিস্থিতিতে অমূল্য। নিজের জনগণের পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের জীবনমান উন্নয়নে সাহায্য করে বাংলাদেশ শরণার্থীদের প্রতি সহমর্মিতা ও সুরক্ষা প্রদানের ইতিহাস অক্ষুণ্ন রেখেছে।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মিয়ানমারের শিক্ষাক্রম চালু হয়েছে কয়েক বছর আগে, আর এখন তা সিনিয়র গ্রেডের জন্যও আস্তে আস্তে চালু হচ্ছে।

প্রায় ৯০ হাজার রোহিঙ্গা শিশু লার্নিং অ্যাসেসমেন্ট পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে। চার বছর আগেও ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের জন্য কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না।

আজ সবার সমন্বিত প্রচেষ্টায় এই শিশুরা বিভিন্ন শ্রেণিতে পড়ছে।

সবার সহায়তায় আরও সম্ভব হয়েছে পুরো শরণার্থীশিবিরের পুনর্বনায়ন। লাকড়ি জোগাড় করার জন্য গাছ কাটা এখন অতীত। দাতাদের অর্থায়নে রোহিঙ্গা স্বেচ্ছাসেবকেরা ক্যাম্পের ঢাল, ছড়ার পাড়, পয়োনিষ্কাশনের নালা ও বন পুনর্গঠন করেছে।

২০২৩ সালে ইউএনএইচসিআর চার রোহিঙ্গা শরণার্থীকে তাদের জনগোষ্ঠীর জীবন বিশ্বের সামনে তুলে আনার জন্য দিয়েছে গৌরবমূলক ন্যানসেন পুরস্কার।

বিশ্বব্যাংকের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন তহবিলে কক্সবাজারের স্থানীয় জনগণ ও রোহিঙ্গা শরণার্থীরা আরও উপকৃত হবে। বৃহৎ শরণার্থী জনগণকে আশ্রয় প্রদানকারী উন্নয়নশীল দেশগুলোর সহায়তায় ইউএনএইচসিআর ও বিশ্বব্যাংকের মাঝে রয়েছে একটি সমঝোতা স্মারক।

আর এর ভিত্তিতে ৭০০ মিলিয়ন ডলারের সহজ শর্তের ঋণ এ পরিস্থিতিতে অমূল্য।

নিজের জনগণের পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের জীবনমান উন্নয়নে সাহায্য করে বাংলাদেশ শরণার্থীদের প্রতি সহমর্মিতা ও সুরক্ষা প্রদানের ইতিহাস অক্ষুণ্ন রেখেছে।

এটি শুধুই সাহায্য নয়; বরং রোহিঙ্গারা একদিন যখন স্থিতিশীল রাখাইনে ফেরত যেতে পারবে আর বাংলাদেশের প্রতিবেশী হবে, তখন তাদের সঙ্গে সৌহার্দ্যমূলক সম্পর্ক বজায় রাখার স্বপ্নের পেছনে একটি বিনিয়োগ।

  • সুম্বুল রিজভি জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআরের বাংলাদেশ অপারেশনের প্রধান।