মতামত

কংগ্রেস কি নিজেকে নতুন করে মেলে ধরতে পারবে

দলীয় পতাকা হাতে কংগ্রেসের কর্মী–সমর্থকেরা
ছবি: রয়টার্স

প্রায় সিকি শতাব্দীর মধ্যে প্রথমবারের মতো চলতি মাসে ভারতের প্রধান বিরোধী দল ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস এমন একজন সভাপতি নির্বাচন করতে যাচ্ছে, যিনি নেহরু-গান্ধী বংশের বা ওই পরিবারের সদস্য নন।

যে পরিবারের সঙ্গে ভারতের ‘প্রাচীনতম দল’টির ইতিহাস অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত, সেই পরিবারের সদস্যরা নেতৃত্বের দৌড়ে যাবেন না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এটি ২০২৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের আগে কংগ্রেস পার্টিকে নিজেকে পুনরুজ্জীবিত করার একটি অনন্য সুযোগ এনে দিয়েছে।

দলের সভাপতির এই পদ পেতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন দুজন প্রার্থী। একজন কংগ্রেসের প্রবীণ নেতা মল্লিকার্জুন খাড়গে এবং অপরজন আমি শশী থারুর।

২০২৪ সালের নির্বাচন সামনে রেখে নেহরু-গান্ধী পরিবারের সদস্যদের সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত কংগ্রেস পার্টির বিষয়ে জনগণের আগ্রহকে পুনরুজ্জীবিত করেছে। এটি দলের অন্তর্দ্বন্দ্ব এবং সর্বশেষ নির্বাচনী পরাজয় থেকে জনমানুষের দৃষ্টিকে বেশ খানিকটা সরিয়ে এনেছে।

দলটির ৯ হাজার প্রতিনিধি যখন ব্যালটের মাধ্যমে তাঁদের সভাপতি নির্বাচন করবেন, ঠিক সে সময় দলটির সাবেক সভাপতি রাহুল গান্ধী দলের দেড় শ দিনের ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’ শীর্ষক জাতীয় ঐক্য পদযাত্রার অংশ হিসেবে কন্যাকুমারী থেকে কাশ্মীর পদযাত্রায় নেতৃত্ব দেবেন।

১৩৭ বছর বয়সী কংগ্রেসের বহুস্তরের একটি বর্ণাঢ্য ইতিহাস রয়েছে। তবে দলটি জাতীয় এবং রাজ্য স্তরে পরপর বেশ কয়েকটি নির্বাচনে পরাজিত হয়েছে এবং এসব পরাজয়ের পর দলটি নিজেকে একটি নতুন মোড়কে খুঁজে পেয়েছে। এ কথা সত্য, দলটি এর আগে একই ধরনের বিপর্যয় থেকে ফিরে আসতে পেরেছে। যেমন ১৯৭৭, ১৯৮৯ এবং ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে পরাজয়ের পর তারা ঘুরে দাঁড়িয়েছিল।

১৯৮৪ সালে তৎকালীন কংগ্রেস নেতা ইন্দিরা গান্ধীর এবং ১৯৯১ সালে রাজীব গান্ধীর মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের পরপরই সাধারণ নির্বাচনে দলটি জয়লাভ করেছিল। কিন্তু ২০১৯ সালের সাধারণ নির্বাচনে দলটির হেরে যাওয়া এবং সভাপতির পদ থেকে রাহুল গান্ধীর সরে দাঁড়ানোর ফলে দলে তিন বছরের দীর্ঘ নেতৃত্ব-সংকট দেখা দিয়েছে।

নতুন নেতাকে বুঝতে হবে ভারতের জনগণ বিজেপির আধিপত্যবাদী এবং ক্রমবর্ধমান বিভাজনমূলক শাসনে ক্লান্ত হয়ে পড়ছে। এ কারণে দেশকে একত্র করতে এবং নিজেকে নতুনভাবে আবিষ্কার করতে কংগ্রেসকে অবশ্যই জাতীয় ঐক্যের পদযাত্রা সফলভাবে শেষ করতে হবে এবং আসন্ন দলীয় সভাপতির নির্বাচনকে একটি সুস্পষ্ট আদর্শিক বিকল্প হিসেবে দেখাতে হবে। ভারতের পাওনা এর একচুলও কম নয়।

এখন সবার মনে প্রশ্ন উঠেছে, কংগ্রেস কীভাবে তার বর্তমান চ্যালেঞ্জগুলো কাটিয়ে উঠতে পারে? এই প্রশ্ন মাথায় রেখেই নতুন সভাপতি নির্বাচনের পাশাপাশি দলটির প্রধান নির্বাহী পর্ষদ ‘কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি’র জন্য নির্বাচন দেওয়া উচিত। দলের নেতৃত্বে কারা থাকবে, তা দলের নীতিনির্ধারক সদস্যদের ঠিক করে দেওয়ার এখতিয়ার দলের ভাবী নেতাদের নেতৃত্বের বৈধতা দিতে সাহায্য করবে। নতুন নেতৃত্ব এলে তা ভোটারদের জাগিয়েও তুলবে। নজির হিসেবে বলতে পারি, যুক্তরাজ্যের কনজারভেটিভ পার্টির সদস্যরা ২০১৯ সালে থেরেসা মের উত্তরসূরি হিসেবে বরিস জনসনকে বেছে নেওয়ার পর টোরিরা ১৯৮৭ সালের পর তাদের সবচেয়ে বড় সংসদীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জিতেছে।

কংগ্রেস পার্টির নেতৃত্বের জন্য আসন্ন নির্বাচনের ফলাফল যা–ই হোক না কেন, আমি বিশ্বাস করি, এটি দলকে পুনরুজ্জীবিত করতে পারে এবং ভারতীয় গণতন্ত্র রক্ষায় তা অবদান রাখতে পারে। যদিও দলের সভাপতি নির্বাচন একটি দলের অভ্যন্তরীণ অনুশীলনের বিষয়। কিন্তু এটি কংগ্রেসকে তার রাজনৈতিক ভিত্তিকে শক্তিশালী করার এবং ব্যাপক জনস্বার্থ নিশ্চিত করায় ভূমিকা রাখার সুযোগ করে দেবে।

 গান্ধী পরিবারের সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত এই সম্ভাব্য রাজনৈতিক হালনাগাদকরণ প্রক্রিয়ার মূল চাবিকাঠি। এই দুই সভাপতি প্রার্থী দল ও জাতির কাছে তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরছেন এবং গণতান্ত্রিক ভোট প্রক্রিয়ায় নিজেদের সঁপে দিয়ে ‘বংশরাজনীতি’র ইতি টানছেন।

তদুপরি, এটি এই সত্যকেও তুলে ধরে যে কংগ্রেস পার্টিতে ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব নির্ধারণের যে প্রক্রিয়া বিদ্যমান আছে, তা অন্য কোনো ভারতীয় রাজনৈতিক দলের মধ্যে নেই। দলের সংবিধান মেনে নেতৃত্ব ঠিক করার মাধ্যমে কংগ্রেস পার্টি অন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে দলের অভ্যন্তরের গণতন্ত্রের সূর্যালোকে পা রাখতে অনুপ্রাণিত করতে পারে।

কংগ্রেসকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনার জন্য নতুন নির্বাচিত নেতাকে নিবেদিতপ্রাণ সমর্থকদের বাইরে সাধারণ ভোটারদের কাছে দলের আবেদন বাড়ানোর উপায় খুঁজে বের করতে হবে। দলটি ২০১৪ এবং ২০১৯ সালের সাধারণ নির্বাচনে গড়ে মাত্র ১৯ শতাংশ ভোট পেয়েছিল এবং ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির কাছে হেরে গিয়েছিল। সেই ঐতিহ্যবাহী দলটিকে জয়ী করার জন্য কংগ্রেস পার্টির দরকার তারুণ্যের শক্তি।

আর দরকার নতুন নতুন আইডিয়া, যা বিজেপি এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কট্টর হিন্দুত্ববাদী মতাদর্শকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে। এর জন্য এমন একজন নেতা দরকার, যিনি তরুণ ভারতীয়দের চাওয়া ও আকাঙ্ক্ষার বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারেন এবং দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন, কংগ্রেসের পক্ষেই দেশকে আরও ভালো জায়গায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব।

একবিংশ শতাব্দীর সুযোগ ভারতকে কাজে লাগাতে সাহায্য করার জন্য কংগ্রেসকে অবশ্যই দেশের ভবিষ্যতের জন্য একটি ইতিবাচক এবং উচ্চাকাঙ্ক্ষী দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করতে হবে। তবে প্রথম দলটিকে অবশ্যই সাংগঠনিক এবং কাঠামোগত সেই ত্রুটিগুলো শনাক্ত করে তা শোধরাতে হবে, যা দলের সাম্প্রতিক নির্বাচনী প্রচারে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। উদাহরণস্বরূপ, রাজ্য নেতাদের হাতে ক্ষমতা অর্পণ করা কংগ্রেসের নতুন নেতাকে কঠিন প্রশাসনিক কাজের ভার থেকে মুক্ত করবে এবং এটি শক্তিশালী স্থানীয় নেতৃত্ব তৈরি করতে সাহায্য করবে। যদিও নতুন নতুন আইডিয়া বাস্তবায়ন করা সহজ হবে না, তবে কংগ্রেস তার ইতিহাসজুড়ে পরিবর্তিত রাজনৈতিক আবহাওয়া ও পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার বিশাল ক্ষমতা দেখিয়েছে।

নতুন নেতাকে বুঝতে হবে ভারতের জনগণ বিজেপির আধিপত্যবাদী এবং ক্রমবর্ধমান বিভাজনমূলক শাসনে ক্লান্ত হয়ে পড়ছে। এ কারণে দেশকে একত্র করতে এবং নিজেকে নতুনভাবে আবিষ্কার করতে কংগ্রেসকে অবশ্যই জাতীয় ঐক্যের পদযাত্রা সফলভাবে শেষ করতে হবে এবং আসন্ন দলীয় সভাপতির নির্বাচনকে একটি সুস্পষ্ট আদর্শিক বিকল্প হিসেবে দেখাতে হবে। ভারতের পাওনা এর একচুলও কম নয়।

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

শশী থারুর ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও জাতিসংঘের সাবেক আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল। বর্তমানে তিনি ভারতের কংগ্রেস পার্টির একজন এমপি