সম্প্রতি সাড়ে চার বছর আগে বুয়েট কর্তৃপক্ষের জারি করা ‘জরুরি বিজ্ঞপ্তি’ স্থগিত করেছেন হাইকোর্ট। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম প্রচার করেছে, বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি করতে কোনো বাধা নেই। কিন্তু ১৯৬১ সালের ‘দ্য ইস্ট পাকিস্তান ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজিক্যাল ইউনিভার্সিটি’ অধ্যাদেশ অনুযায়ী, ছাত্ররাজনীতির নামে ক্যাম্পাসকে অস্থিতিশীল করার অধিকার কারও নেই। অথচ বুয়েটে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রনেতারা কর্তৃত্ববাদী আচরণের মাধ্যমে সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিরাগভাজন হয়েছেন।
শুধু একজন আবরার ফাহাদের হত্যাকাণ্ড দিয়ে পুরো পরিস্থিতি বোঝা যাবে না। দিনের পর দিন একেকজন শিক্ষার্থীকে ছাত্রনেতাদের নির্যাতন সহ্য করে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে হয়। ছাত্ররাজনীতির পক্ষে কেউ কেউ কথা বলেন। কিন্তু তাঁরা এর নিপীড়নমূলক অন্ধকার দিকের কথা বলেন না। জাতির ক্রান্তিলগ্নে শিক্ষার্থীদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ইতিহাসকে ব্যবহার করে কোনো ছাত্রসংগঠনের খবরদারি করার সুযোগ নেই।
বুয়েটসহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতারা ভয়ভীতি ও শক্তি প্রদর্শন করে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেন। তাঁদের মিটিং-মিছিলে যোগ না দিলে রীতিমতো শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালান। নিয়মিত ঘটে চলা এসব ঘটনার খুব অল্প পরিমাণই পত্রিকার সংবাদ হয়। ছাত্রনেতাদের আচরণ ও ভূমিকা কোনো কোনো ক্ষেত্রে ফৌজদারি অপরাধে বিচারযোগ্য।
হাইকোর্টের সাম্প্রতিক আদেশের পর বুয়েটের আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা লিখিত বক্তব্যে বলেন, ‘যে ছাত্ররাজনীতি র্যাগিংয়ের সংস্কৃতিকে প্রশ্রয় দেয়, ক্ষমতার অপব্যবহারের পথ খুলে দেয়, যার বলি হতে হয় নিরীহ শিক্ষার্থীদের, তা আমাদের জন্য ভালো কিছু কখনোই বয়ে আনেনি, আনবেও না।’ তাঁরা দাবি করেন, বুয়েটের শতকরা ৯৮ ভাগ শিক্ষার্থী ছাত্ররাজনীতি চান না।
শিক্ষার্থীরা বুয়েটের মাইক্রোসফট টিমস ফরমের মাধ্যমে একটি জরিপ চালান। জরিপে তাঁরা দুটি ব্যাপার নিশ্চিত করেন—বর্তমান শিক্ষার্থী বাদে যাতে কেউ ফরম পূরণ করতে না পারেন এবং একজন শিক্ষার্থী যাতে একবারই ফরম পূরণ করতে পারেন। এতে দেখা যায়, বর্তমান ৫ হাজার ৮৩২ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ৫ হাজার ৭৩৯ জন শিক্ষার্থীই ছাত্ররাজনীতির বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করেছেন।
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা বলেন, আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বলেছিলেন, বুয়েট মনে করলে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করে দিতে পারে। তখন বুয়েটের সব শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বুয়েট প্রশাসন ‘জরুরি বিজ্ঞপ্তি’র মাধ্যমে সব ধরনের সাংগঠনিক রাজনীতি ক্যাম্পাসে নিষিদ্ধ করেন। এখন ওই বিজ্ঞপ্তি কেন আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না, আদালত তা জানতে চেয়েছেন।
রাজনীতি করা মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি করার পক্ষে আইনি যুক্তি ও আদেশ দেওয়া যেতে পারে। পৃথিবীর অনেক দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও ছাত্ররাজনীতি আছে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, ছাত্ররাজনীতি আর রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি কিংবা ক্ষমতা প্রদর্শন কীভাবে এক হতে পারে?
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২ (আরপিও)-এর ৯০ বি (১) (খ) (iii) অনুযায়ী, রাজনৈতিক দলকে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত হওয়ার সময় তাদের গঠনতন্ত্র থেকে ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক অথবা ছাত্র অথবা আর্থিক, বাণিজ্যিক ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কর্মচারী অথবা শ্রমিক অথবা পেশাজীবীদের সমন্বয়ে গঠিত অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন থাকার বিধান’ বিলুপ্ত করতে হয়। অথচ ক্যাম্পাসের ছাত্ররাজনীতি দেখে মনে হয় না এই ধারার কার্যকারিতা আছে।
আমাদের রাজনৈতিক নেতারা ‘ভ্রাতৃপ্রতিম’ আখ্যায়িত করে ছাত্রসংগঠন পরিচালনা করে আসছেন। তাঁদের কাছে ছাত্ররাজনীতি মানে শিক্ষাঙ্গন দখলে রাখা এবং বিপরীত রাজনৈতিক মতকে দমন করা। কাজটি করার বিনিময়ে ছাত্রনেতারা বিভিন্ন আর্থিক কাজের সুবিধা ভোগ করেন। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগ থেকে শুরু করে উপাচার্য নির্ধারণের ক্ষেত্রেও প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ ভূমিকা রাখেন।
সাম্প্রতিককালে ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে বুয়েটের দুজন শিক্ষার্থীকে পদ দেওয়ার পর প্রশ্ন উঠেছিল।
তখন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি বলেছিলেন, এই দুজন শিক্ষার্থী কেন্দ্রীয় নির্বাহী সংসদের কার্যক্রম পরিচালনা করবে। বুয়েটের অভ্যন্তরীণ ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে তাঁদের সম্পৃক্ততা নেই। আর বুয়েটে অভ্যন্তরীণ রাজনীতি থাকবে কি থাকবে না, সেটা বুয়েট প্রশাসন ও শিক্ষার্থীদের নিজস্ব বিষয়।
ক্ষমতাসীন ছাত্রনেতাদের রাজনীতি করার কৌশল দেখেও বিস্মিত হতে হয়। আন্দোলনের চাপে পড়ে তাঁরা যেমন গা ঢাকা দিতে পারেন, তেমনি অবস্থা বুঝে লাঠি হাতে পেটোয়া বাহিনীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারেন। বুয়েটের মতো অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষার্থীও এ ধরনের রাজনীতির পক্ষে কখনো কথা বলেননি। তাঁরা মনে করেন, ছাত্রসংসদগুলো কার্যকর করা গেলে শিক্ষার্থীদের কাঙ্ক্ষিত রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।
বুয়েটের ছাত্ররাজনীতি থাকা না থাকার চলতি বিতর্কের মধ্যে বেসরকারি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচটি বিভাগে কমিটি ঘোষণা করেছে ছাত্রলীগ। তারা এখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড বাড়ানোর পরিকল্পনা নিয়েছে। এর আগে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়সহ ১৬টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের সাংগঠনিক কমিটি গঠন করেছিল। সে সময় এর বিরোধিতা করেছিল বেশ কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তারা আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছিল, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতির অনুমোদন দেওয়া হবে না।
তখন বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজার হাজার অভিভাবক উদ্বেগ প্রকাশ করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে ই-মেইল করেন। ‘বাংলাদেশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি’ ওই সময় বলেছিল, ই-মেইল করা অভিভাবকের সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়িয়ে যায়। সমিতি দাবি করে, সারা দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪ লাখ শিক্ষার্থীর মধ্যে শতকরা ৯৮ ভাগই ক্যাম্পাসে দলীয় ছাত্ররাজনীতি চান না।
২০১০ সালের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনে ছাত্ররাজনীতির বিষয়ে স্পষ্ট করে কিছু বলা নেই। তবে ছাত্ররাজনীতি না থাকার কারণে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সেশনজট নেই এবং নিয়মিত শিক্ষাকার্যক্রম চলে। এখন নতুন করে সেখানে ছাত্ররাজনীতি চালু হলে শিক্ষাব্যবস্থায় তা কতটুকু নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে, তা সহজেই অনুমেয়।
রাজনীতি করা মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি করার পক্ষে আইনি যুক্তি ও আদেশ দেওয়া যেতে পারে। পৃথিবীর অনেক দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও ছাত্ররাজনীতি আছে। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, ছাত্ররাজনীতি আর রাজনৈতিক দলের লেজুড়বৃত্তি কিংবা ক্ষমতা প্রদর্শন কীভাবে এক হতে পারে?
• তারিক মনজুর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক।