মতামত

চীনে রাস্তায় রাস্তায় বিক্ষোভের পেছনে তবে কি বিদেশি শক্তি?

বিক্ষোভকারীরা দেশের কোভিড নীতির বিরোধিতা করেন এবং সাদা কাগজ উঁচিয়ে ধরে বিক্ষোভ করেন
ছবি : রয়টার্স

কোভিড-১৯ মহামারি মোকাবিলায় চীনের কেন্দ্রীয় সরকারের টাস্কফোর্স স্থানীয় সরকারগুলোকে বাড়াবাড়ি ধরনের পদক্ষেপ না নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। শূন্য কোভিড নীতির কঠোর বিধিনিষেধের কারণে ছড়িয়ে পড়া বিক্ষোভ সেখানে জাতীয় স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে যাতে হুমকি তৈরি করতে না পারে, সে জন্যই গত মঙ্গলবার নতুন এই নির্দেশনা এসেছে।

এরই মধ্যে সাংহাই, ঝেংজু, ছেংডু, হুনানসহ চীনের বড় বড় শহরে সরকারের কঠোর কোভিড নীতির বিরোধিতা করে হাজার হাজার মানুষ প্রতিবাদে নেমে আসে। এরপর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে নতুন এ নির্দেশনা দেওয়া হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিও ফুটেজ থেকে দেখা যাচ্ছে, কিছু প্রতিবাদকারী চীনের কমিউনিস্ট পার্টি ও চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের পদত্যাগ চেয়ে স্লোগান দিচ্ছেন।

কিন্তু অ্যাপল আইফোনের প্রস্তুতকারী শহর ঝেংজুতে লকডাউন শিথিল করার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই স্থানীয় কর্তৃপক্ষ কয়েক শ ভবনের প্রবেশ ফটক বন্ধ করে দেয়। ব্লুমবার্গে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, কোভিডে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকায় পাঁচ দিন আগে দেওয়া লকডাউন মঙ্গলবার রাতে তুলে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এরপর কয়েক শ উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা প্রকাশ করা হয়। সংক্রমণ না কমা পর্যন্ত সেগুলোর প্রবেশপথ বন্ধ থাকবে।

কোভিড মোকাবিলা টাস্কফোর্স স্থানীয় সরকারগুলোকে বলেছে, লকডাউনের প্রভাব জনগণের ওপর যেন না পড়ে। মহামারি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় সরকারের গাইডলাইন মেনে চলতে হবে।

হংকংয়ের বেইজিংপন্থী থিঙ্কট্যাংক পাথ অব ডেমোক্রেসির ম্যাকসিন ওয়ান্টস বিশদ কোনো ব্যাখ্যা না দিয়েই দাবি করেছেন, হংকংয়ের ‘ব্ল্যাক-ক্লাড’ আন্দোলনের কর্মীরা সম্প্রতি ছিঁচকে চোরের মতো গুয়াংডং প্রদেশে প্রবেশ করেন। তাঁরা চীনের মূল ভূমিতে ‘রং বিপ্লব’-এর প্রচারণা চালিয়েছেন। তিনি আরও দাবি করেন, কয়েকজন বিদেশি তরুণ সাংবাদিক চীনের সরকারি কার্যালয়গুলোতে গোয়েন্দাগিরির চেষ্টা করছেন। এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটতে দেখলে পুলিশকে তা জানানোর আহ্বান তিনি করেছেন।

কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র দ্য পিপলস ডেইলি গত মঙ্গলবার জানিয়েছে, বৈশ্বিক মহামারি মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছানোর পর থেকেই চীন কোভিড ও কোয়ারেন্টিন নীতি মেনে চলছে। এটা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটা বিষয়। কোভিড মহামারি মোকাবিলায় ‘চারটি প্রাথমিক কৌশল’ আগামী দিনগুলোতে মেনে চলবে চীন। এগুলো হলো কোভিড রোগী শনাক্তকরণ, তাঁদের আলাদাকরণ, ভাইরাস ছড়িয়ে পড়া প্রতিরোধ এবং সংক্রমণের শিকল যত দ্রুত সম্ভব কেটে ফেলা।

চীনের কলাম লেখকেরা এখন দেশটির জনগণকে উদ্দেশ্য করে প্রোপাগান্ডামূলক নানা লেখা লিখছেন। চীনের সরকার ও কমিউনিস্ট পার্টির ওপর আস্থা রাখার আহ্বান তাঁরা জানাচ্ছেন। বিদেশি শক্তিগুলো চীনের স্থিতিশীলতা বিনষ্টের ষড়যন্ত্র করছে, তাদের কথায় কান না দেওয়ার আহ্বানও জানাচ্ছেন তাঁরা। কোভিড পরীক্ষার কাজে নিয়োজিত কিছু সংস্থা অতিরিক্ত মুনাফার জন্য ভুয়া প্রতিবেদন দিয়েছে, এমন দাবিও করছেন লেখকেরা।

গত ২৪ নভেম্বর চীনের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় জিনজিয়াংয়ের উরুমকি শহরে আবাসিক ভবনে আগুন লেগে ১০ জন নিহত হন। এর প্রতিবাদে বিক্ষোভকারীরা প্রথম রাস্তায় নেমে আসেন। তাঁরা দাবি করেন, স্থানীয় সরকার লকডাউন বা বিধিনিষেধের নামে কড়াকড়ি করেছে। নানা ধরনের অনিয়ম করেছে। এসব কারণে অগ্নিনির্বাপণ ও উদ্ধারকর্মীরা আগুন লাগা ভবনে দ্রুত পৌঁছাতে পারেননি। যদিও লকডাউন কারণে মানুষের মৃত্যু হয়েছে, এমন অভিযোগ স্থানীয় সরকার অস্বীকার করেছে।

ওই দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে চীনের অন্যান্য অনেক শহরে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। বিক্ষোভকারীরা দেশের কোভিড নীতির বিরোধিতা করেন এবং সাদা কাগজ উঁচিয়ে ধরে বিক্ষোভ করেন। বিবিসি জানিয়েছে, স্থানীয় একটি বিক্ষোভের খবর সংগ্রহের সময় এডওয়ার্ড লরেন্স নামের তাঁদের একজন সাংবাদিককে পুলিশ পিটিয়েছে ও গ্রেপ্তার করেছে। কয়েক ঘণ্টা পর অবশ্য তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ঝাও লিজিয়ান বলেছেন, বিবিসির ওই সাংবাদিক মিডিয়া পাস না দেখানোয় তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি আরও বলেন, বিদেশি সংবাদমাধ্যমকে অবশ্যই চীনের আইন মেনে চলতে হবে।

গত সোমবার চীনের সংবাদমাধ্যমগুলোতে একটি নিবন্ধ ব্যাপকভাবে প্রচার করা হয়েছে। এর শিরোনাম ছিল, ‘বিদেশি শক্তি থেকে সাবধান, তারা জনদুর্ভোগ সৃষ্টিতে ইন্ধন দিচ্ছে’। অজ্ঞাতপরিচয় লেখক তাঁর নিবন্ধটিতে লেখেন, চীনের মহামারি নিয়ন্ত্রণের নিয়মনীতি নিয়ে বিদেশি শক্তিগুলো যাতে নেতিবাচক সংবাদ প্রচারের সুযোগ না পায়, সে ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে দেশটির জনগণকে। তিনি আরও লেখেন, চীনের বিশাল জনগোষ্ঠীর তুলনায় চিকিৎসা সরঞ্জাম অপর্যাপ্ত। এ বাস্তবতায় কোভিড রোগী যাতে না বাড়ে, সে কারণেই বিধিনিষেধ শিথিল করতে পারে না চীন। এটা উচ্চ সংক্রমণশীল করোনাভাইরাস এবং বিদেশে তৈরি এমআরএনএ ভ্যাকসিনের দামও অনেক বেশি। তিনি জনগণকে শান্ত থাকতে এবং সংকট সমাধানে সরকারকে আরও সময় দেওয়ার আহ্বান জানান।

একই ধরনের শিরোনামের আরেকটি লেখায় বলা হয়েছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব ও অপতথ্যের বিস্তার ঠেকাতে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোকে ব্যবস্থা নিতে হবে। নাম প্রকাশ না করা এই লেখক বলেন, ১১ নভেম্বর কেন্দ্রীয় সরকার কোভিড নিয়ম শিথিল করতে ২০ দফা বিধি জারি করেছে। সেখানে স্পষ্ট করে বলা আছে, কম ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় স্থানীয় সরকার লকডাউন দিতে পারবে না, ভবনগুলোর প্রবেশপথ বন্ধ করেও দিতে পারবে না। কিন্তু স্থানীয় কিছু সরকার এ নির্দেশনা পালনে ব্যর্থ হয়েছে।

লেখক আরও বলেন, ইন্টারনেটে আসা অসমর্থিত সূত্রের কোনো সংবাদে প্রভাবিত হওয়া নেটিজনদের উচিত নয়। সম্ভবত বিদেশি শক্তির ইন্ধনে কতিপয় স্থানীয় গোষ্ঠী এই সংবাদ প্রচার করছে। তিনি আরও বলেন যে তিন বছর ধরে চীনের বেশির ভাগ জনগণ সরকারের কোভিড নীতি ও কোভিডে আক্রান্ত শনাক্তে গণপরীক্ষার মতো বিষয়গুলো সমর্থন করে এসেছে। কিন্তু অতিমুনাফার লোভে কোভিড পরীক্ষার সঙ্গে যুক্ত কিছু সংস্থা ভুয়া প্রতিবেদন দেওয়ায় জনমনে অসন্তোষ তৈরি হয়েছে।

চীনের প্রভাবশালী জাতীয়তাবাদী বিশ্লেষক সিমা নান তাঁর নিবন্ধে বলেছেন, চীনের জনগণের উচিত, স্থানীয় সরকার ও কোভিড পরীক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে দায়ী করা। পুরো জাতি ও কেন্দ্রীয় সরকারকে তারা দোষ দিতে পারে না। তিনি বলেন, সরকারকে জনগণ তাদের পরামর্শ দিতে পারে। কিন্তু একই সঙ্গে তাদের সতর্ক থাকতে হবে যে কিছু বিদেশি শক্তি গুজব ছড়িয়ে জনমত প্রভাবিত করার এবং চীনে তথাকথিত ‘রং বিপ্লব’ ঘটানোর চেষ্টা করছে। কোনো তথ্য-প্রমাণ ছাড়াই তিনি ইঙ্গিত করেছেন, পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এই অসন্তোষ থেকে সুবিধা নেওয়ার পথ খুঁজছে, সেটা উসকে দেওয়ার চেষ্টাও করছে। তাদের উদ্দেশ্য হলো, চীনের কমিউনিস্ট পার্টির শাসন দুর্বল করা।

হংকংয়ের বেইজিংপন্থী থিঙ্কট্যাংক পাথ অব ডেমোক্রেসির ম্যাকসিন ওয়ান্টস বিশদ কোনো ব্যাখ্যা না দিয়েই দাবি করেছেন, হংকংয়ের ‘ব্ল্যাক-ক্লাড’ আন্দোলনের কর্মীরা সম্প্রতি ছিঁচকে চোরের মতো গুয়াংডং প্রদেশে প্রবেশ করেন। তাঁরা চীনের মূল ভূমিতে ‘রং বিপ্লব’-এর প্রচারণা চালিয়েছেন। তিনি আরও দাবি করেন, কয়েকজন বিদেশি তরুণ সাংবাদিক চীনের সরকারি কার্যালয়গুলোতে গোয়েন্দাগিরির চেষ্টা করছেন। এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটতে দেখলে পুলিশকে তা জানানোর আহ্বান তিনি করেছেন।

  • জেফ পাউ এডিটরস ইন চিফ, এশিয়া টাইমস, লন্ডন
    এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ মনোজ দে