‘আপনি জানেন কি, চিকিৎসায় যক্ষ্মা ভালো হয়?’ —এক সময় রেডিওতে প্রচার করা এই বিজ্ঞাপন-ভাষ্যের মতো করে কিছুক্ষণ আগে পাশের টেবিলের এক সহকর্মী জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি জানেন কি, আজ সংসদের একটি আসনের উপনির্বাচনে ভোট হচ্ছে?’
আমি বললাম, ‘ও মা, তাই নাকি!’
‘যার হয় যক্ষ্মা, তার নাই রক্ষা’—প্রবাদ শুনে বড় হওয়া লোকেরা ‘যক্ষ্মা ভালো হয়’ কথাটা শুনে এক সময় অবিশ্বাসের সুরে চমকে বলত, ‘তাই নাকি!’। সেই ‘তাই নাকি!’ র সঙ্গে আমার ‘তাই নাকি!’ র নাকি মিল পেয়েছেন ওই সহকর্মী।
পরে ওই সহকর্মী নিজেই আমার চমকে যাওয়াকে সমর্থন করে বললেন, ‘১৭ জুলাইয়ের ঢাকা-১৭ উপনির্বাচন নিয়ে আলোচনা ছিল, কারণ সেখানে একজন হিরো আলম ছিলেন। এমনিতেই হিরো আলম ভাইরাল আইটেম, তার ওপর তিনি ভোটের মধ্যেই বেধড়ক মার খেয়েছিলেন। তাই ফেসবুক গরম হয়েছিল। কিন্তু আজকের ভোটে তো সেই চমক নাই।’
সহকর্মী বেঠিক কিছু বলেননি। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় থেকে শুরু করে জাতিসংঘের নজর কাড়া সেই ঢাকা-১৭ আসনের বহুল আলোচিত বিরাট আয়োজনের ভোটেও ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে দেখা যায়নি। বেলা এগারোটার মধ্যেও দু চারজন ছাড়া ভোটার না আসার কারণ হিসেবে একজন প্রার্থী বলেছিলেন, গুলশান এলাকার মানুষ ঘুম থেকে দেরি করে ওঠে বলে ভোটারের উপস্থিতি কম হতে পারে।
তারপর ‘ঘুম থেকে ওঠার’ সময় পার হলো। সারা দিন গেল। ভোট হলো। হিরো আলম জাল ভোট ও ভোট কারচুপির অভিযোগও করলেন। তারপরও ভোট গুনে দেখা গেল, ভোট পড়েছে সাড়ে ১১ শতাংশ। এর আগে এপ্রিলে চট্টগ্রাম-৮ আসনের উপনির্বাচনে ভোট পড়েছিল ১৪ দশমিক ৫৫ শতাংশ।
এই সব দিক বিবেচনা করলে আজ চট্টগ্রাম-১০ আসনে যে উপনির্বাচন হচ্ছে, তা শুনে যে আমার মতো অনেকেরই হয় ‘তাই নাকি’ বলে চমকানোর, নয়তো ‘ও আচ্ছা’ বলে নিতান্ত অনাগ্রহক্লিষ্ট নিস্পৃহ অভিব্যক্তি প্রকাশ করারই কথা।
সহকর্মীর কাছে চট্টগ্রাম-১০ আসনের উপনির্বাচনের কথা শুনে প্রথম আলো অনলাইনের খবর পড়েছি এবং পরে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করছেন—এমন একাধিক সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলেছি।
প্রকাশিত খবরে দেখছি, এই আসনে ভোটকেন্দ্র আছে ১৫৬টি। ভোটকক্ষ আছে ১ হাজার ২৫১টি যার সবগুলোতে ইভিএমে ভোট হচ্ছে। চার প্লাটুন বিজিবি, র্যাবের চারটি টহল দল ও পর্যাপ্তসংখ্যক পুলিশ সদস্য মোতায়েন রয়েছে।
স্থানীয় সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলে যা বোঝা গেল, তার চুম্বক কথা হলো, এই ভোটের বিষয়ে ভোটারদের আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। পাহাড়তলী রেলওয়ে কলোনির মতো যেসব এলাকায় নিম্ন আয়ের লোক বেশি, সেখানে কিছু লোককে ভোট দিতে দেখা গেলেও লালখানের মতো অভিজাত এলাকায় ভোটারের উপস্থিতি একেবারেই কম।
তারপরও যেখানে যেখানে ভোটার ভোট দিতে গেছেন, সেখানকার কোনো কোনো কেন্দ্রে ভোটারকে ভোট দিতে সহায়তা করতে কিছু ‘ভলান্টিয়ার ভাই’ এগিয়ে আসছেন বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। তাঁরা গোপন কক্ষে ঢুকে ভোটারকে ‘সহায়তা’ করছেন।
একটি ঘটনায় দেখা গেছে, ভোটার গোপন কক্ষ থেকে বের হওয়ার পর নৌকা প্রতীকের ব্যাজ পরা এক ব্যক্তি পোলিং এজেন্টকে বলেছেন, ‘মেশিন (ইভিএম) ডিস্টার্ব করছে। তাই ভোটারকে দেখিয়ে দিচ্ছিলাম।’
এমনিতেই উপনির্বাচনের ভোট নিয়ে বেশ কয়েক বছর ধরে দেশবাসীর মধ্যে আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীর বাইরে অন্য কেউ জিততে পারে—এই ধারণা থেকে পাবলিক ক্রমশ সরে এসেছে। তার মধ্যে এখন রাজনৈতিক ডামাডোল চলছে। এই অবস্থায় চট্টগ্রাম-১০ আসনের উপনির্বাচনের খবর নিয়ে ‘কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে’।
এই উপনির্বাচনে মোট প্রার্থী ছয়জন। তবে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মো. মহিউদ্দিনের জয় যে নিশ্চিত সে বিষয়ে কারও মনে কোনো সন্দেহ নেই। যেখানে ভোটের আগেই জয়-পরাজয় সম্পর্কে ভোটারের স্থির বিশ্বাস ঠিক হয়ে যায়, সেখানে তাঁদের ভোট দেওয়ার আগ্রহ থাকার কথা না।
এমনিতেই উপনির্বাচনের ভোট নিয়ে বেশ কয়েক বছর ধরে দেশবাসীর মধ্যে আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীর বাইরে অন্য কেউ জিততে পারে—এই ধারণা থেকে পাবলিক ক্রমশ সরে এসেছে। তার মধ্যে এখন রাজনৈতিক ডামাডোল চলছে।এই অবস্থায় চট্টগ্রাম-১০ আসনের উপনির্বাচনের খবর নিয়ে ‘কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে’।
হৃদয়যন্ত্রের পাশেই থাকে ফুসফুস। মূলত ফুসফুসে ধরে যক্ষ্মা। চিকিৎসায় এখন যক্ষ্মা ভালো হয়।
ভোটারের মনে ভোটসংক্রান্ত অবিশ্বাসের যে যক্ষ্মা বাসা বেঁধেছে, সে ব্যাধি সারাবে কে?
সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
sarfuddin2003@gmail.com