নেত্রকোনা শহরের ভেতর দিয়ে বয়ে গেছে মগড়া নদী। গত চার যুগে দখলে নাব্যতা হারিয়েছে নদীটি। আবর্জনা ফেলায় দূষিত হচ্ছে নদীর পানি ও জীববৈচিত্র্য। একসময়ের প্রাণচঞ্চল মগড়া হয়ে উঠছে নিষ্প্রাণ ও অপরিচ্ছন্ন। শহরবাসী দীর্ঘদিন ধরে এই নদী উদ্ধারের দাবি জানিয়ে আসছেন। তবে কিছু অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ ছাড়া প্রশাসন আর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। মগড়া নদীর অবস্থা কেন এমন হলো এবং নদীটি বাঁচাতে এখন কী করা উচিত, তা নিয়ে লিখেছেন গওহার নঈম ওয়ারা।
প্রায় প্রতিদিনই বজ্রপাতে খেটে খাওয়া গরিব মানুষের মৃত্যুর খবর আসছে। চলতি বছর এ পর্যন্ত মারা গেছেন ৯৫ জন। শুধু মে মাসে (১৮ তারিখ পর্যন্ত) নিহত হয়েছেন ৬৫ জন। বজ্রপাত মোকাবিলায় তালগাছ রোপণের কর্মসূচি স্থগিত রেখে এখন সরকার বজ্রপাত প্রতিরোধক বা লাইটেনিং এরেস্টার স্থাপনের কাজে মন দিয়েছে। সেগুলো দেখতেই এবারের হাওরে যাত্রা।
নেত্রকোনা বাসস্ট্যান্ডে নেমে কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) খামারের পাশ দিয়ে শহরের দিকে যেতে যেতে মনে পড়ে ১৯৭১ সালের কথা। ঢাকা মুক্ত হওয়ার কমপক্ষে এক সপ্তাহ আগে যুদ্ধ করে নেত্রকোনা মুক্ত হয়েছিল। আজকের অনেকেই জানেন না, সেদিন বিএডিসির খামারটা ছিল যুদ্ধক্ষেত্র। পাকিস্তানি বাহিনী আর তাদের দোসররা ময়মনসিংহ হয়ে ঢাকায় যাওয়ার পথটা খোলা রাখার জন্য মরিয়া ছিল খামারের দখল নিয়ে।
ডিসেম্বরের ৮ তারিখে পাঁচ ঘণ্টার সেই অবিরাম যুদ্ধ হয়েছিল নেত্রকোনা শহরের মগড়া নদীর তীর ও বিএডিসির খামার এলাকায়। এই যুদ্ধ নিয়ে খুব একটা আলোচনা আজকাল শোনা যায় না। কেউ মনে রাখেনি ২৮ ও ২৯ আগস্ট মগড়া নদীর পাড়ের যুদ্ধের কথা, সেই যুদ্ধে মগড়া নদীরও একটা ভূমিকা ছিল। মগড়ার অদ্ভুত বাঁকগুলো মদন এলাকার সেই যুদ্ধে দুর্গের কাজ করেছিল।
সেই মগড়ার এখন মরণদশা। লাইটেনিং এরেসটার নয়, মগড়া আমাদের টানতে থাকে আবু জাফরের গানের মতো—‘একবার আয় দেখে যা কেমন আছি।’ অভিমানী সুনীলের কবিতার মতো ‘আমি কীরকম ভাবে বেঁচে আছি তুই এসে দেখে যা নিখিলেশ/ এই কী নদীজন্ম (মানুষজন্ম)? নাকি শেষ/ পুরোহিত-কঙ্কালের পাশা খেলা!...’
মগড়ার উত্থান
ব্রহ্মপুত্র নদ থেকেই মগড়ার জন্ম। সেনেরচরের কাছে খড়িয়া নদীর ধারা থেকেই বেরিয়ে আসে মগড়া নদীর প্রবাহ। সেখান থেকে ময়মনসিংহের ফুলপুর উপজেলার বুড়বুড়িয়া বিলে এসে একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার যাত্রা শুরু হয়েছে।
বুড়বুড়িয়া বিল থেকে বেরিয়ে গজারিয়া ও রাংসা নদীর স্রোতের সঙ্গে মিলিত হয়ে ফুলপুরের ঢাকুয়া এলাকার ভেতর দিয়ে সরাসরি পূর্ব দিকে ধলাই নামে প্রবাহিত হয়েছে। পূর্বধলা উপজেলার হোগলা বাজারের পাশ দিয়ে পূর্বধলা সদরের ভেতর দিয়ে ত্রিমোহনীতে এসে দক্ষিণে প্রবাহিত হয়।
ত্রিমোহনীতে এলে উত্তর দিক থেকে এসে লাউয়ারী নদী তার সঙ্গে মিলিত হয়। মূলত এখান থেকেই এই মিলিত ধারা মগড়া নামে পরিচিতি পায়। এরপর প্রথমে পাঁচ মাইল পর্যন্ত দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়ে দয়াগঞ্জ ঘাট থেকে সরাসরি পূর্ব দিকে এঁকেবেঁকে নেত্রকোনা শহর হয়ে আটপাড়া উপজেলার দিকে চলে গেছে। পশ্চিম দিক থেকে শ্যামগঞ্জ হয়ে দয়াগঞ্জ ঘাটের কাছে মগড়ার সঙ্গে আবার ধলাইয়ের স্রোতোধারার মিলন হয়।
কেন এমন নাম
নেত্রকোনার সন্তান রবীন্দ্রসংগীত আচার্য শৈলজারঞ্জন মজুমদারের সঙ্গে দেখা হওয়ার আগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বোধ করি ভাবতেও পারেননি যে মগড়া কোনো নদীর নাম হতে পারে। রসিক রবীন্দ্রনাথ মজা পেয়েছিলেন নামটি শুনে।
এত দিন তাঁর চেনাজানা নদী ছিল পিয়ালি, জলঙ্গী, ইছামতী, চূর্ণী, চৈতা, রূপনারায়ণ, ময়ূরাক্ষী, অজয়, সপ্তমুখী, রায়মঙ্গল, বিদ্যাধরী, চিত্রা, রূপসা, পদ্মা, গড়াই, মধুমতী আর গঙ্গা। এসব নিরীহ কাব্যিক নামের পাশে মগড়া তাকে কৌতূহলী করে থাকতে পারে।
শৈলজারঞ্জন মজুমদার তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, বাড়ি (নেত্রকোনা) থেকে কর্মস্থলে (বিশ্বভারতী) ফিরলেই রবীন্দ্রনাথ কুশলাদি বিনিময়ের সময় মগড়ার কথা জিজ্ঞাসা করতে ভুলতেন না। তাঁদের কথোপকথনটি এ রকম হতো:
: তোমার নেত্রকোনার নদীর নামটা যেন কী? খালি ভুলে যাই। (ভুলে কি আসলেই যেতেন, না সঠিক উচ্চারণটি শুনতে চাইতেন)
: মগড়া।
: মগড়া মানে কী?
: মগড়া মানে হলো রাগী। যেমন মগড়া ঘোড়া।
: নদীর নাম মগড়া হলো কেন?
বারবার বাঁক নেওয়া মগড়া নেত্রকোনা শহরকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখতে চেয়েছে। অজগর যেমন তার শিকারকে পেঁচিয়ে রাখে। শৈলজারঞ্জনের বর্ণনায় ‘মগড়া’ আর ‘ত্যাড়ামি’ বা ময়মনসিংহের আঞ্চলিকতায় ‘ত্যাকদামি’ সমার্থক। পূর্ব বাংলা এবং নদীয়ায় ঘাড় ত্যাড়ামি বা অবাধ্যতাকে ঘাড় মগড়ামিও বলে।
মগড়া নদী কখনো সোজাভাবে চলেনি। শহর থেকে বেরিয়ে এসেও সে এঁকেবেঁকেই এগিয়েছে, সোজা পথে এক ক্রোশও চলেনি সেখানে। বাঁক নিয়েছে বারবার। সে জন্যই হয়তো এই নদীর নাম হয়েছে মগড়া। শৈলজারঞ্জন মজুমদারের কাছে মগড়ার বর্ণনা শুনেই কি রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন:
‘ওগো নদী, চলার বেগে পাগল-পারা,
পথে পথে বাহির হয়ে আপন-হারা—
আমার চলা যায় না বলা—আলোর পানে প্রাণের চলা—
আকাশ বোঝে আনন্দ তার, বোঝে নিশার নীরব তারা॥’
বর্তমান অবস্থা
একসময় থইথই জল থাকলেও মগড়া এখন কচুরিপানায় ঢাকা এক মৃতপ্রায় জলাভূমি। অনেক জায়গায় পানি আছে নামকাওয়াস্তে। উজান থেকে নেমে আসা ঢলে পলি-বালু জমে নদীটি এখন তার অস্তিত্ব হারাতে বসেছে। বেদখল হচ্ছে নদীর বিভিন্ন অংশ। নদীর কোনো কোনো অংশে ফসলের চারা রোপণ করা হয়েছে। মগড়া এখন রাস্তার পাশে পড়ে থাকা মৃত্যুপথযাত্রী কঙ্কালের মতো।
একজন জানালেন, ‘একসময় সাঁতার কেটেছি, মাছ ধরেছি, মগড়া নদীতে লঞ্চ, মালবাহী বড় লঞ্চ ও ট্রলার চলতে দেখেছি। বর্জ্য আর অব্যবস্থাপনার চাপে নষ্ট দূষিত এই নদীতে সাঁতার কাটা দূরে থাক, পা ধুতেও ইচ্ছা করে না।’
অবশ্য অনেক জায়গায় পা ভেজানোর পানিও নেই। মগড়া সবচেয়ে বেশি লাঞ্ছিত আর জবরদখলের কবজায় পড়েছে, যেখানে জেলার সবচেয়ে ‘শিক্ষিত ভদ্রলোক’দের বসবাস সেখানে। পৌর এলাকার মধ্যে মগড়ার যে পাঁচ কিলোমিটার হিস্যা, সেখানেই নদীকে ‘গুম–খুন আর বন্দী’ করা হয়েছে বেশি।
পৌর এলাকাতেই নদীর প্রশস্ততা কমে গেছে। পৌর এলাকার জায়গার দাম অনেক বেশি হওয়ায় যে এটা হয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। পৌর এলাকায় দখলের প্রতিযোগিতায় ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান যেমন আছে, তেমনি আছেন নতুন–পুরোনো বাসিন্দা। সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পৌর পয়োনিষ্কাশন।
পৌরসভার বেশির ভাগ ড্রেনের ময়লাপানি, মগড়া নদীতে গিয়ে পড়ছে। কালে কালে মগড়া হয়ে উঠেছে ময়লার ভাগাড়। বর্ষাকালে নদীর পানি উপচে ময়লা শহরজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। একসময় এই নদীতে গোসলের জন্য প্রায় ২০টি ঘাট থাকলেও এখন সে পানি হয়ে উঠেছে ব্যবহারের অনুপযোগী।
কেন এমন হলো
জলবায়ু পরিবর্তন, পাশের দেশের কারসাজি এসব বিতর্ক তেমন কাজে আসবে না, অন্তত মগড়া মারার ক্ষেত্রে। মগড়াকে ‘কাফন পরানো হয়’ যখন নদীটির উৎপত্তিস্থল ত্রিমোহনীতে নদীমুখ বন্ধ করে অপরিকল্পিতভাবে পানি উন্নয়ন বোর্ড জলকপাট বা স্লুইসগেট স্থাপন করে। তা ছাড়া আছে পানিপ্রবাহের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না রেখে পূর্বধলা-নেত্রকোনা সড়ক নির্মান।
মগড়ার পানিপ্রবাহ বন্ধের পেছনে এ দুটিই প্রধান কারণ। পাশাপাশি মগড়া নদীর ওপর অপরিকল্পিতভাবে স্থাপন করা হয়েছে বেশ কিছু কম উচ্চতার সেতু। নেত্রকোনার মোক্তারপাড়া, থানার মোড়, আনন্দবাজার মোড়, পুরোনো হাসপাতাল রোড ও চন্দ্রনাথ স্কুলের পশ্চিম পাশে নির্মিত সেতুগুলো ভরা বর্ষাতেও নৌ চলাচলের সুবিধা নিতে পারে না।
মাঝেমধ্যে মগড়াকে মুক্ত করার জন্য ঢাকঢোল পিটিয়ে ‘উচ্ছেদ অভিযান’ চলে। কিন্তু তাতে খুব একটা লাভ হয়নি। অভিযান বন্ধ হয়ে যায় উচ্চ আদালতের ‘স্টে অর্ডারে’।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায় ২০২০ অর্থবছরে নদী প্রশাসন, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও জেলা প্রশাসন সম্মিলিতভাবে নেত্রকোনা পৌরসভা এলাকায় ৩১৬টি অবৈধ স্থাপনার মধ্যে ২৮৩টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে। এর মধ্যে ২৩টি স্থাপনা হাইকোর্টে মামলাজনিত কারণে উচ্ছেদ করা সম্ভব হয়নি। বর্তমানে উচ্ছেদকৃত জায়গাও আবার বেদখল হয়ে গেছে।
উদ্ধারের কি কোন উপায় আছে
স্লুইসগেট–ভিত্তিক নদীমুখ ব্যবস্থাপনা নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। ত্রিমোহনীতে নদীমুখ খুলে না দিলে মগড়াকে বাঁচানো যাবে না। নদীতে ময়লা ফেলা বন্ধ করতে হবে। দখলমুক্ত করতে হবে যেকোনো মূল্যে। আদালতের স্টে অর্ডার নিয়ে স্পষ্টভাবে কথা বলতে হবে এবং পরবর্তী আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। যে আদালত নদীকে জীবন্ত সত্তার স্বীকৃতি দিয়েছেন, তাকে আস্থায় নিতে হবে।
অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন নদীটিকে তার মরণদশা থেকে বাঁচানোর জন্য এক প্রবীণ নাগরিক প্রথম এগিয়ে এসে বলেছিলেন, ‘নদীতে আমি ময়লা ফেলব না, কাউকে ফেলতে দেব না।’
মানববন্ধনের মতো ফটোসেশনমূলক সামাজিক আন্দোলনের পাশাপাশি নদীর সরকার স্বীকৃত অভিভাবকদের সঙ্গে বসে একটা সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা তৈরি করা কি খুবই কঠিন কাজ? যে শহরে সংগ্রামী যতীন সরকারের মতো মানুষ বাস করেন, সেই শহর আর জেলার লোকজন একটা শক্তপোক্ত আন্দোলনের দায়িত্ব নিতে পারছেন না, সেটা ভাবতে আবাক লাগে।
নদী কমিশনের জেলা কমিটিকে একটু হাঁটাচলা করতে হবে। নেত্রকোনার অধিবাসী আর পৌরবাসীরা চাইলেই এগুলোর মাধ্যমে মগড়াকে মুক্তি দিতে পারেন। প্রধান দায়িত্ব নগরবাসীর। ১৮৮৭ সালে প্রতিষ্ঠিত নেত্রকোনা পৌরসভার ‘ক’ শ্রেণিভুক্ত হতে প্রায় ১১০ বছর সময় লাগলেও এখানে উদ্যোগী মানুষের অভাব নেই। মগড়া বাঁচুক মানুষের হাত ধরে।
গওহার নঈম ওয়ারা লেখক ও গবেষক