‘হাইকোর্ট দেখানো’ বলে যে কথাটা চালু আছে, সেটি সাধারণত বোকা বানানো অর্থে ব্যবহৃত হয়। কোটা সংস্কারের ব্যাপারটি আদতে হাইকোর্টের বিষয় ছিল না। কিন্তু বিষয়টা আদালতেই গিয়েছিল।
সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ যে রায় দিয়েছেন, সেখানেও প্রকারান্তরে বলা হয়েছে, এটা আদালতের বিষয় নয়, সরকারের ব্যাপার।
সরকার আন্তরিক হলে ২০১৮ সালে শুরু হওয়া ইস্যুটির শান্তিপূর্ণ সমাধান অনেক আগেই করতে পারত। এত বড় ধ্বংসাত্মক পরিণতির দিকে যেত না বিষয়টি।
একটা কমিশন গঠন করে যৌক্তিকভাবে কোটা সংস্কার করা খুব কি কঠিন ব্যাপার ছিল? কিন্তু বারবার কোর্টের বিষয় বলে সময়ক্ষেপণ করা হয়েছে।
কৌতুকের ব্যাপার হলো, আদালতকেই শেষ পর্যন্ত বলতে হলো, ‘এটা আদালতের বিষয় নয়।’
বিচারালয় একটা পবিত্র জায়গা। কোটা আন্দোলনকারীরাও চাইলে রায় আসা পর্যন্ত ধৈর্য ধরতে পারতেন।
তাহলে সরকারের ঊর্ধ্বতন জায়গা থেকে বারবার বলা হলেও কেন তাঁরা সর্বাত্মক আন্দোলন চালিয়ে গেলেন? কেন তাঁরা সর্বোচ্চ আদালতে আস্থা রাখলেন না?
এর দুটি কারণ হতে পারে।
প্রথমত, যেহেতু সংবিধানে স্পষ্ট করে বলা আছে যে কোটা রাখা বা না–রাখার এখতিয়ার সম্পূর্ণ সরকারের; তাই আদালতে কালক্ষেপণ পছন্দ হয়নি আন্দোলনকারীদের।
দ্বিতীয়ত, আদালতের প্রতি মানুষের আস্থার জায়গা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
প্রথম কারণটি তবু মেনে নেওয়া যায়; কিন্তু দেশের সর্বোচ্চ আদালতে যদি সাধারণ মানুষ আস্থা না রাখতে পারেন, সেটা খুব ভয়ংকর ব্যাপার।
সব বৈষম্য, অনিয়ম, অত্যাচারের বিপরীতে মানুষ যেন আদালতে আস্থা রাখতে পারেন, সেই অবস্থাটা থাকা খুব জরুরি। বিচারব্যবস্থাকে স্বাধীনভাবে চলতে না দেওয়া হলে তা একসময় আত্মঘাতী হয়ে উঠতে বাধ্য।
কোটা আন্দোলনের প্রথম দিকে সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিরোধ চরমে ওঠে একটা স্পর্শকাতর শব্দ ‘রাজাকার’কে কেন্দ্র করে।
কোটা আন্দোলনকারীদের স্লোগান ছিল, ‘চাইতে গিয়ে অধিকার/ হয়ে গেলাম রাজাকার’। অন্যদিকে সরকারপক্ষ দাবি করে, কোটা আন্দোলনকারীরা নিজেদের ‘রাজাকার’ বলেছেন।
যদি সত্যিই শিক্ষার্থীরা নিজেদের রাজাকার বলেও থাকেন, তবু কি তাঁদের ‘শিক্ষা’ দেওয়ার দায়িত্ব ছাত্রলীগের কিংবা আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠনগুলোর ওপর বর্তায়? দেশে আইনকানুন নেই?
এক যুগের বেশি সময় ধরে আমরা দেখেছি, সরকারবিরোধীদের দেশবিরোধী হিসেবে দেখানোর একটা চেষ্টা সব সময়ই থাকে। যদিও দুটি দুই জিনিস এবং তা সম্পূর্ণ আলাদা।
সরকার বিরোধিতা সাংবিধানিক অধিকার আর দেশবিরোধিতা শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
সরকারের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করলে তাঁকে হরেদরে রাজাকার ও দেশবিরোধী বলা একটা গণচর্চায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। কাউকে কারও পছন্দ না হলেই রাজাকার বলে গালি দিচ্ছেন!
এই শব্দের রাজনীতি এমনই চরমে উঠেছে যে খোদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের লোককেও সরকারের বিরোধিতা করে কিছু বলতে হলে প্রথমে উল্লেখ করতে হয় তার পরিবারে কয়জন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, দেশের জন্য তাঁরা কী কী অবদান রেখেছেন ইত্যাদি।
অর্থাৎ তিনি যে অন্য কারও চেয়ে কোনো অংশে কম দেশপ্রেমিক নন, সেটা প্রথমে বলে নিয়ে তারপর কোনো বিষয়ে বিরোধিতা করতে হয়।
নইলে রাজাকার হিসেবে গণ্য হওয়া একরকম অবধারিত। এই যে দেশপ্রেমিক সাজার বাধ্যবাধকতা, এই যে ন্যায্য কথা বলার আগে কৈফিয়ত দেওয়ার পূর্বশর্ত, এটা কোনো সুস্থ চর্চা নয়।
ন্যায্য কথা বলার আগে ভাবতে হবে কেন মানুষকে? মানুষ কেন অপদস্থ হওয়ার আশঙ্কায় আগেভাগে কৈফিয়ত তৈরি করে রাখবেন?
তারপরও কথা থাকে। যদিও রাজাকার কথাটা আমরা ঘৃণার সঙ্গে উচ্চারণ করি, কিন্তু কেউ রাজাকার হলেই তাঁকে পিটিয়ে ‘শিক্ষা দেওয়া’টাও কোনোভাবে জায়েজ হয়ে যায় না।
যদি তেমন হয়, তাহলে দেশে আইনের শাসন আছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে বাধ্য। রাজাকার হওয়া অপরাধ হলে সে সম্পর্কিত আইন থাকতে হবে এবং তার অধীনেই এর বিচার হতে হবে।
বরাবরের মতো এ আন্দোলনেও সরকারের মন্ত্রীদের কথাবার্তায় দায়িত্বশীলতার ঘাটতি ছিল।
দেশে আইন আছে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা আছে; তবু সরকারের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির মন্তব্য ছাত্রসংগঠনকে উসকে দিয়েছেন আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে।
এবারের মূল সংঘাতের সূত্রপাতও তখন থেকেই। তার আগপর্যন্ত শিক্ষার্থীদের আন্দোলন শান্তিপূর্ণভাবে চলছিল।
ছাত্রলীগ যেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ব্যাপক সহিংসতা করে, তার পরদিনই সাধারণ শিক্ষার্থীরা এক জোট হয়ে প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে ছাত্রলীগকে বিতাড়ন করেন।
অথচ এই আন্দোলনে ছাত্রলীগ থাকতে পারত সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাতারে। স্বাধীনতার পর ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এভাবে বের করে দেওয়ার নজির বোধ হয় খুব বেশি নেই এই দেশে।
ছাত্রলীগের মতো ঐতিহ্যবাহী সংগঠনের এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সময় লাগবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার পর যেন সরকারি ছাত্রসংগঠন ও সাধারণ শিক্ষার্থী মুখোমুখি অবস্থান না নেয়, সেটা নিশ্চিত করতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে হবে সরকারকে।
রাজপথে সমস্যা সমাধানের চিত্র তো আমরা দেখলামই, এবার নাহয় সবাই আলোচনার টেবিলে বসুন।
স্বাধীন বাংলাদেশে কোনো আন্দোলনেই কি এত মানুষ মারা গেছেন? সরকার বারবার দাবি করে এসেছে, তারা কোটা আন্দোলনের পক্ষে, কিন্তু এই মৃত্যু তাদের সেই দাবিকে ভীষণভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করে। পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী অন্যান্য বাহিনীর সঠিক প্রশিক্ষণের অভাব রয়েছে মনে করছেন অনেকেই।
কোটা আন্দোলনে পুলিশের ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ। মৃতের সংখ্যা ২১০ ছাড়িয়েছে। হাসপাতালে আশঙ্কাজনক অবস্থায় থাকা মানুষ প্রতিদিনই যুক্ত হচ্ছেন লাশের সারিতে।
স্বাধীন বাংলাদেশে কোনো আন্দোলনেই কি এত মানুষ মারা গেছেন? সরকার বারবার দাবি করে এসেছে, তারা কোটা আন্দোলনের পক্ষে, কিন্তু এই মৃত্যু তাদের সেই দাবিকে ভীষণভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী অন্যান্য বাহিনীর সঠিক প্রশিক্ষণের অভাব রয়েছে মনে করছেন অনেকেই।
এ কারণে তারা আন্দোলনকারীদের ঠেকাতে যে ভূমিকা নিয়েছে, তা অনেক সময় প্রাণঘাতী হয়েছে।
কোটা সংস্কার আন্দোলন মূলত শিক্ষার্থীদের আন্দোলন হলেও এতে ব্যাপক সায় ছিল সাধারণ মানুষের। কারণ, এ আন্দোলন ছিল প্রকৃতই বৈষম্যবিরোধী। বৈষম্যবিরোধিতা মুক্তিযুদ্ধেরই চেতনা।
দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। সরকারি চাকরি পাওয়া কঠিন থেকে কঠিনতর হচ্ছে ক্রমে। নতুন প্রজন্মের একাংশ দেশের বাইরে তাদের ভবিষ্যৎ গড়তে উৎসাহী। সেই অবস্থায় ৫৬ শতাংশ কোটা কোনো স্বাভাবিক ব্যাপার নয়।
কোনো সভ্য দেশে এটা ভাবা যায় না। যাঁদের কোনো কোটা নেই, তাঁদের জন্য চাকরি পাওয়া স্বভাবতই ভীষণ কঠিন। এর ফলে গণমানুষের সমর্থন ছিল আন্দোলনটিতে।
সরকার সাধারণ মানুষের মনোভাব বুঝতে দেরি করেছে। সরকারি সংস্থাগুলো কি তাহলে পর্যাপ্ত তথ্য দিতে ব্যর্থ হয়েছে?
দেশে যখন স্বাভাবিক অবস্থা ফিরতে শুরু করেছে, তার মধ্যেই কোটা আন্দোলনে যুক্তদের নামে নানা জায়গায় মামলা হচ্ছে।
প্রথম আলোর সংবাদ অনুযায়ী, এরই মধ্যে দেশের নানা জায়গায় ৫৫৫টি মামলার খবর পাওয়া গেছে।
রাজধানী ঢাকাতেই মামলার সংখ্যা দুই শতাধিক। এতে অনেক নিরপরাধ মানুষ সমস্যায় পড়তে পারেন।
সরকারকে আন্তরিকভাবে বিষয়গুলো নিয়ে ভাবতে হবে।
আন্দোলনকারীদের শায়েস্তা করার জন্য মামলা না দিয়ে সঠিক তদন্ত করে দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি নিশ্চিত করা সরকারেরই দায়িত্ব।
শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন যাদের প্ররোচনায় এমন সহিংস রূপ নিল, তাদের চিহ্নিত করার দায়ও সরকারেরই। প্রতিটি মৃত্যুর সঠিক তদন্ত না হলে মানুষের ক্ষোভ কমবে না। যাঁদের পরিবারের মানুষ মারা গেছেন, তাঁরা কি সেই ক্ষতি ও ক্ষত কাটিয়ে উঠতে পারবেন কোনো দিন?
আন্দোলনের সুযোগ নিয়ে যাঁরা মেট্রোরেলসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ধ্বংস করেছেন, তাঁদেরও শাস্তি হতে হবে। পাশাপাশি মানুষের ভোগান্তি কমাতে মেট্রোরেলের মতো গণপরিবহন দ্রুত খুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
সরকারের লোকেরা বলছেন, ভাড়া করা লোক দিয়ে এই ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছে। এমনকি তাঁদের নাকি ভাড়াও করা হয়েছে কম টাকায়।
যদি তা–ই হয়, তাহলে মানতে হবে, এখনো এ দেশে অল্প টাকায় জীবনের ঝুঁকি নেওয়ার লোক ঢের আছেন।
সে ক্ষেত্রে সরকার যে উন্নয়নের কথা বলে, সেটাও কিন্তু প্রশ্নবিদ্ধ হয়। অবকাঠামোগত উন্নয়নই একমাত্র উন্নয়ন নয়। যদি প্রকৃতই উন্নয়ন হয়ে থাকে, তাহলে এত কম টাকায় লোক ভাড়া পাওয়া যাবে কেন?
মেহেদি রাসেল কবি ও প্রাবন্ধিক
mehedirasel32@gmail.com