ইরান ও ইসরায়েল দীর্ঘদিন ধরে একটি উত্তেজনাকর অবস্থায় রয়েছে। তাদের মধ্যে একটি শীতল যুদ্ধ চলছে এবং তা ক্রমাগত উত্তপ্ত হওয়ার ঝুঁকিতে আছে। জাতীয়তাবাদকে অপমান করে ইরানের ধর্মীয় শাসকগোষ্ঠী একটি বিশেষ ধরনের ইসলামকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে আসছে এবং তারা তাদের ইমানি মিশনকে অংশত ইসরায়েলের ধ্বংসের প্রয়োজনীয়তা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করেছে।
এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য ইরান গাজা ও লেবানন থেকে শুরু করে সিরিয়া ও ইয়েমেন পর্যন্ত পুরো অঞ্চলে তাদের পোষ্য শক্তি তৈরি করেছে এবং তাদের অস্ত্র সরবরাহ করেছে। তবে সাম্প্রতিক মাসগুলোয় এই প্রক্সি যুদ্ধ ও গোপন অপারেশনগুলো ছাপিয়ে একটি সরাসরি সর্বাত্মক যুদ্ধের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। দুই পক্ষই এই সংঘাতময় মুহূর্তের বিপদের কথা জানে। তারপরও ইরানি শাসকগোষ্ঠী নিজের সম্মান রক্ষার ও অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য তৎপর। অন্যদিকে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে শত্রুর দুর্বলতা কাজে লাগিয়ে আঘাত হানতে আগ্রহী বলে মনে হচ্ছে।
হামাসের ৭ অক্টোবরের সন্ত্রাসী হামলাটি ইসরায়েলের জন্য একটি বেদনাদায়ক মোচড় ছিল। ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি হামাসের সফল অভিযানকে ‘ইহুদিবাদী চক্রের’ আসন্ন পতনের প্রতীক হিসেবে প্রশংসা করেছেন। দেশটির অন্য ধর্মীয় নেতারা এটিকে দ্বাদশ ইমামের আগমনের পূর্বাভাস হিসেবে ঘোষণা করেছেন, যা কিনা মুসলমানদের বিশ্বাসমতে ইসলামের বিশ্বজয় বয়ে আনবে।
অসহায় বেসামরিক নাগরিকদের ওপর ইসরায়েলের চলমান নৃশংস আক্রমণ তাদের দীর্ঘদিনের অমরত্বের ধারণাকে চূর্ণবিচূর্ণ করেছে এবং গাজায় ইসরায়েলের বছরব্যাপী অভিযান ইরানি শাসকদের জন্য একটি প্রোপাগান্ডার খনি হয়ে উঠেছে। ইরানের শাসক ধর্মীয় নেতারা সর্বাত্মক যুদ্ধ চান না। বিশেষ করে হিজবুল্লাহ ও হামাসের মতো তাদের পোষ্য শক্তিগুলো ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়ার পর তাঁরা সর্বাত্মক যুদ্ধের ধারণা থেকে সরে আছেন।
ইরানের প্রভাব বাড়াতে ও তাদের অধিকাংশ সন্ত্রাসী কার্যক্রম সংগঠিত করতে ইরানের আল কুদস নামের যে সংগঠন বড় ভূমিকা রেখেছে, ২০২০ সালে কাসেম সোলাইমানিকে যুক্তরাষ্ট্রের হত্যা করাটা সেই আল কুদস ফোর্সের জন্য একটি বিধ্বংসী আঘাত ছিল। কাসেম সোলাইমানি হত্যার পর থেকে ইরান দেখেছে, কীভাবে ইসরায়েল আরও ইরানি কর্মকর্তাদের, হামাসের শীর্ষ নেতাদের এবং হিজবুল্লাহর নেতাদের হত্যা করেছে।
এই আঘাতগুলো (যেগুলো অনেক সময় সাহসী গুপ্তচরবৃত্তি ও কিলিং মিশনের মাধ্যমে ঘটেছে) দেখিয়েছে, ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ ইরান ও তার প্রক্সি শক্তিগুলোর মধ্যে কতটা প্রবেশ করেছে। ইরান যে ‘প্রতিরোধের অক্ষ’ তৈরি করতে কয়েক দশক সময় ও কোটি কোটি ডলার ব্যয় করেছে, তা এখন ইসরায়েলের অভূতপূর্ব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে। এটি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ইরানের শক্তি প্রদর্শনের ক্ষমতাকে খর্ব করছে।
এই প্রেক্ষাপটে ইরানের শাসক তথা ধর্মীয় নেতারা কঠিন অবস্থার মধ্যে পড়ে গেছেন। দীর্ঘদিনের আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা এবং শাসকদের নিজেদের দুর্নীতি ইরানের অর্থনীতির ওপর প্রভাব ফেলেছে। এর ফলে ব্যাপক অসন্তোষ ও রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে। প্রায়ই নারীদের নেতৃত্বে সাধারণ ইরানিরা সাহসিকতার সঙ্গে সমতা, ব্যক্তিগত স্বাধীনতা এবং দেশের প্রাকৃতিক ও মানবসম্পদের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ জীবনযাত্রার দাবিতে সোচ্চার হচ্ছে।
পশ্চিমের এখনই ইরান নিয়ে একটি কৌশল নির্ধারণ প্রয়োজন। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা দীর্ঘদিন ধরে প্রতিটি উত্তেজনার প্রতিক্রিয়ায় কৌশলগত প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। কিন্তু একমাত্র প্রকৃত সমাধান হলো একটি গণতান্ত্রিক ইরান।
ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া ইরানের শাসনকে আরও অস্থিতিশীল করবে, এমনকি সেটি সরকারের পতনও ঘটাতে পারে। শাসকেরা দেশের ভেতরকার ‘অস্থির মনকে’ ভুলিয়ে রাখতে ‘বাইরের সংঘাতে’ বেশি মনোযোগ দেন বলে যদিও শেক্সপিয়ারের একটি পর্যবেক্ষণ আছে; কিন্তু ইরানের ধর্মীয় নেতাদের পক্ষে শেক্সপিয়ারের সেই পর্যবেক্ষণ পুরোপুরি মানা সম্ভব নয়। কারণ, তাঁরা জানেন, দেশের ভেতরকার জনগণ এমনিতেই গভীরভাবে অসন্তুষ্ট হয়ে আছে।
এ অবস্থায় তাদের বাইরের অন্য একটি সহিংস অভিযানের কারণে সৃষ্ট কষ্ট সহ্য করতে বাধ্য হতে হলে তারা বিদ্রোহ করে বসতে পারে। তা ছাড়া ইরান যেসব পোষ্য শক্তিকে ইসরায়েল, মার্কিন বাহিনী ও অন্যান্য আঞ্চলিক শক্তির (যেমন সৌদি আরব) বিরুদ্ধে ব্যবহার করে, সেগুলোকে কখনো কখনো ঘরোয়া বিক্ষোভ দমন করতেও ব্যবহার করা হয়েছে।
এসব প্রক্সি নেটওয়ার্ক দুর্বল হয়ে যাওয়ায় ইরানের ধর্মীয় নেতারা দ্বিগুণ দুর্বলতা বোধ করবেন। এর ফলে তাঁরা আঞ্চলিক শত্রু ও ঘরোয়া বিরোধীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য মরিয়া হয়ে উঠবেন। তবে তাঁদের সতর্কতার সঙ্গে পদক্ষেপ নিতে হবে। ইরানের সাম্প্রতিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা ইসরায়েলকে ঠেকানোর তাণ্ডবনৃত্যের অংশ ছিল। হামলার পরপরই ইরানের শাসকেরা ঘোষণা করেছেন, তাঁদের ‘প্রতিশোধ’ অভিযান সম্পন্ন হয়েছে। এতে বোঝা যায়, তাঁরা অধিকতর উত্তেজনা এড়াতে চান।
ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে যুদ্ধ বাধলে তা অবশ্যম্ভাবীভাবে যুক্তরাষ্ট্রকে টেনে আনবে। ইরান জানে, তারা এমন একটি সম্মিলিত সামরিক শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারবে না।
নেতানিয়াহুও গুরুতর চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন। দীর্ঘস্থায়ী যেকোনো সংঘাত ইসরায়েলের শক্তি ও সম্পদকে টেনে নামাবে এবং সম্ভবত ব্যাপক হতাহতের কারণ হবে। এমন একটি ব্যয়বহুল যুদ্ধের কারণে ইতিমধ্যেই ইসরায়েল গভীরভাবে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। এটি সরকারের ওপর কী প্রভাব ফেলবে, তা এখনই অনুমান করা কঠিন।
ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র ইসরায়েলের স্বার্থ হাসিলের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে হবে—এ ভাষ্যের ওপর ভিত্তি করে নেতানিয়াহু তাঁর রাজনৈতিক ধারা তৈরি করেছেন। তা সত্ত্বেও তিনি ইরানকে জড়িয়ে এমন একটি পরিণতির দিকে এগিয়ে যেতে পারেন, যাকে তিনি সবচেয়ে বেশি ভয় পান।
পরিস্থিতি এখন এতটাই জটিল যে মনে হচ্ছে, ইসরায়েল আক্রমণের মাত্রা বাড়ালে ইরান আরও বেশি মরিয়া হয়ে নিজেদের একটি পারমাণবিক অস্ত্রসমৃদ্ধ রাষ্ট্র ঘোষণা করে বসতে পারে। ইরান সে ধরনের ঘোষণা দিলে তা আরও বিপজ্জনক যুদ্ধের ক্ষেত্র তৈরি করতে পারে।
খামেনি সব সময়ই ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির প্রধান স্থপতি ছিলেন এবং পশ্চিমারা দীর্ঘদিন ধরে এই বিভ্রমে রয়েছে যে ছাড় ও আপসের প্রতিশ্রুতি ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্রসম্পন্ন রাষ্ট্রের খাতায় নাম লেখানো থেকে ফিরিয়ে রাখতে পারবে।
ইরান দাবি করে আসছে, খামেনি ফতোয়া দিয়েছেন, ইরান সরকার গণবিধ্বংসী অস্ত্র তৈরি করতে পারবে না, তবে তারা শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক কর্মসূচি চালিয়ে যাবে। সরকারের দিক থেকে দাবি করা হয়, তারা খামেনির এই ফতোয়া অনুসরণে বাধ্য।
তবে ইরানের যে নেতারা এত দিন বারবার এ কথা বলে এসেছেন, তাঁরা এখন বলছেন, পারমাণবিক বোমা বানানোর জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছুই তাঁদের হাতে এখন রয়েছে।
এই দৃশ্যপট যে বিশাল ঝুঁকি তৈরি করছে, তা স্পষ্ট। ইরানের দ্রুত বোমা তৈরির চেষ্টা প্রায় নিশ্চিতভাবেই ইসরায়েল ও সম্ভবত যুক্তরাষ্ট্রকে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় আগাম হামলা চালাতে প্ররোচিত করবে এবং সেটি প্রায় নিশ্চিতভাবে একটি বিস্তৃত সংঘাতের সৃষ্টি করবে।
সে ধরনের পরিস্থিতি ইরানের প্রক্সি গোষ্ঠীগুলোকে মার্কিন ঘাঁটি, সৌদি তেলের স্থাপনা, আন্তর্জাতিক নৌপথে চলাচলকারী জাহাজ এবং অন্যান্য লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার জন্য লেলিয়ে দেওয়া হতে পারে। এর ফলে বিভিন্ন অঞ্চল ও বৈশ্বিক অর্থনীতির জন্য ধ্বংসাত্মক পরিণতি নেমে আসবে।
ইসরায়েল ও ইরান উভয়েই একটি সংকটময় অবস্থায় রয়েছে। হামাসের আক্রমণের পর ইসরায়েল তার অমরত্বের মিথকে পুনর্নির্মাণের চেষ্টা করছে। অন্যদিকে ইরান তার পোষ্য শক্তিগুলোর ক্ষতির মুখে আঞ্চলিক প্রভাব বজায় রাখার জন্য লড়াই করছে।
উভয় পক্ষই ভালোভাবে জানে, একটি সর্বাত্মক যুদ্ধ বিপর্যয়কর হবে। তারপরও কেউই পুরোপুরি পিছু হটার অবস্থায় নেই।
পশ্চিমের এখনই ইরান নিয়ে একটি কৌশল নির্ধারণ প্রয়োজন। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা দীর্ঘদিন ধরে প্রতিটি উত্তেজনার প্রতিক্রিয়ায় কৌশলগত প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। কিন্তু একমাত্র প্রকৃত সমাধান হলো একটি গণতান্ত্রিক ইরান।
না ইসরায়েল, না মার্কিন সামরিক বাহিনী ইরানে গণতন্ত্র ফেরাতে পারবে। ইরানের জনগণই তা করতে পারবে এবং সাম্প্রতিক বছরগুলোয় এ বিষয়ে তারা ক্রমবর্ধমানভাবে দৃঢ়প্রতিজ্ঞও হয়েছে।
এখনকার পরিস্থিতিতে বাকি বিশ্বকে ইরানের শাসকদের অগ্রহণযোগ্য আচরণের মুখোমুখি হতে হবে এবং তা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। পাশাপাশি ইরানের মানুষের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষাকে সমর্থন করার জন্য যা করা সম্ভব, তা করতে হবে।
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
আব্বাস মিলানি স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইরানি স্টাডিজ প্রোগ্রামের পরিচালক এবং হুভার ইনস্টিটিউশনের একজন গবেষণা সহকর্মী।