১৯৮৯ সালের ৯ নভেম্বর পতন হয় সমাজতান্ত্রিক সরকারের, পতন হয় বার্লিন প্রাচীরের।
১৯৮৯ সালের ৯ নভেম্বর পতন হয় সমাজতান্ত্রিক সরকারের, পতন হয় বার্লিন প্রাচীরের।

মতামত

বার্লিন প্রাচীর পতনের ৩৫ বছর পর কী ভাবছেন জার্মানির মানুষ

১৯৮৯ সালের নভেম্বর মাস। প্রচণ্ড ঠান্ডা উপেক্ষা করে পূর্ব বার্লিনের রাজপথে নেমে এসেছে অসংখ্য মানুষ। শহরের প্রাণকেন্দ্রে আলেকজান্ডার স্কোয়ারে হাজার হাজার মানুষ গর্জে উঠছে আর স্লোগান দিচ্ছে,‘ভিয়ার সিন্ড দ্যাস ফলক’ অর্থাৎ আমরাই জনগণ।

৭ নভেম্বর ১৯৮৯ ছিল পূর্ব জার্মানের ৪০তম জন্মবার্ষিকী। দিনটি স্মরণে পার্লামেন্ট ভবন প্যালেস দা রিপাবলিকানে সামনে স্থাপিত বড় মঞ্চে রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। বিশেষ অতিথি সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচেভ তার বক্তব্যে পূর্ব জার্মানির রাজনীতির সংস্কারের কথা বললেন।

অনতিদূরে বিক্ষোভকারীরা ‘গর্বি গর্বি’ বলে স্লোগান তোলে। পুলিশ ও গোয়েন্দা পুলিশ এসে বিক্ষোভকারীদের প্রিঞ্ছলাওয়ার বের্গের দিকে সরিয়ে দেয়। গ্রেপ্তার করে হাজারের বেশি মানুষকে। আহত হন কয়েকশ। পরের দিন আবার রাস্তায় নেমে আসে হাজার হাজার মানুষ, যাদের বেশিরভাগই যুবক। ৯ নভেম্বর পতন হয় সমাজতান্ত্রিক সরকারের, পতন হয় বার্লিন প্রাচীরের।

আজ সেই বার্লিন প্রাচীর পতনের ৩৫ বছর। পূর্ব আর পশ্চিমে বিভক্ত বার্লিনের সীমান্ত ঘেঁষে ২৮ বছর ধরে যে শহর আর দেশটি বিভক্ত হয়েছিল, ১৯৮৯ সালের ৯ নভেম্বর হঠাৎ করেই তার পতন ঘটে। এই প্রাচীর পতনের পেছনে ছিল পূর্ব জার্মান সরকারের লাগামহীন কর্তৃত্ববাদ আর তার বিরুদ্ধে জনগণের প্রবল আন্দোলন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী ৪০ বছর পৃথক রাজনীতি আর অর্থনীতি নিয়ে যে জাতি বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল, এখন প্রাচীর পতনের ৩৫ বছর পর ঐক্যবদ্ধ সেই জাতির উপলব্ধি কি?

কেন জার্মানি বিভক্ত হয়েছিল আবার কেন ঐক্যের জন্য মরিয়া হয়ে উঠল, তা জানতে একটু পেছনে যেতে হবে। ১৯৩৯ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল অবধি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ধ্বংসস্তূপ আর মানসিকভাবে বিপর্যস্ত জার্মান জাতি নিজেদের বিভক্তি কোনো সময় চায়নি। তবে নাৎসি হিটলারের জবরদখলের যুদ্ধে ক্ষত-বিক্ষত ইউরোপের দেশগুলো ও তাদের নেতারা সেই সময়কার ফ্যাসিবাদী জার্মান রাষ্ট্রের বিভক্তি ও তাদের ক্ষমতা খর্ব করতে চেয়েছিল।

বার্লিনের প্রাচীর পতনের ৩৫ বছর বা জার্মান জাতির ঐক্যের ৩৪ বছর পূর্তির প্রাক্কালে মানুষের উপলব্ধি কি! অর্থনৈতিক নানা পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, দুই অঞ্চলে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে বেশ কিছু পার্থক্য রয়েছে।

হিটলারের জার্মানি যে মিত্রশক্তির কাছে পরাজিত হয়, তাদের একটি অংশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও ইংল্যান্ড ছিল পুঁজিবাদী দর্শন ও অর্থনীতির ধারক এবং অন্য অংশে সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল সমাজতান্ত্রিক দর্শন ও অর্থনীতির ধারক। জার্মান জাতির পরাজয়ের পর, জার্মানি ভাগের মাধ্যমে দুটি অর্থনৈতিক এবং সামাজিক ব্যবস্থা চালু হয়েছিল—পশ্চিমে পুঁজিবাদ ও পূর্বে সমাজতন্ত্র। আর দুই জার্মানি তাদের পুঁজিবাদী ও সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ধারা নিয়েই এগিয়ে যাচ্ছিল।

আশির দশকের শেষে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্ভাচেভের শুরু করা গ্লাসনস্ত ও পেরেস্ত্রোইকা কর্মসূচির হাত ধরে পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে অধিকতর গণতন্ত্র ও নাগরিক অধিকারের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়। সেই আন্দোলনের ঢেউ লাগে সাবেক পূর্ব জার্মানিতেও। ১৯৮৯ সালের ৯ নভেম্বর পূর্ব জার্মানির কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদকমণ্ডলীর মুখপাত্র গুন্টার শাবলস্কি পূর্ব জার্মানির নাগরিকদের পশ্চিম বার্লিনে যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার ঘোষণা দেন।

সেইদিন সন্ধ্যায়, হাজার হাজার মানুষ বার্লিন প্রাচীর সংলগ্ন এলাকায় সমবেত হয়। সরকারিভাবে নির্দেশ না দেওয়া সত্ত্বেও সীমান্ত প্রহরীরা সীমান্ত খুলে দেয়। পূর্ব থেকে হাজার হাজার মানুষ পশ্চিম বার্লিনে প্রবেশ করে। মুক্তির এই বাঁধভাঙ্গা আনন্দে অনেকে কাঁদতে থাকেন।

তৎকালীন পশ্চিম জার্মান সরকার পূর্ব জার্মানিতে দ্রুত ঘটে যাওয়া এ সব ঘটনায় হতবাক হয়েছিল আর জার্মানির পূর্বাঞ্চলের জনগণ খুব শিগগির দুই জার্মানির পুনঃএকত্রীকরণের ব্যাপারে মরিয়া হয়ে ওঠে। শেষ পর্যন্ত মিত্রদেশগুলো এবং পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানির নেতাদের ধারাবাহিক আলোচনার পর ১৯৯০ সালের ৩ অক্টোবর দুই জার্মানি একীভূত হয়। সেই সময় জার্মানির চ্যান্সেলর হেলমুট কোহল বলেছিলেন, ‘জার্মান জাতির গৌরব করার তেমন কিছু নেই। তবে বার্লিন প্রাচীরের পতন ও জার্মান জাতির একত্রীকরণ নিয়ে আমরা গর্বিত।’

একত্রীকরণের সেই উল্লাস আর আবেগ এখন নেই। তাদের অনেকের দৃষ্টিতে, তারা পশ্চিম জার্মানদের দ্বারা তৈরি সমাজ ও রাজনীতির শিকার এবং তাদের অনেকেই নিজেদের প্রান্তিক নাগরিক বলে মনে করেন। ৩৪ বছর আগে পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্য পুনঃএকত্রীকরণ ঘটলেও দুই অঞ্চলের মধ্য কিছু বিভেদ রয়েছে।

সাবেক পশ্চিম জার্মানিতে ১৯৪৯ সাল থেকেই এক ধরনের সামাজিক-অর্থনৈতিক বাজার কাঠামো ছিল। সমাজতান্ত্রিক দেশ না হয়েও মানুষের মৌলিক চাহিদা যেমন আবাসন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বিদ্যুৎ, জ্বালানি—এসব সেবার ক্ষেত্রে নিশ্চয়তা বজায় ছিল, যা এখনও রয়েছে।

আর সাবেক পূর্ব জার্মানি বা পূর্বাঞ্চল ছিল সমাজতান্ত্রিক ও সাম্যবাদী কাঠামোর রাষ্ট্র। গত ৩৩ বছরে পূর্বাঞ্চলের অর্থনীতি-আইন, প্রশাসন, রাস্তাঘাট, শিল্প প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাব্যবস্থা—সবকিছুর আমূল পরিবর্তন ঘটেছে।

বার্লিনের প্রাচীর পতনের ৩৫ বছর বা জার্মান জাতির ঐক্যের ৩৪ বছর পূর্তির প্রাক্কালে মানুষের উপলব্ধি কি! অর্থনৈতিক নানা পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, দুই অঞ্চলে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে বেশ কিছু পার্থক্য রয়েছে। তবু ১০ বছরের বেশি সময় ধরে জার্মানির অর্থনীতি ক্রমেই ঊর্ধ্বমুখী হচ্ছে। সাবেক পূর্ব জার্মানির পুনর্বাসন ও উন্নয়নের ধারাকে এগিয়ে নিয়ে এই অর্জন বিস্ময়কর। তবু পূর্বাঞ্চলের মানুষের আক্ষেপের কথা মনযোগ দিয়ে শোনা জরুরি।

গত ৩ অক্টোবর জার্মান পুনঃঐক্যের ৩৫ বছর পূর্তিতে জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎস বলেন, বিগত ৩৪ বছর পরেও জার্মান ঐক্য এক অর্থে সম্পূর্ণ নয়। তিনি সবাইকে সতর্ক করে বলেন যে পূর্বের জনগণের জন্য পুনর্মিলনের যে নেতিবাচক পরিণতি তা ভুলে গেলে চলবে না।

ওলাফ শলৎস পূর্ব ও পশ্চিমে আরও সমতা আনার পক্ষে কথা বলেন। তবে পূর্ব অঞ্চলের  রাজ্যগুলোয় সাম্প্রতিককালে কট্টরবাদীদের আস্ফালনের বিষয়ে সতর্ক করে বলেন, এই অঞ্চলের এক তৃতীয়াংশ ভোটার যদি কর্তৃত্ববাদী ও উগ্র রাজনীতিকে বেছে নেয় এবং উদার গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করে তা সমগ্র দেশের জন্য বিপর্যয়কর এবং ক্ষতিকর।

তিনি চার দশক ধরে বিভক্ত এবং সম্পূর্ণ ভিন্ন সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কাঠামোকে একত্রিত করার চ্যালেঞ্জকে গ্রহণ করে জার্মানি এগিয়ে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেন।

৩৫ বছর আগে ৯ নভেম্বর ছিল সেইদিন, যেদিন পুঁজিবাদ আর সমাজতন্ত্রের সব রক্তচক্ষু, আইনের বেড়াজাল শিথিল ও ম্লান হয়ে যায় জার্মানবাসীর মহামিলনে।

  • সরাফ আহমেদ
    প্রথম আলোর জার্মানি প্রতিনিধি
    sharaf.ahmed@gmx.net