সংযমের মাস পবিত্র রমজান প্রায় এসেই গেল। রমজানে নিত্যপণ্যের দাম যাতে না বাড়ে, সে জন্য সরকারের কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার কথা শোনা যাচ্ছে। আবার কিছু পদক্ষেপ নিতে দেখাও যাচ্ছে। ব্যবসায়ীদেরও সতর্ক করা হচ্ছে, তাঁরা যেন পণ্য মজুত করে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি না করেন।
সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে এমনও বলা হয়েছে, মজুতের প্রমাণ পাওয়া গেলে কোনো ক্ষমা নেই, ঠিকানা হবে সরাসরি ‘শ্রীঘর’।
সরকারের মন্ত্রী ও আমলারা বলছেন, রমজানের পণ্য যা দেশে আছে এবং বিদেশ থেকে আমদানি হয়ে খালাসের অপেক্ষায় রয়েছে, তাতে সংকট হওয়ার কারণ নেই। এরই মধ্যে চাল, ভোজ্যতেল, চিনি ও খেজুরের ওপর আমদানি শুল্ক কমানোর নির্দেশ দিয়েছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। তবে এই চার পণ্যের ওপর শুল্ক কতটা হারে কমানো হবে, আর বাজারে পণ্যমূল্যে এর প্রভাব কতটা পড়বে, কবে পড়বে, সেটা আপাতত একটা ‘জিজ্ঞাসাচিহ্ন’ হয়ে থাকছে।
জরুরি কথা হলো, মানুষ সাধারণত রমজানের বাজার একটু আগেই সেরে নিতে পছন্দ করেন। কিন্তু এবার সাধারণ মানুষের পক্ষে তা কতটা সম্ভব হবে? কারণ বেশির ভাগ পণ্যের দাম তো আগেই বেড়ে মাথায় চড়ে আছে।
অতি সম্প্রতি খাদ্য অধিদপ্তর সারা দেশে মজুতবিরোধী অভিযান পরিচালনা করেছে। কিন্তু এতে বিশেষ কোনো ফল হয়েছে কি? কোনো কোনো চালের দাম ১০ দিনের ব্যবধানে কেজিতে ১০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে অভিযানের অভিঘাতে এক টাকা, দেড় টাকা কমেছে। একে কি কমা বলে?
এ প্রশ্ন করেছেন দিনাজপুর শহরের একজন রিকশাচালক। যিনি দাম কমার খবরে অতি সম্প্রতি চাল কিনতে শহরের বাজারে এসেছিলেন। বাজারে তাঁর সঙ্গে দেখা হয় প্রথম আলোর জেলা প্রতিনিধির। তাঁর কাছেই তিনি এ অনুযোগ করেছেন।
সংযমের মাস রমজানে ভোগ না কমে বরং বেশ কিছুটা বাড়ে, এটা মূল্যবৃদ্ধির একটি কারণ হতে পারে। চাহিদা বেশি হলে বাজারে পণ্য সরবরাহ স্বাভাবিক থাকার পরও দাম বাড়ে। মানে বাড়ানো হয়। এটা সম্পূর্ণ আমাদের ব্যবসায়ীদের অতিলোভের মানসিকতার কারণ। তখন তাঁদের মনে কোনো নীতিনৈতিকতা কাজ করে না। একটাই চিন্তা—যত পারো এই এক মাসে কামিয়ে নাও।
আসুন, প্রিয় পাঠক, আমরা পুরো বিষয়টা একটু অন্যভাবে আলোচনা করার চেষ্টা করি। পণ্য সরবরাহ যদি ঠিক থাকে, তবে রমজানে কেন দাম বাড়বে বা বাড়ে? এটা খুবই সাধারণ প্রশ্ন।
সংযমের মাস রমজানে ভোগ না কমে বরং বেশ কিছুটা বাড়ে, এটা মূল্যবৃদ্ধির একটি কারণ হতে পারে। চাহিদা বেশি হলে বাজারে পণ্য সরবরাহ স্বাভাবিক থাকার পরও দাম বাড়ে। মানে বাড়ানো হয়। এটা সম্পূর্ণ আমাদের ব্যবসায়ীদের অতিলোভের মানসিকতার কারণ। তখন তাঁদের মনে কোনো নীতিনৈতিকতা কাজ করে না। একটাই চিন্তা—যত পারো এই এক মাসে কামিয়ে নাও।
গত জুন (২০২৩) মাসের কথা আমরা ভুলে যাইনি। পেঁয়াজের দাম তখন কেজিতে শতক ছুঁয়েছে, সরকার আচমকা পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি দিল। সুড়সুড় করে গুদাম থেকে পেঁয়াজ বের হতে লাগল। পাইকারিতে ৩০ টাকা আর খুচরায় ১৫ থেকে ২০ টাকা দাম কমে গেল। এই হলেন আমাদের ব্যবসায়ীরা!
এসব ব্যবসায়ীকে শায়েস্তা করতে পারে সরকার ও সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী সমিতি। সরকারের পক্ষ থেকে ভ্রাম্যমাণ আদালত কখনো কখনো এসব ব্যবসায়ীকে জরিমানা করেন। সেই সব ভিডিও আমরা সোশ্যাল মিডিয়ায় কখনো কখনো দেখি।
কিন্তু ব্যবসায়ী সমিতির পক্ষ থেকে অতি মুনাফালোভীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না বললেই চলে। অথচ ব্যবসায়ী সমিতিগুলো শক্ত হলে সরকারের হস্তক্ষেপ করার প্রয়োজনই হতো না; কিন্তু শর্ষের মধ্যেই তো ভূত!
এবার আসা যাক ভোক্তাদের মানসিকতায়। ব্যবসায়ীদের মজুতের প্রবণতা যদি নিন্দনীয় হয়, তবে ভোক্তাদের প্রয়োজনের অতিরিক্ত সদাইপাতি কেনার মানসিকতাও পরিত্যাজ্য। কখনো কখনো মাসের মোটা বাজার যেমন, চাল, আটা, ডাল, তেল, চিনি, গুঁড়া দুধ, নুডলস একবারে কেনার পরামর্শ দেওয়া হয়। এটা ঠিক আছে; কারণ, এতে দাম একটু কম পড়ে। আর তা সাধারণ মানুষের পক্ষে একটু সুবিধাজনক হয়।
কিন্তু আমাদের মধ্যে অনেকেই আছেন, একবারে প্রয়োজনের তিন বা চার গুণ পণ্য ক্রয় করে বাসায় মজুত করে রাখেন। মাসে সয়াবিন তেল প্রয়োজন পাঁচ লিটার, তিনি হয়তো ১৫ লিটার কিনে রাখছেন।
কারওয়ান বাজারে আমরা দেখি, গাড়ি ভরে ভরে পণ্য কিনে নেন অনেকে। কিন্তু তাঁরা চিন্তা করেন না, তাঁদের এই অতিরিক্ত ক্রয়–মানসিকতার কারণে অতিরিক্ত চাহিদা তৈরি হওয়ায় ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন। এর ভুক্তভোগী হচ্ছেন সাধারণ দরিদ্র মানুষ, যাঁদের আয় বাড়েনি কানাকড়িও। এখন অতিরিক্ত ক্রয়মানসিকতার এসব ভোক্তাকে শাস্তির আওতায় আনবে কে? এ বিষয়ে আইনকানুন, বিধিমালা প্রণয়নের প্রয়োজন হয়ে পড়েছে বলে মনে হয়।
পাশাপাশি ভোগ কমিয়ে আনার বিষয়ে কিছু কথাবার্তা বলতে চাচ্ছি। ঢাকার বাজারে যে গরুর মাংস ৮০০ থেকে ৮৫০ টাকা কেজি বিক্রি করেছেন ব্যবসায়ীরা, সেই মাংসই ৬৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। যখন ৬৫০ টাকায় বিক্রি করেছেন, তখনো তাঁরা নিশ্চয়ই লাভ করেছেন, লোকসান দিয়ে বিক্রি করেননি। সাধারণ ভোক্তারা গরুর মাংস কেনা কমিয়ে দিয়েছেন বলেই তো ব্যবসায়ীরা দাম কমাতে বাধ্য হয়েছেন। এর পেছনে অন্য কারণও থাকতে পারে হয়তো।
বাজারে পেঁয়াজের কেজি ৮০ টাকা নাকি ১০০ টাকা, এর চেয়ে বড় কথা হলো, পেঁয়াজের ভোগ কমিয়ে আনার সুযোগ রয়েছে। আমাদের পেঁয়াজের সারা বছরের চাহিদার একটি অংশ আমদানি হয়ে আসে। আমদানির জন্য খরচ হয় মূল্যবান ডলার। পেঁয়াজের ভোগ কমানো যেতে পারে। কোনো পরিবারে যদি এক মাসে পাঁচ কেজি পেঁয়াজ ব্যবহার করা হয়, সেটি চার কেজিতে, এমনকি তিন কেজিতে নামিয়ে আনা অসম্ভব কিছু নয়।
প্রকৃতপক্ষে আমরা যেসব পণ্য ডলার খরচ করে আমদানি করে আনি, সেগুলোর ভোগ বা ব্যবহার যতটা সম্ভব কমিয়ে আনা আমাদের প্রত্যেকের দায়িত্ব।
কাজী আলিম-উজ-জামান প্রথম আলোর উপবার্তা সম্পাদক
alim.zaman@prothomalo.com