বিএনপির ফিনিশার কে

হাটে, মাঠে, ঘাটে কিংবা বাসে, ট্রেনে, লঞ্চে পরিচিত কারও সঙ্গে দেখা হলেই অবধারিতভাবে প্রথম যে প্রশ্নটি শুনতে হয়—

ভাই, কেমন আছেন?

ভালো থাকি বা মন্দ থাকি, ঠোঁটের আগায় জবাব একটা তৈরি থাকে—

ভালো আছি। (কিংবা বলি) মোটামুটি।

এ ছাড়া আর কীই-বা বলার আছে।

তারপরই দ্বিতীয় যে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়—

দেশের অবস্থা কী?

দেশ নিয়ে সবাই মাথা ঘামান। এ রকম সর্বজনীন ভাবনা বা জিজ্ঞাসা পশ্চিমের দেশগুলোতে নেই। আমাদের এখানে আকছার এটা শুনতে হয়। কেন?

কারণটা আমি সঠিক জানি না, তবে আন্দাজ করতে পারি। দেশভাবনা সবার মধ্যেই কমবেশি আছে, বিশেষ করে তাদের মধ্যে, যাদের আমরা বলি ‘আমজনতা’। কারণ, দেশ স্বাধীন করতে গিয়ে তাদের অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। এর বিপরীত চিত্রও আছে। কেউ কেউ নিজের, পরিবারের বা গুষ্টির কথা ছাড়া আর কিছু ভাবেন বলে মনে হয় না।

কথা এগিয়ে চলে। আগে অনেক কিছুই বলতাম। এখন এসব একঘেয়ে লাগে। বলি, ভাই, দেশ নিয়ে চিন্তা করার ফুরসত পাই না। এমন অবস্থা হয়েছে যে নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। বাজারে গেলে জিনিসপত্রের দাম শুনে রক্ত মাথায় উঠে যায়। বাজারের হিসাব মেলাতে হিমশিম খাই। দেশ নিয়ে ভাবার সময় কই।

তাতেও বন্ধু নিবৃত্ত হন না।

আরে ভাই, হাল ছেড়ে দিলে চলে?

কী করতে বলেন।

এভাবে তো দেশ চলতে পারে না।

কিন্তু জনসমর্থন তো শেষ কথা নয়। মাঠে আপনি যতই ভালো খেলুন, ৯০ মিনিটের খেলায় ৮৫ মিনিট বল আপনাদের দখলে থাকলেও, শেষ মিনিটে প্রতিপক্ষের একজন স্ট্রাইকার এসে বল আপনার জালে ঢুকিয়ে দিল। রেফারির বাঁশি বাজল। খেল খতম। এখানে ভালো খেলার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে দলে একজন ভালো ফিনিশার থাকা। বিএনপির সেই ফিনিশার কে?

ভাই, আমি তো দেশ চালাই না। আর যাঁরা দেশ চালান, আমাদের কথা ভাববার সময় কোথায় তাঁদের।

তাই বলে তো এড়িয়ে যাওয়া যায় না। আমাদের একটা নাগরিক দায়িত্ব আছে না?

না, এখন আমি আর এটা মনে করি না। দেশ যাঁরা চালান, তাঁরা এভাবে চালাতে থাকবেন। আমাদের আর কিছুই করার নেই, চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া।

ভাই, আপনি তো হতাশাবাদী।

হতাশা বলে বাংলায় একটা শব্দ আছে তো! এখন সেটাই প্রয়োগ করি। আমি কোনোভাবেই এ দেশকে আমার দেশ বলে ভাবতে পারছি না।

কেন কেন?

কারণ, গত পঞ্চাশ বছরে দেশে একটি মালিক সমিতি তৈরি হয়ে গেছে। দেশ চলে তাদের ইচ্ছায়, তাদের ‘সারমনে’। তারা নিয়মিত ‘ওয়াজ-নসিহত’ করে। আমরা সায় দিয়ে যাই। এই তো জীবন!

তাই বলে তো সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে চুপচাপ ঘরে বসে থাকা যায় না।

যান, মাঠে যান, আন্দোলন করেন, গণেশ উল্টে দেন। পারবেন?

কেন, অমুক ভাই, তমুক ভাই তো আন্দোলনের ডাক দিচ্ছে।

ভাই, এ সবই কথার কথা, ফাঁকা আওয়াজ। তলেতলে তারা সরকারের সঙ্গে লাইন দিচ্ছে। এরশাদ সাহেব কী বলেছিলেন, ভুলে গেছেন?

কী বলেছিলেন?

বলেছিলেন, এরা সারা দিন আমাকে গালাগাল করে। রাত হলেই আমার কাছে আসে। আরও শুনেছি, এরা নিয়মিত খাম পেত। সম্ভবত এখনো পায়। নামগুলো বলব?

তাই বলে তো এসব মেনে নেওয়া যায় না। দেশে গণতন্ত্র নেই। একটা ফেয়ার নির্বাচন হতে হবে।

ভাই, এ দেশে দলীয় সরকারের অধীন একটাই ফেয়ার নির্বাচন হয়েছিল, ১৯৫৪ সালে। নুরুল আমীনের মুসলিম লীগের ভরাডুবি হয়েছিল হক-ভাসানীর যুক্তফ্রন্টের কাছে। তিনি ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে সরে গিয়েছিলেন।

এই তো গেল পথ চলতে চলতে চলতি হাওয়ার কথকতা। আমাদের ভোকাবুলারিতে সম্প্রতি জমা পড়েছে অনেক ওজনদার শব্দ: অংশীজন, অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতন্ত্র, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড, জবাবদিহি, আরও কত–কী! আমরা এখন এই শব্দগুলো নেড়েচেড়ে খাচ্ছি। কিন্তু তাতে কিচ্ছু যায় আসে না। মালিক সমিতির গায়ে বিন্দুমাত্র আঁচড়ও লাগে না। যাহা পূর্বং তাহা পরং।

এ দেশের মানুষের কাছে চাল-ডালের মতো রাজনীতিও একসময় ছিল নিত্যপ্রয়োজনীয় ‘খাদ্য’। এখন মানুষ মনে হয় সংবিৎ ফিরে পেয়েছে। ধীরে ধীরে বুঝতে শিখেছে, তারা নিমিত্ত মাত্র। তাদের ভোটের মাধ্যমে মালিক সমিতি নির্বাচিত হবে, এর কোনো নিশ্চয়তা নেই। এখন তরক্কির জন্য কেউ মানুষের কাছে যায় না।

তারা ছোটে মালিকের কাছে। মালিকের কাছে পৌঁছানোর জন্য সেকি আকুলিবিকুলি, কত কসরত, কত আয়োজন! সবার কপালে শিকে ছিঁড়ে না। ওই যে একটা কথা আছে—কেউ ফিরে না খালি হাতে খাজা তোমার দরবারে। মৃত পীরের কাছে মানত করে আশায় থাকা যায়। কিন্তু জিন্দা পীরের তবারক পেতে হয় নগদ। যে পায় না, তার মন খারাপ হয়। সে রেগে যায়, লাঠিসোঁটা নিয়ে রাস্তা আটকে দেয়। পদবঞ্চিতদের এই লড়াই দেখা যায় যত্রতত্র।

যাঁরা মালিক নন, আগে মালিক ছিলেন এবং ভবিষ্যতে মালিকানা ফিরে পাওয়ার আশা রাখেন, সেখানেও একই দৃশ্য। একটা কমিটিতে ঠাঁই পাওয়ার জন্য কত দেনদরবার, ঝগড়া। একবার একটা পদ পেয়ে গেলে বায়োডাটায় তা ঢুকে যাবে। ভবিষ্যতের জন্য এ এক মহার্ঘ বিনিয়োগ।

দেশে একটা নির্বাচন হবে বলে কয়েক মাস ধরে শোরগোল হচ্ছে। ফুটবল-ক্রিকেটে আজকাল অনেক পাতানো খেলা হয়। এসব দেখভাল করার জন্য আন্তর্জাতিক কমিটি আছে। ধরা পড়লে শাস্তি পেতে হয়। আমরা দক্ষিণ আফ্রিকার হ্যানসি ক্রনিয়ে কিংবা ভারতের আজহারউদ্দিনের কথা ভুলে যাইনি। তাঁরা খুব ভালো ক্রিকেটার ছিলেন। তারপরও লোভে পড়ে তাঁরা নিজের আখের খোয়ালেন।

পাতানো খেলা রাজনীতিতেও হয়। আশির দশকজুড়ে এটাই হয়েছে। নিয়মিত খাম পাওয়া লোকগুলো এখনো রাজনীতির মাঠ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। তাদের হায়া-শরম কম।

যে যা-ই বলুন, আমাদের দেশে দ্বিদলীয় রাজনীতিই চলছে। মানুষের চোখে দল বলতে দুটি: আওয়ামী লীগ আর বিএনপি। ভোটার হাতে ক্ষমতা পেলে সে নির্বাচনে সরকার বদলে ফেলে। ১৯৯১ থেকে ২০০৮ আমরা এ দৃশ্য দেখেছি। তারপর থেকে ভোটারের হাতে ওই জিয়নকাঠি আর নেই।

আগামী বছর ডিসেম্বরে নির্বাচন হবে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। কী হবে তখন? আমরা অনেক দৃশ্যকল্পের কথা ভাবি। উন্নয়ন পরিকল্পনায় এর নাম হলো ‘সিনারিও ডেভেলপমেন্ট’। তো ভবিষ্যতে কী কী সিনারিও দেখতে পাব? জনমনে যেসব চিন্তা আছে, আর হাওয়ায় যা ভেসে বেড়াচ্ছে, তা হলো অনেকটা এ রকম:

এক. নির্বাচন কি হবে?

দুই. নির্বাচন হলে তাতে সব দল কি অংশ নেবে?

তিন. বড় একটি দল অংশ না নিলে কি নির্বাচন জায়েজ হবে?

চার. মুখে যতই হম্বিতম্বি করুক, তলেতলে কি দর-কষাকষি হচ্ছে?

পাঁচ. আগামী সংসদে বিরোধী দলকে কটি আসন দেওয়া হবে?

ইংরেজিতে ‘ফেইট অ্যাকমপ্লি’ বলে একটা কথা আছে। নিয়তির বিধান। কথা হলো, নির্বাচনের রাজনীতি কি সংবিধান অনুযায়ী চলবে, নাকি নিয়তি দ্বারা ইতিমধ্যে তা নির্ধারিত হয়ে গেছে?

শেষ কথাটি বলব বিএনপিকে নিয়ে। আমরা দেখতে পাচ্ছি, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ মাঠ ছাড়বে না।

‘সোনার ছেলেরা’ লাঠি আর রামদা নিয়ে রাস্তাঘাট পাহারা দিচ্ছে যেন কোনোভাবেই শত্রুপক্ষ রাস্তার দখল না নিতে পারে। বিএনপির বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দেখে মনে হয়, তারা এবার মরিয়া। যে ভাষায় তাঁরা সভা-সেমিনারে কথা বলেন, তাতে মনে হয় এবার একটা এসপার-ওসপার হয়ে যাবে।

উভয় পক্ষেরই গেম প্ল্যান আছে। ক্ষমতাসীন দলের গেম প্ল্যান কিছুটা বোঝা যায়। ২০১৪ আর ২০১৮ সালের যুদ্ধে তাদের কৌশল কাজ করেছে। তারা বেশ আত্মবিশ্বাসী। দুবারই বিএনপির কৌশল মাঠে মারা গেছে। এবার তাদের তূণে কী ধরনের তির আছে, তা স্পষ্ট নয়। তাদের ডাকে বড় বড় জমায়েত হচ্ছে। জমায়েতের আকার দেখে বোঝা যায়, তাদের প্রতি জনসমর্থন আছে।

কিন্তু জনসমর্থন তো শেষ কথা নয়। মাঠে আপনি যতই ভালো খেলুন, ৯০ মিনিটের খেলায় ৮৫ মিনিট বল আপনাদের দখলে থাকলেও, শেষ মিনিটে প্রতিপক্ষের একজন স্ট্রাইকার এসে বল আপনার জালে ঢুকিয়ে দিল। রেফারির বাঁশি বাজল। খেল খতম। এখানে ভালো খেলার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে দলে একজন ভালো ফিনিশার থাকা। বিএনপির সেই ফিনিশার কে?

  • মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক