যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপীয় দেশগুলোর পক্ষ থেকে বাংলাদেশে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করার ব্যাপারে ব্যাপক চাপ রয়েছে। সেই চাপের অংশ হিসেবে সরকারের আশ্বাস সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র নতুন ভিসা নীতির ঘোষণা করেছে।
আফ্রিকার কয়েকটি দেশের ওপর নির্বাচন প্রশ্নে এ ধরনের ভিসা নীতি আরোপ করা হলেও তা করা হয়েছে নির্বাচনের পর। ফলে এই নীতি তেমন কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারেনি। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তা করা হয়েছে নির্বাচনপ্রক্রিয়া শুরুর পর্বে। এ সময় সরকার ও অন্যান্য রাজনৈতিক দল এবং নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে।
এমন সময় এসব সংশোধনী হয়েছে, যখন এ দেশের মানুষ ও বিশ্ব সম্প্রদায় একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য অপেক্ষা করছে। এ ধরনের সংশোধনী নিশ্চিতভাবেই অনেক প্রশ্নের জন্ম দেবে
বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সাংবিধানিকভাবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান হচ্ছে নির্বাচন কমিশন। কাজেই নির্বাচন কমিশনের কর্মপ্রক্রিয়া ও আইনের মাধ্যমে এর হাতকে শক্তিশালী করার দায়িত্ব সংসদের। কিন্তু সংসদ যদি নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার জায়গায় দুর্বল অথবা হাত-পা বেঁধে দেয়, তাতে জনমনে এবং যারা এ নির্বাচনকে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য দেখতে চায়, তাদের মনেও শঙ্কার সৃষ্টি হতে বাধ্য।
আমার এই গৌড়চন্দ্রিকার উদ্দেশ্য হলো এই সময়ে গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশের (১৯৭২) যেসব সংশোধনী সংসদে পাস হয়েছে, তাতে নির্বাচনের ওপর কমিশনের সার্বিক নিয়ন্ত্রণ দুর্বল হবে। বিশেষ করে, প্রায় দুই যুগ আগে সংযোজিত আরপিও-১৯৭২ এর ৯১(ক) ধারায় যে পরিবর্তন আনা হয়েছে, তাতে নিশ্চিতভাবেই কমিশনের নিয়ন্ত্রণ দুর্বল হবে। একইভাবে নতুন সংযোজনটি কমিশন যেভাবে সুপারিশ করেছিল, তেমনভাবেও হয়নি। কাজেই সেখানেও উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে।
আমার মতো যাঁরা নির্বাচন বিষয় নিয়ে চর্চা করেন, তাঁদের মনে স্বভাবতই প্রশ্ন জেগেছে যে ৯১(ক) ধারায় যে পরিবর্তন আনা হয়েছে, তাতে পুরো নির্বাচনপ্রক্রিয়ার ওপর নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণ শক্ত হবে না শিথিল হবে? ধারাটি এখন যেমন ছিল, সেখানে ‘নির্বাচন’ কথাটি উল্লেখ থাকায় নির্বাচনী প্রক্রিয়ার যেকোনো সময়, অর্থাৎ ভোট গ্রহণের দিনসহ ব্যাপক অনিয়ম বা বিশৃঙ্খল অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচন কমিশন কোনো আসনের নির্বাচনপ্রক্রিয়া স্থগিত রাখার ব্যাপারে সরাসরি ক্ষমতাপ্রাপ্ত ছিল। ২০০৮ সালে তৎকালীন শামসুল হুদা কমিশনের সময়, সর্বসম্মতিক্রমে অধ্যাদেশের মাধ্যমে তা যুক্ত করা হয়েছিল।
পরবর্তী সময় ২০০৯ সালে সংসদ কর্তৃক অনুমোদিত হয়ে আরপিওতে যুক্ত হয়েছিল। এ ধারা নিয়ে ইতিমধ্যে দুটি কমিশন তাদের মেয়াদ পার করেছে। তার পরও হঠাৎ কেন এই পরিবর্তন দরকার পড়ল, তার কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া গেল না। অথচ এর প্রয়োজন ছিল।
গত লেখায় আমি উল্লেখ করেছিলাম যে নির্বাচন মানে আন্তর্জাতিকভাবে শুধু ভোটের দিন ভোট দেওয়া বোঝায় না। নির্বাচনের প্রস্তুতি, ভোট গ্রহণ, নির্বাচনের ফলাফল ও নির্বাচন-পরবর্তী পরিস্থিতি—সবই নির্বাচনের মধ্যে পড়ে। নির্বাচন কমিশনের আওতায় নির্বাচনের প্রক্রিয়াটি নির্বাচন-পরবর্তী নির্ধারিত সময় পর্যন্ত, অর্থাৎ ফলাফল গেজেট না হওয়া পর্যন্ত থাকে। নির্বাচন-পরবর্তী সময়টি থাকে বিচার বিভাগের আওতায়। এ পূর্ণ চক্রই নির্বাচন।
আলোচিত ধারাটি ভোটের দিনসহ নির্বাচনকালীন সময়ে (যার মধ্যে ভোটের দিনও অন্তর্ভুক্ত), যেকোনো স্তরে কোনো আসনের নির্বাচন স্থগিত অথবা বাতিল করতে পারত। আউয়াল কমিশনের কেন এবং কী কারণে বিষয়টি স্পষ্টীকরণের (একজন কর্মকর্তা বা কমিশনারের মতে পত্রিকায় প্রকাশিত) প্রয়োজন পড়েছিল, তা বোধগম্য নয়। সাধারণভাবে প্রশ্ন জাগে, গাইবান্ধায় নির্বাচন বাতিলের পর কি কমিশন কোনো ধরনের বিড়ম্বনায় পড়েছিল?
এখন সংসদে বিল যেভাবে অনুমোদিত হয়েছে, তাতে ওই ধারা প্রয়োগে কমিশনের এখতিয়ার দারুণভাবে খর্ব করা হয়েছে। কমিশন হয়তো এমনটা চায়নি। কারণ, আমার কাছে কমিশনের সুপারিশের যে অংশ রয়েছে, সেখানে নির্বাচন শব্দটি পরিবর্তনের কোনো ছিল না। তারপরও বলতে হয়, কমিশন কেন তার প্রস্তাবে এই ধারা যুক্ত করেছিল। তবে কমিশন কি নিজেই আলোচিত আন্তর্জাতিক চাপ এড়াতে দায়মুক্ত থাকতে চেয়েছে?
যা-ই হোক, বিল যেভাবে অনুমোদিত হয়েছে, তাতে মনে হয় নির্বাচন কমিশনের ত্রুটিপূর্ণ সংশোধনী প্রস্তাবের বাইরে পরিবর্তন আনা হয়েছে। বিলের সংশোধনী কলামে পুরোনো ধারার তিন জায়গায় ‘ইলেকশন’-এর বদলে ‘পোলিং’ শব্দটি প্রতিস্থাপন করা হয়েছে।
বিলটি আইন আকারে প্রকাশিত হওয়ার পর আরপিওতে সংযোজিত হবে। এ ক্ষেত্রে আগামী নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করতে নির্বাচন কমিশনকে তাদের ক্ষমতার ব্যবহার সীমিত করতে হবে। নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা সীমিত করার এই সংশোধনীর দায়দায়িত্ব সরকারি দলের হলেও কমিশন অপরিপক্বতার পরিচয় দিয়েছে। তারা নিজেকে শৃঙ্খলিত করেছে।
নির্বাচন কমিশন তাদের উদ্যোগ এবং এর বিপরীতে সরকারের সংশোধনীর যে ব্যাখ্যাই দিক, এই সংশোধনী কমিশনের ক্ষমতাকে খর্ব করবে। আরপিওতে এ পরিবর্তনের কারণে ভোট গ্রহণের আগে কমিশন গতানুগতিক ব্যবস্থা গ্রহণ ছাড়া শক্ত পদক্ষেপ নিতে পারবে না, যদি না সংবিধানের ১১৯ ধারায় প্রদত্ত অন্তর্নিহিত ক্ষমতা প্রয়োগ করে। এর দায় অনেকখানিই নির্বাচন কমিশনের।
আইন দ্বারা নির্বাচন কমিশনের হাত শক্ত করার দায়িত্ব সরকার ও আইনপ্রণেতাদের। তবে অবশ্যই নির্বাচন কমিশনের চাওয়ার সাংবিধানিক এখতিয়ার রয়েছে। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই তাদের চাহিদা পূরণ হয়নি।
এমন সময় এসব সংশোধনী হয়েছে, যখন এ দেশের মানুষ ও বিশ্ব সম্প্রদায় একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য অপেক্ষা করছে। এ ধরনের সংশোধনী নিশ্চিতভাবেই অনেক প্রশ্নের জন্ম দেবে।
ড. এম সাখাওয়াত হোসেন নির্বাচন বিশ্লেষক, সাবেক সামরিক কর্মকর্তা এবং এসআইপিজির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো (এনএসইউ)
hhintlbd@yahoo.com