মতামত

কমিশনের প্রস্তাব ও প্রশাসনিক সংস্কারের চ্যালেঞ্জ, করণীয় কী

বাংলাদেশে জনকল্যাণমূলক সেবা দ্রুত এবং সহজলভ্য করতে দক্ষ প্রশাসন অপরিহার্য। প্রশাসনে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার মাধ্যমে দুর্নীতি হ্রাস করা সম্ভব। জনমুখী সেবা নিশ্চিত করতে হলে জনগণের প্রয়োজন অনুযায়ী প্রশাসনকে ঢেলে সাজানো অবশ্যম্ভাবী। একই সঙ্গে দীর্ঘসূত্রতা কমিয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যবস্থা করতে হলে প্রশাসনিক কাঠামোর সরলীকরণ প্রয়োজন।

জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের একটি মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয় ১৭ ডিসেম্বর। আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত এই কমিশন প্রশাসনিক কাঠামোতে পরিবর্তনের জন্য বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ করেছে। যেমন পদোন্নতিতে পরীক্ষা পদ্ধতির প্রবর্তন, উপসচিব পদে নিয়োগে পরীক্ষার মাধ্যমে সুযোগ নিশ্চিত করা, উপসচিব পদে ৫০% প্রশাসন ক্যাডারের জন্য ও ৫০% অন্যান্য ক্যাডারের জন্য বরাদ্দ। গুরুত্বপূর্ণ আরও কিছু প্রস্তাবও আছে—বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় পুলিশ ভেরিফিকেশন ব্যবস্থা তুলে দেওয়া, জুডিশিয়াল সার্ভিসের মতো স্বাস্থ্য ও শিক্ষা কমিশন গঠন করার সুপারিশ। ফরিদপুর ও কুমিল্লাকে পৃথক বিভাগ করার প্রস্তাবও দিয়েছে কমিশন।

প্রশাসনিক কাঠামোতে এ ধরনের পরিবর্তনের সুপারিশের বিরোধিতা করেছে প্রশাসন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্যাডার। প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা ৫০% কোটা ভাগাভাগির বিরোধিতা করেন। তাঁদের মতে, পদোন্নতিতে পরীক্ষার ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা সঠিক মূল্যায়ন নিশ্চিত করবে না এবং এটি রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত হতে পারে। অন্যদিকে, আন্তক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ প্রস্তাবিত পরিবর্তনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। ২৫টি ক্যাডারের প্রতিনিধিত্ব ছাড়াই সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়ায় অসন্তোষ প্রকাশ করেছে তারা। বিসিএস জেনারেল এডুকেশন অ্যাসোসিয়েশন এবং বিসিএস হেলথ ক্যাডার তীব্র নিন্দা জানায় কমিশনের প্রস্তাবের। শিক্ষা ক্যাডারে কোনো আলাপ-আলোচনা ছাড়াই এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে তারা মন্তব্য করে।

প্রশাসনিক সংস্কারের ইতিহাস

বাংলাদেশে ১৯৭২ সাল থেকে প্রশাসনিক সংস্কারের লক্ষ্যে বিভিন্ন কমিশন গঠন করা হয়েছে। কমিশনগুলো গঠিত হয়েছিল সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে প্রশাসনের কার্যকারিতা বৃদ্ধি, দুর্নীতি দমন, এবং জনমুখী সেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে। তবে অনেক ক্ষেত্রেই তাদের প্রস্তাবনাগুলোর বাস্তবায়ন সীমিত ছিল। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সিভিল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন রেস্টোরেশন কমিটি গঠন করা হয়। মূল লক্ষ্য ছিল মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী প্রশাসনিক কাঠামো পুনর্গঠন ও যুদ্ধবিধ্বস্ত প্রশাসনের পুনর্বহাল এবং কার্যক্রমে গতিশীলতা আনা। একই বছরে মন্ত্রণালয় এবং বিভাগগুলোর পুনর্গঠন ও প্রশাসনিক কাঠামো সহজ ও কার্যকর করার জন্য অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ রি-অর্গানাইজেশন কমিটি গঠন করা হয়। সরকারি কর্মচারীদের বেতন কাঠামো উন্নয়ন ও প্রশাসনিক কার্যক্রমে দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য ১৯৭৬ সালে পে অ্যান্ড সার্ভিস কমিশন গঠন করা হয়।

১৯৮০ থেকে ১৯৮৮–এর মধ্যে অন্তত ১০টি সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়। এর মধ্যে ছিল উপজেলা পরিষদ ব্যবস্থা প্রবর্তন, নতুন বেতন কাঠামো প্রবর্তন ও স্থানীয় সরকারব্যবস্থার শক্তিশালীকরণবিষয়ক কমিশন। প্রশাসনিক কাঠামোর জটিলতা দূর করে স্বচ্ছ ও কার্যকর ব্যবস্থা প্রবর্তনের লক্ষ্যে ১৯৯১ সালে প্রশাসনিক সংস্কার কমিটি গঠন করা হয়। একই উদ্দেশ্যে আবার ১৯৯৬-৯৭ সময়ে প্রশাসন সংস্কার কমিশন গঠন করে তৎকালীন সরকার। আর্থিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা ও কর ব্যবস্থা সহজ এবং দুর্নীতিমুক্ত করার লক্ষ্যে ২০০৫ সালে ট্যাক্স অমবুডসম্যান আইন করা হয়। নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের লক্ষ্যে ২০০৭ সালে রেগুলেটরি রিফর্ম কমিশন গঠন করা হয়। জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা, প্রশাসনিক কার্যকারিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ২০০৯ সালে কর্মদক্ষতাভিত্তিক মূল্যায়ন পদ্ধতি (পিবিইএস) করা হয়। ২০১০–এর দশকে ই-গভর্ন্যান্স বাস্তবায়ন, সেবা প্রদান পদ্ধতিকে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে নিয়ে আসা, সরকারি তথ্য ও সেবা অনলাইনে সহজলভ্য করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। সর্বশেষ, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার প্রশাসনকে জনমুখী ও দক্ষ করা, দুর্নীতি প্রতিরোধ এবং জবাবদিহি নিশ্চিত করা এবং স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন গঠন করেছে।

প্রশাসনিক সংস্কারের প্রতিবন্ধকতা

এত সংস্কার কমিশন ও উদ্যোগ গ্রহণ করার পরও আশানুরূপ সফলতা পাওয়া যায়নি বলেই ধরে নেওয়া যায়। এর মূল কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব। কারণ, সংস্কার উদ্যোগের বেশিরভাগই প্রস্তাবনা পর্যায়ে থেকে গেছে। আমলাতান্ত্রিক প্রতিরোধ আরেকটি অন্যতম কারণ। সরকারি কর্মকর্তাদের একাংশ সংস্কারকে তাঁদের ক্ষমতা এবং সুযোগ-সুবিধার জন্য হুমকি হিসেবে দেখেন। সবচেয়ে বড় যে সমস্যা, তা হচ্ছে প্রশাসনকে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দলীয়করণ করা। প্রশাসনকে নিরপেক্ষ করার উদ্যোগ বাস্তবায়নে বিগত সরকারগুলোর ব্যর্থতা ছিল উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া রয়েছে বিশেষজ্ঞ ও সাধারণ ক্যাডারদের দ্বন্দ্ব। বিশেষজ্ঞদের নিয়োগ ও পদোন্নতিতে সাধারণ কর্মকর্তাদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত ও সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে জনগণের মতামত গ্রহণে অবহেলাকে দায়ী করা যায়।

সুপারিশসমূহ

নিয়োগ প্রক্রিয়ায় মেধা ও দক্ষতার প্রাধান্য দেওয়া খুব গুরুত্বপূর্ণ। প্রয়োজন সিভিল সার্ভিস কর্মকর্তাদের নিয়মিত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে জনবল উন্নয়ন করা। দুর্নীতি প্রতিরোধে দুর্নীতি দমন কমিশনের কার্যক্রম শক্তিশালী করা না গেলে অনেক উদ্যোগই ব্যর্থ হবে। অনলাইনে অভিযোগ দাখিলব্যবস্থা চালু করা আবশ্যক। প্রশাসনের প্রতিটি স্তরে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির পরিবেশ তৈরি করা একান্ত প্রয়োজন। জনমুখী প্রশাসন গঠন করতে হলে জনগণের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে অভিযোগ বাক্স স্থাপন করা যায়। কর্মকর্তাদের প্রতি জনদায়িত্ব নিশ্চিত করতে নিরীক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তন করা দরকার। আইন প্রয়োগে সমতা এবং কোনো প্রকার পক্ষপাতিত্বহীনতা নিশ্চিত করতে হবে। নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে জনগণের অংশগ্রহণ বাড়ানো দরকার। সব শ্রেণির মানুষের জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করে নারী, প্রতিবন্ধী ও অন্যান্য সুবিধাবঞ্চিত গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করতে হবে। পরিবেশ সংরক্ষণের মতো বিষয়কে প্রশাসনিক কার্যক্রমে গুরুত্ব দিয়ে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। সেই সঙ্গে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জনে প্রশাসনের ভূমিকা কার্যকর করতে হবে। জনগণকে সেবা প্রদানের প্রক্রিয়া সহজ, দ্রুত ও জনবান্ধব করা আর সেই লক্ষ্যে গ্রামপর্যায়ে সেবার সুযোগ বৃদ্ধি করার মতো বিষয়গুলো বেশ গুরুত্বপূর্ণ।

বিশেষজ্ঞ ক্যাডারের মূল্যায়ন প্রযুক্তি ও নীতি প্রণয়নে বিশেষজ্ঞদের ক্ষমতায়িত করা প্রয়োজন। পদোন্নতিতে সমতাভিত্তিক নীতি প্রণয়ন করতে না পারলেই অনেক উদ্যোগই সফল না–ও হতে পারে। নির্দিষ্ট অঞ্চলে পরীক্ষামূলকভাবে সংস্কারের বিভিন্ন মডেল প্রয়োগ করা যেতে পারে। আর সফল মডেলগুলো পর্যায়ক্রমে দেশব্যাপী বাস্তবায়ন করার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।

শেষ কথা

বাংলাদেশের প্রশাসনিক সংস্কার একটি জটিল এবং দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া যা দেশের সার্বিক উন্নয়ন ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য অপরিহার্য। অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা এবং বর্তমানের চাহিদার ভিত্তিতে প্রশাসনিক কাঠামোতে যেসব সুপারিশ ও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তা বাস্তবায়নে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, আমলাতান্ত্রিক প্রতিরোধ নিরসন এবং জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা অপরিহার্য।

বিশেষজ্ঞ ও সাধারণ ক্যাডারদের মধ্যে সমন্বয়, পদোন্নতি ও নিয়োগ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা এবং প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ই-গভর্নেন্স বাস্তবায়ন করে প্রশাসনকে আরও জনমুখী ও দক্ষ করা সম্ভব। প্রশাসনিক কাঠামোকে আরও সহজ ও কার্যকর করার লক্ষ্যে বিকেন্দ্রীকরণ এবং স্থানীয় সরকারের ক্ষমতা বৃদ্ধি করা উচিত।

একটি সমতাভিত্তিক, স্বচ্ছ এবং জবাবদিহিতাপূর্ণ প্রশাসন গঠনের মাধ্যমে শুধু দুর্নীতি হ্রাস করাই নয় বরং জনকল্যাণমূলক সেবার মান বৃদ্ধি করা সম্ভব। এ প্রক্রিয়ায় সব শ্রেণির মানুষের জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি, নারী ও সুবিধাবঞ্চিত গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তি এবং পরিবেশ সংরক্ষণে গুরুত্ব দেওয়া প্রশাসনিক সংস্কারের অবিচ্ছেদ্য অংশ হওয়া উচিত।

অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে এবং ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় একযোগে কাজ করলে প্রশাসনিক সংস্কারের মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি উন্নত, সুশাসিত ও সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হতে পারে। এ লক্ষ্যে সবার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা এবং সহযোগিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

  • ইমাম উদ্দিন কানাডিয়ান সেন্টার ফর ইনফরমেশন অ্যান্ড নলেজের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা imamuddin015@gmail.com