বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কারের জন্য জরুরি শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন তোলা। বিগত বছরগুলোতে শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা কেন জরুরি এবং এর জন্য প্রয়োজনে একটি কমিশন গঠনের গুরুত্ব নিয়ে লিখেছেন খান মো. রবিউল আলম
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কার জরুরি। শিক্ষক নিয়োগ ও শিক্ষক মূল্যায়ন এ ক্ষেত্রে একটি অগ্রগণ্য দিক। কারণ, এর সঙ্গে রয়েছে লেজুড়বৃত্তি রাজনীতির বিশেষ সম্পর্ক। যোগ্য শিক্ষকদের প্রতি সম্মান রেখে বলছি, ২০০১-পরবর্তী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ এক গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করেছে। এ ক্ষত সারানো না গেলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তি ত্বরান্বিত কঠিন হবে। ১৯৭৩ এর অধ্যাদেশ অনুসারে স্বায়ত্তশাসিত চারটি বিশ্ববিদ্যালয় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হলেও মূলত সবকটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়েই এ আলোচনা।
বিগত সময়ে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি–সর্বস্ব মানহীন একটি বড় অংশ শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেয়েছে। যাঁদের দাপটে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ক্রমশ পরিচয়হীন হয়ে উঠেছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় সংস্কার কীভাবে এগোবে, তা আবেগ নয় রক্ত দিয়ে ভাবতে হবে। বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস গ্রন্থে আহমদ ছফা বলেছিলেন, ‘আমরা এমন এক সময়ে বাস করছি, যখন আমাদের রক্ত দিয়ে ভাবতে হচ্ছে।’ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কার প্রশ্ন কেবল আইন, কাঠামো বা স্বায়ত্তশাসনের বিষয় নয়, কীভাবে তাকে রাজনীতির কৃষ্ণগহ্বর থেকে বের করে আনা যাবে, তা–ও জরুরি প্রশ্ন।
এটি বলার অপেক্ষা রাখে না যে শেখ হাসিনা সরকারের আমলে মান এবং আদর্শবর্জিত বিপুলসংখ্যক দলীয় ক্যাডার নিয়োগ পেয়েছে, যা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে অন্তঃসারশূন্য করে তুলেছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে উঠেছে সমাজের কঙ্কালসার উটকো প্রতিষ্ঠানে। জনগণের টাকায় পরিচালিত এসব প্রতিষ্ঠান সুস্থ, জ্ঞান ও গবেষণামুখী আধুনিক শিক্ষায়তনে পরিণত করা দুরূহ হয়ে পড়েছে। কারণ, শিক্ষাদর্শনের দিক থেকে বড় ধরনের বিচ্যুতি ঘটে গেছে। বিশ্ববিদ্যালয় নানা দিক থেকে হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক পুনর্বাসনকেন্দ্র।
বিগত বছরগুলোতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিয়োগে যাচ্ছেতাই ঘটে গেছে। কারণ দলীয় অনুগতদের নিয়োগের তৎপরতা ছিল প্রবল। যে কারণে যোগ্য প্রার্থী নির্বাচনের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে ন্যূনতম যোগ্যতাসম্পন্নদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগে চরম অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় মূলত কাজ করেছে রাজনৈতিক বিবেচনা, বুদ্ধিবৃত্তিক সক্ষমতা নয়। এ কারণে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ক্রমশ পথ হারিয়ে ফেলেছে।
একটি রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে যদি আরেকটি রাষ্ট্রীয় কাঠামো থাকে, তবে তা হলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। এর আচার্য রয়েছে, রয়েছে উপাচার্য, সিনেট ও সিন্ডিকেট, প্রক্টরিয়াল বডি ও নির্দিষ্ট সীমানা। বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে একটি সার্বভৌম সত্তা। এ শক্তি হজম করার মতো বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কাছে জনগণ আশা করেছিল। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সেই শক্তির কথা ভুলে গেছে। হয়ে উঠেছে ক্ষমতা ও কর্তৃত্বের পার্টনার। বুদ্ধির মুক্তিতে নয়, শাসকের বয়ানের কোরাস গাইতে পারঙ্গম হয়ে উঠেছে।
আমরা দেখেছি, গোষ্ঠীস্বার্থ রক্ষায় একদল শিক্ষক কীভাবে নিয়োগ পেয়েছে। যাঁদের বড় অংশের পঠন–পাঠন, জ্ঞান অনুসন্ধান, নৈতিকতায় বিশেষ মান অবশিষ্ট নেই। কিন্তু তাঁরা শিক্ষক অভিধায় সিক্ত। এসব শিক্ষক প্রকৃত শিক্ষকদের বিপরীতে দাঁড়িয়ে গেছেন। সংখ্যানগণ্য চিরচেনা শিক্ষকদের তাড়া করে ফিরছেন। প্রকৃত শিক্ষকদের জীবন বিষিয়ে তুলেছেন। তাঁদের কাতারে নামিয়ে আনছেন। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় পরিসরে একাডেমিক আলোচনার চেয়ে স্বার্থান্ধ রাজনৈতিক আলাপের আধিক্য বেড়েছে। মনে রাখতে হবে, রাজনৈতিক সচেতনতা আর রাজনৈতিক ধান্ধাবাজি এক বিষয় নয়।
এই কাঁচা মানুষগুলো যখন শিক্ষক হয়ে উঠছেন, তখন তাঁরা নানা ধরনের অপতৎপরতায় জড়িয়ে পড়ছেন। শ্রেণিকক্ষে যথেষ্ট প্রস্তুতি ছাড়া কথা বলছেন, হম্বিতম্বি করছেন, শিক্ষার্থীরা প্রশ্ন করলে রেগে যাচ্ছেন, এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে হেনস্তা করা হচ্ছে, পরীক্ষার খাতায় দেখে নেওয়ার চেষ্টা করছেন।
শিখন বিনিময়মূলক তৎপরতা না হয়ে হয়ে উঠেছে এক সহিংস তৎপরতা। বেশির ভাগ শিক্ষকের ক্লাসে শিক্ষার্থীরা শঙ্কিত থাকে, ভয় পায়, দুশ্চিন্তাগ্রস্ত থাকে। কারণ, স্যারের ‘মন খারাপ’ হলে তিনি পরীক্ষার খাতায় ‘দেখে’ নেবেন। এতে একজন শিক্ষার্থীর জীবনের গতিপথ বদলে যাবে, ইতিবাচকভাবে নয়, নেতিবাচকভাবে। আমরা জানি, শ্রেণিকক্ষে বুদ্ধিবৃত্তিক শূন্যতা তথাকথিক শিক্ষকদের কতটা ভয়ংকর করে তোলে। শিক্ষার্থীদের যেকোনো প্রশ্নে তাঁরা অসহায় বোধ করেন, ঝুঁকিতে পড়েন। লেজুড়বৃত্তি রাজনীতির কারণে এসব নিয়োগ শিক্ষাক্ষেত্রে সহায় নয় অসহায়ত্বের ভীত রচনা করেছে।
এসব নামধারী শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীদের সামনে নিজেকে কাল্ট হিসেবে হাজির করতে চান। ভঙ্গির সংঘ খোলেন। অনুগত-সাগরেদ জোগাড় করেন। যেসব শিক্ষার্থী এসব জোটে ঢুকতে চায় না বরং তাদের বিড়ম্বনায় ফেলেন।
কমবেশি প্রত্যেক বিভাগের ভেতর থাকে অসংখ্য বিভাগ, ব্যক্তিবিশেষের বিভাগ। বিভাগগুলো হয় ব্যক্তি ও গোষ্ঠীতন্ত্র চর্চার পরিক্ষেত্র। অ্যাডওয়ার্ড সাইদ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এ ধরনের তৎপরতাকে ক্লেনিংনেস বা গোষ্ঠীতন্ত্র বলেছেন। দল পাকানো ছাড়া এসব শিক্ষকের বিশেষ কোনো কাজ নেই। এসব অশুভ শিক্ষকের শারীরিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বাহিনী থাকে। তাঁদের বিরুদ্ধে কেউ কিছু বললে একসঙ্গে হইহই করে ওঠেন, শাসাতে থাকেন। শিক্ষার্থীরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়ে পড়ে এক গভীর সংকটে, পড়ে এক সিন্ডিকেটের ভেতর। শুভ্র জ্ঞানচর্চার চেয়ে তাদের নানাভাবে অভিযোজিত হতে হয়। ডিগ্রি নিয়ে বের হওয়াটা মুখ্য কাজ হয়ে ওঠে।
শিক্ষার্থীদের ভেতর নানা সংকট ও সম্ভাবনায় গড়ে ওঠা সম্পর্কের স্বাদ কেবল তাঁদের বাঁচিয়ে রাখে। শিক্ষার্থীরা হাত ধরাধরি করে চলতে পারে বলেই দম নিতে পারে। পরিবর্তনের স্বপ্ন বুনতে পারে। আলো জ্বালাতে পারে। এটা শিক্ষার্থীদের একান্ত নিজস্ব অর্জন। এ প্রক্রিয়ায় বেড়ে ওঠায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ কোনো ভূমিকা নেই। বিশ্ববিদ্যালয় বানাতে চেয়েছিল নির্বিষ প্রজন্ম, কিন্তু তারা হয়ে গেলে বিষধর গোখরা। এটাই হলো নিপীড়নমূলক শাসনের সবচেয়ে বড় ব্যাকফায়ার।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে অকেজো প্রতিষ্ঠানে বা শাসকগোষ্ঠীর নিজস্ব প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার ঘৃণ্য প্রয়াস জনগণ দেখেছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় আর যা হোক, দলীয় জনবল নিয়োগের কারখানা হতে পারে না। শাসকগোষ্ঠী বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে অক্ষম করে তুলতে চেয়েছে। কারণ, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অকার্যকর হলে অশুভ গতি কণ্টকমুক্ত হয়। হয়েছেও তা–ই। শাসকগোষ্ঠী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে হত্যা করেছে। আর বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এ খুন বুক পেতে মেনে নিয়েছে। আত্মহননের পথে হেঁটেছে। ভুলে গেছে নিজেদের শক্তি ও স্বাধীনতার কথা।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এস্টাবলিশমেন্টের পক্ষেই কাজ করবে, এটিই প্রতিষ্ঠিত করে ফেলা হয়েছে। এটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ নয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ হলো দক্ষ, যোগ্য ও বিশেষাত্মক জনসমাজ গড়ে তোলা। জ্ঞান–বিজ্ঞানে বিকশিত একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, সহনশীল ও মানবিক মর্যাদাসমৃদ্ধ সমাজ নির্মাণ। জ্ঞান সৃষ্টি, সংরক্ষণ ও জনকল্যাণে প্রয়োগ বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম কাজ। শাসনের উপযোগী জনমানস গড়ে তোলা বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব নয়।
শাসকগোষ্ঠী খুব ভালো করে বুঝেছে, নলেজ ইন্ডাস্ট্রির ওপর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা না গেলে শাসন জিইয়ে রাখা সহজ হবে না। আর দশটি প্রতিষ্ঠানের মতো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে তারা দুমড়েমুচড়ে বগলদাবা করতে চেয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেও বানিয়েছে উন্নয়নের সূতিকাগার। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় বিগত বছরগুলোতে যেভাবে অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে, তা ভাবতে অবাক লাগে। উচ্চশিক্ষা, গবেষণা, লাইব্রেরি সমৃদ্ধকরণের চেয়ে অনেক বেশি ব্যয় হয়েছে অবকাঠামো খাতে ও শিক্ষা প্রশাসনে।
এই রাজনৈতিকীকরণ কত প্রবল ছিল, তা বোঝা যায় যখন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বলেন, ‘আমাকে যুবলীগের সভাপতি বানানো হলে আমি উপাচার্যের পদ ছেড়ে দেব।’ পচন কোনো পর্যায়ে গেলে এমনটি হতে পারে।
কেবল তা–ই নয়, শিক্ষকদের বড় অংশের মনোযোগ শিক্ষাক্রম ছাড়া রাজনীতি, ক্ষমতা, ব্যক্তিস্বার্থ–সংশ্লিষ্ট বিবিধ বিষয়ের প্রতি। শিক্ষক তো রাতারাতি হওয়ার মতো বিষয় নয়। যে শিক্ষার্থী শিক্ষক হতে চায় তার মনোবাসনা, চর্চা এবং একাগ্রতা থাকতে হয়। নিয়োগের ক্ষেত্রে একাডেমিক ভোকেশনের চেয়ে রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি, আনুগত্য ও সম্মতিকে অগ্রগণ্য বিষয় হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে।
একটি নিপীড়নমূলক শাসনের বিরুদ্ধে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে। হাতে গোনা কিছু প্রতিশ্রুতিশীল শিক্ষক জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শাসকগোষ্ঠীর প্রাধান্যশীল বয়ানের বিরুদ্ধে ভিন্নমত দাঁড় করিয়েছেন। নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছুসংখ্যক শিক্ষক ফ্যাসিস্ট রেজিমের বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছেন এবং বুদ্ধিবৃত্তিক প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্নিহিত শক্তি প্রমাণ করেছেন।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই দশকের নিয়োগপ্রক্রিয়া পূর্ণাঙ্গভাবে মূল্যায়নের জন্য একটি স্বাধীন কমিশন গঠন করা হোক। এ কমিশনের কাজ হতে পারে:
এক. নিয়োগ বোর্ডগুলোর গঠন ও নিয়োগপ্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ভূমিকা অনুসন্ধান করা। কারণ, বিভিন্ন সময়ে সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর থেকে এ অনুমিতি দাঁড় করানো যায়, এসব নিয়োগপ্রক্রিয়ার সঙ্গে দুর্নীতি সম্পৃক্ততার অভিযোগ রয়েছে। এ নেক্সাসের মুখোশ উন্মোচন খুব জরুরি। এ কমিশনের একটা বড় কাজ হতে পারে বিগত দুই দশকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিয়োগের ওপর একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করা। বিগত দেড় দশকে বছরে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগপ্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক বিবেচনা কাজ করেছে, বুদ্ধিবৃত্তিক সক্ষমতা নয়। কারা কারা নিয়ম ভঙ্গ করে, অনিয়ম করে ও দুর্নীতির মাধ্যমে নিয়োগ পেয়েছেন তাঁদের চিহ্নিত করা কঠিন কাজ নয়। শর্ত শিথিল বা ভঙ্গ করে দেওয়া নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ও নিয়োগ পরীক্ষাগুলো যাচাই–বাছাই করলে অনেক কিছু বেরিয়ে আসবে।
দুই. এ সময়ে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের একাডেমিক পারফরম্যান্স মূল্যায়ন করতে হবে। মূল্যায়নের ভিত্তিতেও বের করা সম্ভব কারা শিক্ষক হিসেবে যোগ্য, আর কারা যোগ্য নন। মূল্যায়নে ভিত্তি হতে পারে; ক. মানসম্মত পাঠদান, নিয়মিক ক্লাস, কাউন্সেলিং, পরীক্ষার খাতা মূল্যায়ন ও জমাদান; খ. পরীক্ষা কমিটিতে অংশগ্রহণ, সময়মতো পরীক্ষার কাজ সম্পাদন, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিসরে গবেষণা, প্রকাশনা; সভা-সেমিনারে অংশগ্রহণ, পেপার উপস্থাপন; গ. শিক্ষার্থী-শিক্ষক সম্পর্ক সন্তুষ্টির মাত্রা যাচাই, সময়ানুবর্তিতা। ঘ. আর্থিক (বিভাগের তহবিল ও পরীক্ষা সম্পর্কিত আয়-ব্যয়ে স্বচ্ছতা) ও নৈতিকতা ও সততা মূল্যায়ন (যৌন হয়রানি, প্রশ্নপত্র ফাঁস, কাউকে সুবিধা দেওয়া, পক্ষপাতিত্ব); ঙ. অভিযোগ মূল্যায়ন ও ডিসিপ্লিনারি অ্যাকশন (যদি থাকে)।
নৈতিকতা ও পেশাদারত্বের দিক থেকে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো পদোন্নতির জন্য গবেষণা অভিসন্দর্ভ (পিএইচডি) ও বিভিন্ন জার্নালে প্রকাশনার ক্ষেত্রে চৌর্যবৃত্তি মনোভঙ্গি। বিগত সময়ে এ সম্পর্কিত অনেক অভিযোগ উঠেছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পদক্ষেপ নিয়েছে, কিন্তু অনেকে ধরাছোয়ার বাইরে থেকে গেছেন। বিশেষত যাদের রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি রয়েছে।
শিক্ষকসহ বিভিন্ন সরকারি কর্মকর্তার সেসব পিএইচডি ক্রিটিকেলি রিভিউ করা হোক। পক্ষপাত, রাজনৈতিক বিবেচনা ও অজ্ঞাত কারণে দেওয়া সব ধরনের ডিগ্রি পুনর্মূল্যায়ন করা হোক। সাবেক সেনাপ্রধান আজীজ আহমেদ ও পুলিশের সাবেক আইজিপি বেনজির আহমেদের পিএইচডি ডিগ্রির কথা স্মরণ করা যায়। অ্যাকডেমিক কাউন্সিল হয়ে সিন্ডিকেট কর্তৃত্ব প্রদত্ত সকল পিএইডি বিশ্ববিদ্যালয়ের মঞ্জুরি কমিশনের মাধ্যমে একটি বিশেষ পোর্টাল বা প্ল্যাটফর্মে প্রকাশ করা হোক। যে কেউ চাইলে যেন সেসব পড়তে পারে। চৌর্যবৃত্তি, কপিপেস্ট, সূত্রচুরি নিশ্চিত হলে ডিগ্রি বাতিল ও পদঅবনমন করে এসব অসততারোধে বিশ্ববিদ্যালয় কার্যকর পদক্ষেপ নিক, উদহারণ তৈরি করুক।
বিশ্ববিদ্যালয়কে ঢেলে সাজাতে এবং সেটিকে প্রকৃত উচ্চশিক্ষা ও গবেষণাচর্চা কেন্দ্র হিসেবে রূপ দিতে যোগ্য, দক্ষ ও মানসম্পন্ন শিক্ষকের বিকল্প নেই। এখন গত দেড় দশকে নিয়োগ পাওয়া বিপুলসংখ্যক অযোগ্য, অদক্ষ ও মানহীন শিক্ষককে রেখে দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রকৃত অর্থে বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা কীভাবে সম্ভব?
ভারতের প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রমিলা থাপার যেমনটি বলেন, ইন্টেলেকচুয়ালিটি ইজ দ্য সুপ্রিম অথরিটি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই দায় ও দায়িত্ব রয়েছে। কথা হলো, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ইন্টেলেকচুয়াল অথরিটি আপহোল্ড করতে হবে। স্বাধীনভাবে চলতে দিতে হবে, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে। একটি পূর্ণাঙ্গ কমিশন গঠিত হলে সেই পথরেখা জাতি পাবে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বাঁচুক, বুদ্ধিজীবিতা বাঁচুক।
খান মো. রবিউল আলম যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও শিক্ষক