মতামত

গণতন্ত্রের ‘আওয়ামী লীগ মডেল’

আওয়ামী লীগের নেতারা ইদানীং একটি কথা বেশ জোরেশোরে বলেন যে বাংলাদেশের গণতন্ত্র অন্য দেশের মতো হবে না। বাংলাদেশের মতোই হবে। তাঁদের এসব কথা শুনে সত্তরের দশকের বহুল চর্চিত একটি কথা মনে পড়ল। সে সময় বাম দলগুলো যখন মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদের ভিত্তিতে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আওয়াজ তুলেছিল, তখন আওয়ামী লীগ থেকে বলা হলো, এখানে বিদেশি কোনো মতবাদ চলবে না। বাংলাদেশের সমাজতন্ত্র হবে বাংলাদেশের মতো। কিন্তু আমাদের সংবিধানে সমাজতন্ত্র মূল নীতি হিসেবে লিখিত হলেও বাস্তবে আওয়ামী লীগ সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কোনো কার্যকর উদ্যোগই নেয়নি। 

এখানকার বেশির ভাগ শিল্পকারখানা ছিল পাকিস্তানিদের। তাঁরা চলে গেলে সেগুলোর মালিকানা রাষ্ট্রের হাতে এসে যায়; ক্ষমতাসীনেরা সেটাই সমাজতন্ত্র বলে চালাতে থাকলেন; যার মধ্যে এশিয়ার বৃহত্তম পাটকল আদমজীও ছিল। প্রথমে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে লুটপাটতন্ত্র চলল, পরবর্তীকালে সেগুলো বেসরকারীকরণের নামে আরেক দফা লুটপাট চলতে থাকল। হাজার হাজার কোটি টাকা লোকসান গুনেও রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পগুলো কোনো সরকার চালাতে পারল না। অথচ মালয়েশিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়া সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির আওয়াজ না তুলেও ভারী শিল্পকারখানা রাষ্ট্রের হাতে রেখে সেগুলোকে যেমন লাভজনক করেছে, তেমনি অর্থনীতিকেও দৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়েছে। এটাই হলো বাংলাদেশি মডেলের সমাজতন্ত্রের করুণ পরিণতি। 

আর বাংলাদেশি গণতন্ত্রের মডেল আমরা ৫১ বছর ধরেই দেখে আসছি। আওয়ামী লীগের নেতারা প্রায়ই বলেন, স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে বেশির ভাগ সময় ‘স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি’ ক্ষমতায় ছিল বলে তাঁরা যে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষ ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠাকে রাষ্ট্রের মৌলিক নীতি হিসেবে নিয়েছিলেন, সেটি বাস্তবায়ন করতে পারেননি। আমরা হিসাব করলে দেখব, গত ৫১ বছরের মধ্যে বিএনপি তিন দফায় ক্ষমতায় ছিল ১৬ বছর ৯ মাস, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ৮ বছর ৮ মাস। বাকি সময়টা আওয়ামী লীগই ক্ষমতায় ছিল এবং আছে। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর সরকার প্রায় পৌনে চার বছর ক্ষমতায় ছিল। শেখ হাসিনার সরকার চার দফায় ১৯ বছর। সে ক্ষেত্রে তাদের ভাষ্যমতে স্বাধীনতাবিরোধী ও পক্ষের শক্তির ক্ষমতার মেয়াদে খুব বেশি ফারাক নেই। আবার আওয়ামী লীগ যে রাজনৈতিক শক্তিকে স্বাধীনতার চেতনাবিরোধী মনে করে, তাদের একাংশকে নিয়েই তিনবার সরকার পরিচালনা করেছে এবং তিনবার জোটবদ্ধভাবে নির্বাচন করেছে। এমনকি তারা যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতে ইসলামীকে নিয়ে বিএনপির বিরুদ্ধে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলন করতেও দ্বিধা করেনি। 

দলীয় গঠনতন্ত্র ও সংবিধানে যা-ই লেখা থাকুক না কেন, অর্থনৈতিক নীতি ও রাজনৈতিক চরিত্র বিচারে তিন প্রধান দলের মধ্যে মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই। সবারই উদ্দেশ্য যেকোনো মূল্যে ক্ষমতায় থাকা এবং ক্ষমতায় যাওয়া। কেউ বাঙালি জাতীয়তাবাদকে মোক্ষ ধরে নিয়েও রাষ্ট্রধর্মের সঙ্গে আপস করে, হেফাজতকে মিত্র করে নেয়। কেউ নিজেদের মুক্তিযোদ্ধার দল দাবি করেও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির সঙ্গে আঁতাত করে। 

গণতন্ত্রের নানা মডেল ও চেহারা আছে। কিন্তু যে মৌলিক নীতির ওপর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত, রাষ্ট্র পরিচালনায় জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন, সেখান থেকে বিচ্যুত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। গণতন্ত্র ওয়েস্টমিনস্টার পদ্ধতির হতে পারে, যেখানে জাতীয় সংসদই সব বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। আবার গণতন্ত্র রাষ্ট্রপতিশাসিত হতে পারে, যেখানে রাষ্ট্রপতিই সর্বময় ক্ষমতার মালিক। আমাদের দেশেও সংসদীয় ব্যবস্থা চালুর আগপর্যন্ত বহাল ছিল। সে সময় সংসদকে বলা হতো ‘রাবার স্ট্যাম্প।’ সম্প্রতি বিএনপি যে রাষ্ট্র মেরামতের জন্য ২৭ দফা প্রস্তাব দিয়েছে, তাতে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্যের কথা আছে। কিন্তু দলটি যখন ক্ষমতায় ছিল, তখন প্রধানমন্ত্রীর ‘সার্বভৌমত্বেই’ আস্থা রেখেছিল। রাষ্ট্রপতিশাসিত ব্যবস্থায় যেমন রাষ্ট্রপতি সব ক্ষমতার উৎস, আমাদের সংসদীয় ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর হাতেই সব ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। সাবেক রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ একবার দুঃখ করে বলেছিলেন, মিলাদ পড়ানো ও কবর জিয়ারত ছাড়া তাঁর কোনো কাজ নেই।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অভিঘাতে অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিও নাজুক অবস্থায়। যেভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয়, বিশেষ করে খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে চলেছে, তাতে গরিব ও নিম্ন আয়ের মানুষের জীবনধারণই কঠিন হয়ে পড়েছে। ক্যাবের জরিপ অনুযায়ী, গত এক বছরে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য যথাক্রমে চালের দাম বেড়েছে ১৭.২২ শতাংশ, আটার দাম ২৭.৪৬ শতাংশ, মসুর চাল ১৬.২১ শতাংশ, ছোট মাছ ১৭.০৭ শতাংশ, কাঁচা মরিচ ৩৮.৬৪ শতাংশ এবং ফল ৩০.৪৫ শতাংশ। টিসিবির গাড়ি ও ডিলারদের দোকানের সামনে নারী-পুরুষের লাইন দীর্ঘ হচ্ছে। কয়েক দিন আগে প্রথম আলোতেই খবর বের হয়েছিল, কম দামে পণ্য কেনার জন্য ডিলারের দোকানের সামনে ২৬ ঘণ্টা পর্যন্ত মানুষ অপেক্ষা করেছেন ডিসেম্বরের শীত উপেক্ষা করে। এই হলো আমাদের উন্নয়নের বাংলাদেশের মানুষের জীবনচিত্র।

অতীব দুঃখের বিষয় এসব নিয়ে জনপ্রিয় দলের খ্যাতিমান নেতাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। তাঁদের বক্তৃতা-বিবৃতিতেও গরিব-দুঃখী মানুষের কথা কমই থাকে। তঁারা একে অপরের মুণ্ডপাত করতে বেশি সদা ব্যস্ত থাকেন। কীভাবে প্রতিপক্ষকে কথার বাণে বিদ্ধ করা যায়। তাঁরা গরম বক্তৃতা দিয়ে দলের শীর্ষ নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। 

বিএনপি ১০টি বিভাগীয় শহরে গণসমাবেশ করার প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগও অনুরূপ কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। ইতিমধ্যে তারা চট্টগ্রাম ও যশোরে সমাবেশ করেছে। আগামীকাল ২৯ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ রাজশাহীতে গণসমাবেশ করবে। সভা–সমাবেশ করা যেকোনো দলের গণতান্ত্রিক অধিকার। কিন্তু এ কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে জনগণ যে বিপরীতমুখী অভিজ্ঞতা লাভ করছে, তার ব্যাখ্যা কী? রাজশাহীর সমাবেশ সফল করতে সেখানকার নেতারা দফায় দফায় বৈঠক করেছেন। তঁারা বলেছেন, বিএনপির সমাবেশে যে লোক হয়েছে, তার চেয়ে বেশি লোক আনতে হবে। সেটা তাঁরা আনতেই পারেন। এরই মধ্যে একটি খবর দেখলাম, আওয়ামী লীগের রাজশাহীর সমাবেশে নাটোর থেকে যেসব নেতা-কর্মী ও সমর্থক আসবেন, তাঁদের জন্য একটি বিশেষ ট্রেন ভাড়া করা হয়েছে। একদিকে বিএনপির সমাবেশ সামনে রেখে স্থানীয় পরিবহননেতাদের ধর্মঘট, রাস্তার মোড়ে মোড়ে তল্লাশি, মোবাইল ফোন ঘেঁটে দেখার নামে মানুষকে হয়রানি, অন্যদিকে আওয়ামী লীগের সমাবেশ উপলক্ষে বিশেষ ট্রেন ভাড়া দেওয়া হচ্ছে। সাধারণ মানুষ বিষয়টি কীভাবে দেখবে? তারা দেখবে সরকারের কথা ও কাজে কোনো মিল নেই। সরকার যে কারও প্রতি বিরাগ বা অনুরক্ত না হওয়ার প্রতিশ্রুতি তারা ভঙ্গ করছে। 

ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ উপনির্বাচনে সাবেক বিএনপি নেতা উকিল আবদুস সাত্তারকে জেতানোর জন্য আওয়ামী লীগ সর্বশক্তি নিয়ে মাঠে নামার পর প্রথম আলোর অনলাইনে লিখেছিলাম, ‘উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের “উকিল” মডেল।’ সরকারি ও বিরোধী দলের সমাবেশ ঘিরে সরকারের সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী আচরণ দেখে যে কথাটি বলতে হয় তা হলো, ‘গণতন্ত্রের আওয়ামী লীগ মডেল।’ 

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

sohrabhassan55@gmail.com