একটি বিকাশমান অর্থনীতি হিসেবে বাংলাদেশের বাণিজ্য ও উন্নয়ন অর্থায়নের জন্য আমাদের প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়োজন। আর সেই বিদেশি মুদ্রার প্রয়োজন মেটানোর অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স। তবে খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ইতিমধ্যে বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়লেও প্রবাসী আয়ের পুরোটা ব্যাংকের মাধ্যমে আসছে না। আমাদের প্রাক্কলিত বা সম্ভাব্য প্রবাসী আয়ের পরিমাণ প্রায় ৪৫-৫০ বিলিয়ন ডলার।
সম্প্রতি বৈধ পথে আসা প্রবাসী আয় বাড়লেও তা বছর বিবেচনায় ২৪ বিলিয়ন ডলারের কিছুটা ওপরে থাকতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ধারণা। অর্থাৎ সম্ভাব্য প্রবাসী আয়ের ৫৫ শতাংশের কিছু নিচে শুধু বৈধ বা অফিশিয়াল চ্যানেলে আসছে।
ব্যাংকিং চ্যানেলে বর্তমানে প্রতি ডলারের বিপরীতে ১২১ টাকা পাচ্ছেন প্রবাসীরা। অন্যদিকে খোলাবাজারে এই রেট সর্বোচ্চ ১২৩ দশমিক ৫০ টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর উদ্যোগে সম্প্রতি হুন্ডিতে সুবিধা করতে পারছে না হুন্ডি চক্র। অফিশিয়াল রেট ও হুন্ডির রেট কাছাকাছি চলে আসায় প্রবাসীরা বর্তমানে ব্যাংক চ্যানেলে টাকা পাঠাতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন। ফলে হুন্ডি বন্ধ করা গেলে বর্তমানে বছরে আসা ২৫ বিলিয়ন ডলারের প্রায় দ্বিগুণ প্রবাসী আয় আনয়ন সম্ভব।
বিগত সরকারের আমলে রেমিট্যান্স পাঠাতে সচেতনতা বাড়ানোর পদক্ষেপ গ্রহণের সুপারিশ করেছিল প্রবাসীকল্যাণ ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। বিদেশ থেকে দেশে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে হুন্ডি কারবারিদের দৌরাত্ম্য প্রতিরোধে ১০টি প্রতিবন্ধকতার কথা বলা হয়। প্রতিবন্ধকতাগুলো হলো বৈধ পথের তুলনায় অবৈধ পথে রেমিট্যান্স বিনিময় হারের ফারাক, প্রবাসী কর্মীর বৈধ কাগজপত্র না থাকা, প্রবাসে বাংলাদেশি বাণিজ্যিক ব্যাংকের শাখা না থাকা বা পর্যাপ্ত শাখার অভাব।
এ ছাড়া ওই সব দেশে বাংলাদেশি মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠান না থাকা বা পর্যাপ্ত মানি এক্সচেঞ্জ পয়েন্ট না থাকা, রেমিট্যান্স প্রেরণে উচ্চ ফি বা সার্ভিস চার্জ এবং নির্ধারিত সীমা (সিলিং), হুন্ডি কারবারিদের দৌরাত্ম্য, অনেক ক্ষেত্রে প্রবাসীদের বা প্রবাসীদের নিকটাত্মীয়দের দেশে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট না থাকা, আয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হলে রেমিট্যান্স প্রেরণে প্রতিবন্ধকতা, অননুমোদিত ব্যবসা বা কাজের আয় বৈধ পথে পাঠানোর সুযোগ না থাকা, বৈধ পথে রেমিট্যান্স প্রেরণে সচেতনতা ও উৎসাহের অভাবের বিষয়গুলোও উঠে আসে।
অনেকেই বলছেন, বৈধ পথে প্রবাসী আয় দেশে আনতে সব ধরনের প্রচেষ্টা কাজে লাগাতে হবে। বিদেশে বাংলাদেশের মিশনগুলোকে আরও তৎপর হতে হবে। এ কাজে কিছু দেশের মতো বিশ্বব্যাংকেরও সহায়তা নেওয়া যেতে পারে। হুন্ডিকে চতুরভাবে উৎসাহিত করার কাজে যুক্ত কিছু বাণিজ্যিক ব্যাংক বা তাদের কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
রপ্তানি আয় দ্রুত প্রত্যাবাসনসহ বাজারে সব উপায়ে ডলারের জোগান বাড়াতে হবে আর বিনিময় হারের স্থিতিশীলতা ধরে রাখতে হবে। প্রতিযোগিতামূলক বিনিময় হারের ওপর সার্বক্ষণিক দৃষ্টি রাখা ছাড়াও বৈধ পথে রেমিট্যান্স আনয়নে আরও অভিনব ও সুচিন্তিত ব্যবস্থা নিতে হবে। হুন্ডির কারণ নির্ণয়ে অনেক গভীরে চলে যেতে হবে। সেই সঙ্গে প্রবাসীদের প্রণোদনার বিষয়গুলোর দিকে নতুনভাবে দৃষ্টি দিতে হবে। প্রেরিত অর্থের যথাযথ বিনিয়োগ এমনকি এ ক্ষেত্রে নতুন ধরনের বিনিয়োগ পণ্যসেবার কথাও ভাবতে হবে। পুঁজিবাজারে প্রবাসীদের সহজ বিনিয়োগের বিষয়টি এখনো সুগম করা যায়নি।
অন্যদিকে আন্ডার-ওভার ইনভয়েসিংসহ যেসব মাধ্যমে মুদ্রা পাচার হয়, সেগুলো চিহ্নিত করতে হবে। এর সুবিধাভোগী কারা এবং কাদের সহায়তায় এটি হয়, তা খুঁজে বের করা খুব কঠিন কাজ নয়। দক্ষ জনশক্তি রপ্তানির মাধ্যমে প্রবাসী আয় বাড়ানোর পদক্ষেপ নেওয়ার পাশাপাশি বর্তমানে যাঁরা বিদেশে আছেন, তাঁদের বৈধতা প্রদানের উদ্যোগ নিতে হবে। যেসব ভোগান্তি আছে, তার সমাধান করতে হবে।
পত্রিকান্তরে জানা গেছে, গত বছরের শেষ দিকে অর্থ পাচারের নতুন নতুন গন্তব্য খুঁজে পায় বাংলাদেশ ব্যাংক। ইউরোপের দেশ পর্তুগালে অর্থ পাচারের ঘাঁটি গেড়েছে বাংলাদেশের আড়াই হাজার নাগরিকের একটি বিশাল চক্র। নিরাপদে অর্থ সরিয়ে নিতে তারা দেশটির নাগরিকত্বও নিয়েছে। এর মধ্যে তারা দেশটিতে সাড়ে ১৪ হাজার কোটি টাকা পাচার করেছে। মধ্যপ্রাচ্যের দুবাইয়ের পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ। বর্তমানে অর্থ পাচারের প্রধান রুট বা ‘সেফ হেভেন’ হিসেবে দেশটি ব্যবহৃত হচ্ছে।
পাচারকাজ পরিচালনার জন্য দুবাইয়ে ১৩ হাজার প্রতিষ্ঠান খুলেছেন বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা। সেখানে বিনিয়োগ করা হয়েছে ৬৫ হাজার কোটি টাকা। রাজনীতিবিদ ও আমলাদের অর্থ পাচারের বাহক হিসেবে কাজ করছে ব্যবসায়ী গোষ্ঠীগুলো। পতিত সরকারের প্রভাবশালীদের প্রশ্রয়ে আমদানি-রপ্তানির আড়ালে এবং হুন্ডির মাধ্যমে বিপুল অর্থ পাচার করে বিদেশে বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছে কয়েকটি শিল্প গ্রুপ।
ইতিমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে, বৈদেশিক মুদ্রা আয় করার অন্যতম প্রধান মাধ্যম জনশক্তি রপ্তানির মাধ্যমে রেমিট্যান্স সংগ্রহ। বর্তমানে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গঠনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়। দীর্ঘ সময় ধরে ধারাবাহিক পতন থেমেছে প্রবাসী আয়ের প্রবাহ বৃদ্ধি পাওয়ায়। এ কারণে ধীরে ধীরে প্রবাসী আয় বাড়ানোর জন্য পদক্ষেপ নিতে পরামর্শ দিচ্ছেন বিশ্বব্যাংকসহ বিশ্লেষকদের অনেকেই। এ ক্ষেত্রে দক্ষ জনশক্তি রপ্তানিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
পাশাপাশি নতুন নতুন দেশে জনশক্তি রপ্তানির পথ উন্মুক্ত করতেও কাজ করতে হবে। অনেকেই বলেছেন, বর্তমানে প্রবাসীরা যে পরিমাণ অর্থ দেশে পাঠাচ্ছেন, তার অন্তত ৯০ শতাংশ বৈধ পথে আনা গেলে রেমিট্যান্স প্রবাহে জোয়ার সৃষ্টি হবে। এর প্রভাবে বৈদেশিক মুদ্রাবাজার ও রিজার্ভ ইতিবাচক ধারায় ফিরবে।
হুন্ডি ও অন্যান্য মাধ্যমে রেমিট্যান্সের বড় অঙ্কই পাচার হয়ে যাচ্ছে। যার বার্ষিক অঙ্ক অন্তত ২৫ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ প্রবাসীদের দেশে পাঠানো রেমিট্যান্সের অর্ধেকের বেশি পাচার হয়ে যাচ্ছে। তবে এই নিয়ে সরকারি কোনো আনুষ্ঠানিক ঘোষণা কিংবা লিখিত হিসাব নেই।
দক্ষ কর্মী বিদেশে পাঠানো সময়সাপেক্ষ হলেও তাৎক্ষণিক পদক্ষেপের মাধ্যমে পাচার বন্ধ করে রেমিট্যান্সে প্রণোদনা সৃষ্টি করা সম্ভব। এতে চলমান ডলার–সংকট ও রিজার্ভের পতন দ্রুতগতিতে নিয়ন্ত্রণে আসবে। বিনিময় হার স্বয়ংক্রিয় প্রক্রিয়ায় প্রতিযোগিতামূলক করা গেলে বাড়তি সরকারি প্রণোদনার প্রয়োজন হবে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারিতে ব্যাংকিং চ্যানেলে দেশে রেমিট্যান্স আসে ২১১ কোটি ডলার, ফেব্রুয়ারিতে আসে ২১৬ কোটি ডলার, মার্চ মাসে আসে ১৯৯ কোটি ডলার, এপ্রিলে ২০৪ কোটি ডলার, মে মাসে ২২৫ কোটি ডলার, জুনে ২৫৪ কোটি ডলার, জুলাইয়ে ১৯১ কোটি ডলার এবং গত আগস্টে এসেছে ২২২ কোটি ডলার। আর সেপ্টেম্বরের ২৮ দিনে রেমিট্যান্স এসেছে ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স আসে ২ হাজার ৩৯২ কোটি ডলার। ২০২২-২৩ অর্থবছরে রেমিট্যান্স এসেছিল ২ হাজার ১৬১ কোটি ডলার। ২০২১-২২ অর্থবছরে মোট রেমিট্যান্স এসেছে ২ হাজার ১০৩ কোটি ডলার। কোভিডকালে ২০২০-২১ অর্থবছরে রেমিট্যান্স এসেছিল ২ হাজার ৪৭৭ কোটি ডলার, যা ছিল অর্থবছর হিসাবে সর্বোচ্চ পরিমাণ রেমিট্যান্স।
ইতিমধ্যে অনেকে বিমানবন্দরে প্রবাসীদের জন্য সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির কথা বলেছেন। এমনকি প্রবাসীদের ভিন্ন বা বিশেষ টার্মিনাল ব্যবহারের কথাও উঠে এসেছে। এটি একটি উত্তম প্রস্তাব। তার সঙ্গে বৈধ পথে আনা রেমিট্যান্সের পরিমাণ বিবেচনায় সার্টিফিকেট ইস্যু ও বিশেষ সেবা পাওয়ার বিষয়টিকে সম্পৃক্ত করা যেতে পারে। সেই সঙ্গে বিমানভাড়াকে আরও সাশ্রয়ী করা, বিমানে কেবিন ক্রুদের তাঁদের প্রতি আন্তরিক ব্যবহার এমনকি ‘স্যার’ সম্বোধনের ব্যাপারটি চালু করা যেতে পারে। এমনকি ইমিগ্রেশন পয়েন্টেও। এসব কারণে মুম্বাই কিংবা দিল্লি ট্রানজিট হয়ে গেলেও ভারতের ইনডিগো, ভিস্তারা এয়ারলাইনস ইতিমধ্যে বাংলাদেশের প্রবাসীদের কাছে প্রিয় হয়ে উঠেছে।
● মামুন রশীদ অর্থনীতি বিশ্লেষক