রম্যকথন

ফিফা কেন বাফুফেকে ভরা হাটে খাটো করতে চায়!

‘নিশিকুটুম্ব’ উপন্যাসে মনোজ বসু নতুন প্রজন্মের চোরদের চুরি নামক মহাবিদ্যার প্রতি ডেডিকেশনের অভাব দেখে বলেছিলেন, ওস্তাদ লেভেলের চোর নতুন বউয়ের গায়ের গয়না খুলে নিলেও তারা টের পায় না। ‘হাতের এমনিধারা মিহি কাজ’। আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘আজকাল ওসব নেই, কষ্ট করে কেউ কিছু শিখতে চায় না। নজর খাটো-সামনের মাথায় যা পেল কুড়িয়ে বাড়িয়ে অবসর। কাজেরও তাই ইজ্জত থাকে না-বলে, চুরি-ছ্যাঁচড়ামি।’

বাফুফের সাধারণ সম্পাদক আবু নাঈম সোহাগকে ফিফা নিষিদ্ধ করার পর মনোজ বসুর সেই কথাটাই মাথায় ঘুরছে: ‘নজর খাটো-সামনের মাথায় যা পেল কুড়িয়ে বাড়িয়ে অবসর’।

ফিফা বলছে, সোহাগ প্লেয়ারদের প্যান্ট–জার্সি, ফুটবল, বিমানের টিকিট, ঘাস কাটার মেশিন—এইসব কেনাকাটা করতে গিয়ে অনিয়ম করেছেন। ফিফা বোধ হয় জানে না, অমুক দপ্তর থেকে তিন হাজার কোটি গায়েব হয়ে গেছে, তমুক ব্যাংক থেকে দুই হাজার কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে—এই ধরনের খবর দিনের পর দিন পড়তে পড়তে আমাদের নজর এখন অনেক বড়। দুই চার পাঁচ কোটি টাকার অনিয়মের খবর আমরা গোনায় ধরি না। পত্রিকাও মামুলি খবর মনে করে তা ছাপতে চায় না।

এর মধ্য ফিফা আবু নাঈম সোহাগের বিরুদ্ধে অতি তুচ্ছ পরিমাণ টাকার কেনাকাটায় অনিয়মের কথা বলেছে। ফিফা যদি বাফুফের কোটি কোটি টাকার অনিয়ম নিয়ে কথা বলত, তাহলে দুঃখ থাকত না। কিন্তু এইভাবে তারা সোহাগের ‘খাটো নজর’ তুলে ধরায় মনে বড় ব্যথা পেয়েছি।

এর আগে সাফজয়ী মেয়েদের দলকে ‘টাকার অভাবে’ অলিম্পিক বাছাইপর্বে খেলতে পাঠাতে পারেনি বাফুফে। এ নিয়ে ফুটবলপ্রেমীরা সালাউদ্দিনের ওপর রেগে আছেন। তাদের ক্ষোভের রেশ এখনও কাটেনি। আজকে বাফুফের যে দশা তার জন্যও তারা সালাউদ্দিনকে দায়ি করছেন।

কুলীন কায়স্থ মৃত্যুঞ্জয় সাপুড়ের মেয়ে বিলাসীকে ‘নিকা’ করে ‘অন্নপাপ’ করার পর যেভাবে লোকে বলেছিল, ‘নালতের মিত্তির বলিয়া সমাজে আর তাঁর মুখ বাহির করিবার যো রহিল না’। ফিফা হয়তো ভেবেছিল, সোহাগের এই কেলেঙ্কারির ঘটনায় ঠিক সেই ধরনের কিছু একটা বলে বাফুফের কর্মকর্তারা লজ্জা পাওয়ার ভাব দেখাবেন।

অতি আনন্দের বিষয়, বাফুফের শীর্ষ কর্তারা সে ধরনের দুর্বল হার্টের পরিচয় দেননি। বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন একটা ডাল-ভাত টাইপের আলুনি এক্সপ্রেশন দিয়ে বলেছেন, ‘ভেরি স্যাড!’

বাফুফের সিনিয়র সহসভাপতি ও অর্থ কমিটির প্রধান সালাম মুর্শেদী কোনো ধরনের লজ্জা শরমের দিকে না গিয়ে সরাসরি বলেছেন, ‘বাফুফেতে কোনো দুর্নীতি হয়নি।’
সমস্যা হলো, ফিফা যেসব নথিপত্র দেখাচ্ছে, তা দেখে সোহাগের ‘হাতের কাজকে’ খুব একটা ‘মিহি’ বলা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে আসলেই তাঁর ‘নজর খাটো’।

নথিতে দেখা যাচ্ছে, ২০২০ সালের জুনে বাফুফের প্যান্ট-জার্সি কেনাকাটায় স্পোর্টস লিংক, স্পোর্টস কর্নার ও রবিন এন্টারপ্রাইজ নামের যে তিনটি প্রতিষ্ঠান দরপত্র দিয়েছিল তার মধ্যে মাল সরবরাহের কাজ পেয়েছিল স্পোর্টস লিংক। সোহাগ তাদের ৩০ হাজার ২৭ ডলারের (প্রায় ৩২ লাখ টাকা) মাল সরবরাহের কার্যাদেশ দিয়েছিলেন। ফিফার তদন্তে দেখা যাচ্ছে, ওই তিন প্রতিষ্ঠানই ছিল একই গোয়ালের গরু। নইলে তিনটি প্রতিষ্ঠানই কী করে ‘কোটেশনস’ শব্দটি ‘quotations’ বানানে না লিখে ভুল বানানে ‘Qutations’ লিখেছিল? তিনটি দরপত্রেরই ডিজাইন ছিল একই রকম। রবিন এন্টারপ্রাইজের যে ফোন নম্বর দেওয়া ছিল, সেটি ছিল ভুয়া।

এই ঘটনার আগে ২০২০ সালের জানুয়ারিতে ১৩ হাজার ৯২১ ডলার (প্রায় ১৫ লাখ টাকা) দামে ৪০০টি ফুটবল কিনেছিল বাফুফে। এখানেও দরপ্রস্তাব দিয়েছিল তিনটি প্রতিষ্ঠান। ফিফা বলছে, দরপ্রস্তাব জেতা প্রতিষ্ঠানটি যে ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছিল, সেখানে তাদের অস্তিত্ব নেই। সব কটি দরপ্রস্তাবই ছিল বানানো।

তারও আগে ২০১৯ সালে জাতীয় ফুটবল দলের ওমান সফরের জন্য বিমানের টিকিটের জনও দরপত্র দিয়েছিল তিনটি প্রতিষ্ঠান। তাদের মধ্য থেকে আল মারওয়া ইন্টারন্যাশনাল নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে ১৯ হাজার ৯২৫ ডলার (প্রায় সোয়া ২১ লাখ টাকা) দিয়েছিল বাফুফে। তিনটি দরপ্রস্তাবই শুরু হয়েছিল একই কথা দিয়ে, যেখানে রুট শব্দটি একই বানানে লেখা ‘rout’। সব কটিতে সংখ্যার ভুল ছিল একই রকম।

সবগুলোই জমা দেওয়া হয়েছিল একই তারিখে। সবগুলোই দেখতে ছিল একই রকম।

এ ছাড়া ঘাস কাটার যন্ত্র কেনাসহ আরও কেনাকাটায় এমন কিছু কাচা হাতের ঘাপলা ছিল যা অভিজ্ঞ চোরদের হতাশ করেছে। তাঁরা হয়তো বলবেন, খাটো নজরের আনাড়ি চোরদের হাতে পড়ে এতবড় মহাবিদ্যাটা একেবারে ছ্যাচড়া কাজের পর্যায়ে নেমে আসছে।

তাঁদের সম্ভাব্য প্রশ্ন: প্রথমত, এত কম টাকার কাজে সোহাগ হাত দিয়ে ‘ছোট নজরের’ পরিচয় দিলেন কেন? আর যদিও বা কাজে হাত দিলেন, কাজটাকে মিহিভাবে না সেরে দায়সারা ভাবে সারতে গেলেন কেন? সামান্য কয়েকটা ভুয়া দরপত্র ও রশিদ যে লোক ঠিকমতো বানাতে পারে না, তাঁকে দিয়ে বাফুফে আর কী আশা করতে পারে?

তবে সোহাগের কেলেঙ্কারির বিষয়ে কাজী সালাহউদ্দিন ও সালাম মুর্শেদী বেটা মানুষের মতো কথা বলেছেন। সোহাগের বিরুদ্ধে ফিফা কোড অব এথিকস লঙ্ঘনের আলামত পাওয়া গেছে। কিন্তু এই দুই অভিভাবক তার দায় নিতে রাজি হননি।

কয়েক বছর ধরে এই ঘটনার তদন্ত হয়েছে। বাফুফেকে ফিফা একাধিকবার সতর্ক করেছিল। কিন্তু কাজী সালাউদ্দিন সোহাগের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেননি। তিনি এখন বলছেন, এর বিন্দু বিসর্গ তাঁর জানা ছিল না। তিনি বিরাট বিবেকধর্মী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলছেন, ‘ভেরি স্যাড!’ তিনি বলেছেন, আবু নাঈম সোহাগ ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। এখানে সভাপতি হিসেবে তাঁর দায় নেওয়ার কিছু নেই। তারপরও তিনি ‘দায় আমাকেই নিতে হবে’ কথাটা এমনভাবে বলেছেন, তাতে মনে হয়েছে যেন ছাত্র অংকে ফেল করেছে, আর হতাশ লজিং মাস্টার বলছেন ‘হ্যাঁ, সব দায় আমারই, আমারই হয়তো দোষ…।’

আর সালাম মুর্শেদী বলছেন, ‘কোনো দুর্নীতি হয়নি।’

আর যার বিরুদ্ধে অভিযোগ, সেই আবু নাঈম সোহাগ আইনজীবীর মাধ্যমে ফিফার বিচারিক চেম্বারের রায়কে ‘ত্রুটিপূর্ণ’, ‘অনুমাননির্ভর’, ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ ও ‘পক্ষপাতদুষ্ট’বলেছেন। পাবলিক ভুল করে তাঁর সেই আখ্যাকে ভুল ব্যাখ্যা ভাবছে। সত্যিই তো তাঁরা কেন ভাবছে, ফিফা কেন বাফুফেকে ভরা হাটে খাটো করতে চায়। যদিও নিন্দুকেরা বলছে, সবাইকে কাটিয়ে সাধারণ সম্পাদক নয়ছয় করবেন, আর কেউ কিছু জানবেন না-এটা বিশ্বাস করা যায় না।

এর আগে সাফজয়ী মেয়েদের দলকে ‘টাকার অভাবে’ অলিম্পিক বাছাইপর্বে খেলতে পাঠাতে পারেনি বাফুফে। এ নিয়ে ফুটবলপ্রেমীরা সালাউদ্দিনের ওপর বেজায় রেগে আছেন। তাদের ক্ষোভের রেশ এখনও কাটেনি। আজকে বাফুফের যে দশা তার জন্যও তারা সালাউদ্দিনকে দায়ি করছেন।

কেউ কেউ বলছেন, বাফুফের ঘরে সিঁধ কেটে নজরখাটো সব নিশিকুটুম্ব ঢুকে পড়েছে; গোঁ ধরে চেয়ার গেড়ে বসে থেকে বাফুফের হর্তাকর্তারা ফুটবলের ভবিষ্যতকে মাঠের বাইরে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। বাফুফেকে নিশিকুটুম্ব ও আদুভাই মুক্ত করবে কে?

  • সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
    sarfuddin 2003 @gmail. com