নতুন শিক্ষাপদ্ধতি ও শিক্ষায় মেগা প্রকল্প

শিক্ষায় যে ব্যবস্থাটা এতকাল চলে এসেছে, সেটি বহু সংস্কারের পরও আর ফলপ্রসূ ছিল না। মূল কারণ, ছাত্রসংখ্যার বিপুল বৃদ্ধির সঙ্গে অবকাঠামো ও শিক্ষকের পরিমাণগত ফারাক। এর সঙ্গে ভাবতে হবে শিক্ষার কাছে যুগের দাবি। গত দেড় শ বছরে বিভিন্ন সময় এবং বাংলাদেশ আমলে প্রতিটি সরকার শিক্ষা সংস্কারে উদ্যোগী হয়েছিল। কিন্তু এর অধিকাংশ নিয়ে সংশ্লিষ্ট সব মহলের ঐকমত্য বা গরিষ্ঠাংশের সম্মতি মেলেনি। সরকারগুলোর আদর্শিক চিন্তাচেতনার বৈপরীত্য ও পার্থক্যের কারণেও শিক্ষা সংস্কারে ধারাবাহিকতা থাকেনি। এই সব প্রয়াস এখন অতীতের বিষয়।

বর্তমান সরকার দৃশ্যমান বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্পের প্রায় আড়ালে শিক্ষায় গুণগত সংস্কারে হাত দিয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ই এর মূল উদ্যোক্তা, তবে পুরো পরিকল্পনাটি মন্ত্রিপরিষদ অনুমোদন করেছে। প্রস্তুতি পর্বে সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো ওয়েবসাইটে দিয়ে জনমত যাচাইয়ের চেষ্টাও হয়েছে। বলা হচ্ছে, এখনো এটি পরীক্ষামূলক পর্যায়ে রয়েছে। প্রথমে ২০২২ সালে নির্বাচিত কিছু স্কুলে, তারপর গত বছর সারা দেশের দুটি শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম ও পদ্ধতি অনুযায়ী নতুন বই, পাঠপদ্ধতি ও মূল্যায়নপ্রক্রিয়া অনুসৃত হয়েছে। এ পর্যায়ে যেসব পরামর্শ, মতামত এসেছে, তা বিবেচনায় নিয়ে শিক্ষায় গুণগত পরিবর্তনের কাজটি এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এটি একটি ঐতিহাসিক ঘটনা।

ইংরেজ আমলে আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা চালুর পর এ দেশে গত দেড় শ বছরে শিক্ষার উন্নয়নে যত চেষ্টা হয়েছে, সেগুলো ছিল মেরামতি কাজ। কিন্তু এ দিয়ে মানসম্পন্ন শিক্ষার অভীষ্ট লক্ষ্য পূরণ হচ্ছিল না। এবারে হচ্ছে শিক্ষার খোলনলচে পাল্টানোর কাজ। নানা সমস্যা ও বাধা সত্ত্বেও বাংলাদেশ আর্থসামাজিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, সহস্রাব্দ লক্ষ্যমাত্রা পূরণে সফল হয়েছে, অপেক্ষাকৃত দুরূহ টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের প্রক্রিয়াও চলছে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০৪১ সাল নাগাদ বাংলাদেশ একটি উন্নত দেশে উত্তীর্ণ হবে, এমনটাই লক্ষ্য ধরা হয়েছে। সবাই বুঝি, এর জন্য উপযুক্ত শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। এটাও সবাই বুঝি যে এতকালের চলমান শিক্ষা সেই কাঙ্ক্ষিত ‘উপযুক্ত শিক্ষা’ নয়।

অনেক দিন ধরেই বর্তমান শিক্ষার অকার্যকারিতা দেখে মানসম্পন্ন শিক্ষার কথা আলোচিত হলেও কেবল স্কুল পর্যায়ে চার কোটির অধিক শিশুর জন্য এ শিক্ষার ব্যবস্থা করা যায়নি। তাতে আমাদের উন্নত দেশে উন্নীত হওয়ার লক্ষ্য পূরণ হুমকির মুখেই রয়েছে। বর্তমান শিক্ষা বস্তুতপক্ষে নির্ধারিত কিছু প্রশ্নভিত্তিক পরীক্ষার ফলাফলে সীমাবদ্ধ। শিক্ষার্থী স্কুলে ও কোচিং সেন্টারে নিরন্তর পরীক্ষা দিয়ে মুখস্থ উত্তর লিখে ভালো নম্বর পেয়ে সার্থকতা অর্জন করে। কিন্তু প্রশ্ন বা উত্তর সবই অন্যের তৈরি করা। এ এমন ব্যবস্থা, যাতে পুরো শিক্ষাজীবনে একজন শিক্ষার্থীর ভাবনা, বিশ্লেষণ বা প্রশ্ন করাসহ কোনো কিছুর সুযোগ নেই, প্রয়োজনও নেই।

এতে শিক্ষা যে কেবল নিরানন্দের কাজে পরিণত হয়েছে তা নয়, এ শিক্ষা জ্ঞানের প্রতি কোনো আগ্রহও জাগাতে পারে না। এর ভেতর দিয়ে জীবনের অতি গুরুত্বপূর্ণ গঠন পর্ব অতিবাহিত করে কারও অন্তর মহত্তর ও উচ্চতর ভাবনা ও আদর্শে উজ্জীবিত হতে শেখে না। এর ফলে দেশপ্রেম, মানবতাবোধসহ ব্যক্তিগত দক্ষতা অর্জন এবং জীবনাদর্শ ও লক্ষ্য তৈরি কঠিন হয়ে পড়ে।

২.

নতুন পদ্ধতিতে অভিজ্ঞতার মাধ্যমেই শিক্ষার্থীর জ্ঞান অর্জিত হয়। শিক্ষার্থীদের শ্রেণি অনুযায়ী বিষয়ভিত্তিক যোগ্যতার মানদণ্ড নির্ধারিত আছে। ফলে একে বলা যায় অভিজ্ঞতার মাধ্যমে যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষা। এই পদ্ধতির সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো এতে এতকালের নিষ্ক্রিয় শিক্ষার্থী রূপান্তরিত হচ্ছে সক্রিয় শিক্ষার্থীতে। চারটি ধাপের মাধ্যমে তারা কোনো একটি বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করে। বিষয়টি একটি দৃষ্টান্তের মাধ্যমে তুলে ধরা যায়। তাদের একটি বিষয়ের নাম জীবন ও জীবিকা। এ বিষয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য নির্ধারিত একটি যোগ্যতা সংক্ষেপে এ রকম—কোনো কাজ/অনুষ্ঠানের বাজেটসহ পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব গ্রহণ ও দক্ষতার সঙ্গে তা সম্পাদন করতে পারা।

এবার পর্যায়ক্রমে চারটি ধাপের মাধ্যমে শিক্ষার্থী এ যোগ্যতা অর্জন করবে:

প্রথম ধাপ—অভিজ্ঞতা: আমরা জানি, নানাভাবে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন বিষয়ে অভিজ্ঞতা অর্জন করে। সরাসরি স্কুলের অভিজ্ঞতা দিয়েই শুরু করা যায়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তারা যেসব অনুষ্ঠান দেখেছে, সেগুলো সম্পর্কে নিজেদের অভিজ্ঞতা আলোচনা করবে। সুযোগ থাকলে তাদের একটি অনুষ্ঠান সরাসরি কিংবা ভিডিওতে দেখানো যায়। এবার তারা আলোচ্য অনুষ্ঠানের সবল ও দুর্বল দিকগুলো খুঁজে বের করবে। শিক্ষার্থীরা তাদের অভিজ্ঞতার আলোকে অনুষ্ঠানটি নিয়ে বিস্তারিত বা অনুপুঙ্খ পর্যালোচনা করবে। আলোচনায় যাতে বাজেট, সূচি, অনুষ্ঠানের মান ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক নানা বিষয় আলোচিত হয়, সে অনুযায়ী শিক্ষক গাইড করবেন।

দ্বিতীয় ধাপ—ভাবনা: এবার শিক্ষার্থীরা ওপরে বর্ণিত অভিজ্ঞতার আলোকে অনুষ্ঠানটি আরও সুন্দর, আকর্ষণীয় ও কার্যকর করার লক্ষ্যে কী কী করা যেত বা যায়, তা দলগত আলোচনার মাধ্যমে বুঝে নেবে। শিক্ষকের পরামর্শে তারা বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বলতেও পারে। অর্থাৎ কীভাবে আয়োজন করলে নিখুঁত একটি অনুষ্ঠান হতে পারে, তারা সেই ভাবনা উপস্থাপনের সুযোগ পাবে। শিক্ষার্থীরা তাদের অভিজ্ঞতা থেকে আয়োজনটিকে সাজানোর চেষ্টা করবে। এ কাজ যেমন দলগতভাবে করবে, তেমনি কাজের বিভিন্ন অংশ এককভাবেও করতে পারবে। একটি পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনার ক্ষেত্রেও এ কথা খাটবে।

তৃতীয় ধাপ—ধারণা: কোনো অনুষ্ঠান নিখুঁতভাবে আয়োজন সম্পর্কে শিক্ষার্থীকে দক্ষ করে তোলার জন্য শিক্ষক তাদের বিভিন্ন ধরনের তথ্য সরবরাহ করবেন। এর পাশাপাশি তিনি তাদের এ বিষয়ে বিস্তারিত জানার জন্য আরও বই, পত্রপত্রিকা, ভিডিও অথবা উপযুক্ত কোনো ব্যক্তির কাছ থেকে বিস্তারিত জানার সুযোগ করে দেবেন। এভাবে প্রাপ্ত সব তথ্য শিক্ষার্থীর অভিজ্ঞতা ও ভাবনার মাধ্যমে অর্জিত শিখনকে আরও সুদৃঢ় ও সুসংহত করে তুলবে, যা বিষয়টি সম্পর্কে আরও সুস্পষ্ট ধারণা অর্জনে সহায়ক হবে। এই পর্যায়েও শিক্ষার্থীরা একক ও দলগতভাবে কাজ করতে পারবে।

চতুর্থ ধাপ—প্রয়োগ: এ পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের অর্জিত জ্ঞান, দক্ষতা, মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োগ ঘটিয়ে নিজ প্রতিষ্ঠানে একটি অনুষ্ঠান আয়োজনের সুযোগ দেওয়া যায়। এবার তাদের অভিজ্ঞতা, চিন্তা ও চর্চায় অর্জিত জ্ঞান এবং তার ভিত্তিতে সৃষ্ট ধারণার বাস্তব প্রয়োগ ঘটাবে শিক্ষার্থীরা। এভাবে তাদের শিখন অভিজ্ঞতাটি একটি পূর্ণাঙ্গ রূপ পাবে এবং শিক্ষার্থীর স্থায়ী শিখন নিশ্চিত হবে। ফলে পরবর্তী সময়ে শিক্ষার্থীরা তাদের এই সামর্থ্যকে কাজে লাগিয়ে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনে অন্যান্য যেকোনো অনুষ্ঠান আয়োজনের যোগ্যতা অর্জন করবে। এমনকি কেউ কেউ বা অনেকেই আরও বড় পরিসরে জাতীয় বা রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান আয়োজনের আত্মবিশ্বাসও অর্জন করবে। অর্থাৎ এভাবে অর্জিত জ্ঞান তারা বৃহৎ বা উচ্চতর কোনো কাজেও লাগাতে পারবে।

এই চার পর্যায়েই শিক্ষার্থীদের প্রচুর খসড়া এবং বেশ কয়েকটি চূড়ান্ত প্রতিবেদন লিখতে হবে। এভাবে চিন্তা, পঠন, অন্বেষণ, গবেষণা, আলোচনা, লেখা ইত্যাদি জ্ঞানার্জনের বিভিন্ন কাজ তারা করবে। সহজ ও সরল থেকে জটিল ও সূক্ষ্ম চিন্তন, লেখার অভ্যাস তাদের নিয়মিত পাঠাভ্যাস গড়ে তুলবে, যা জীবনব্যাপী বজায় থাকবে।

৩.

আদতে নতুন শিক্ষাপদ্ধতির সাফল্যের পথে বড় চ্যালেঞ্জ হলো শিক্ষকদের এ বিষয়ে উদ্বুদ্ধকরণ ও উপযুক্ত প্রশিক্ষণ। যেহেতু দেশে স্কুল পর্যায়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৪ কোটির ওপরে ও স্কুলের সংখ্যা দেড় লাখের ওপরে এবং শিক্ষকের সংখ্যা ১০ লাখের ওপরে, তাই কাজটা অনেক ব্যাপক। আবার শিক্ষকদের যেহেতু শতাব্দীপ্রাচীন এক অভ্যস্ত ধারা থেকে একেবারে নতুন ধারায় আসতে হবে, তাই প্রশিক্ষণেরও ব্যাপ্তি, গভীরতা ও পুনরাবৃত্তি প্রয়োজন হবে। কেবল তাতেই হবে না, এ পদ্ধতিতে কোচিংয়ের প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে। আদতে এ পদ্ধতিতে একদিকে শিক্ষকদের বাড়তি উপার্জনের সুযোগ চলে যাবে, অন্যদিকে তাঁদের কাজও বাড়বে। শিক্ষক সহায়িকা (টিজি) অনুযায়ী নিজের প্রস্তুতি, পাঠপরিকল্পনা, পাঠে সহযোগিতা, মূল্যায়ন ইত্যাদি প্রতিটি কাজেই তাঁদের দক্ষ হতে হবে, হালনাগাদ থাকতে হবে। কম্পিউটারভিত্তিক বহু ধরনের কাজও তাঁদের করতে হবে। ফলে শিক্ষকদের বেতন-ভাতা বাড়াতে হবে—এটি নতুন পদ্ধতির সাফল্যের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত বিষয়। আশার কথা, এ বছরের বই উৎসবে প্রধানমন্ত্রী মানসম্পন্ন শিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় সব অর্থসংস্থানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

ফলে শিক্ষক সমিতিগুলোর উচিত হবে নতুন পদ্ধতির বিরোধিতায় না নেমে এটি সফলভাবে বাস্তবায়নের করণীয় সম্পর্কে সদস্যদের পরামর্শ প্রদান। সঙ্গে অবশ্যই উপযুক্ত বাজেট বরাদ্দের প্রস্তাবও থাকা দরকার। এই সঙ্গে বলতে হবে, অভিভাবকদেরও উদ্বুদ্ধকরণের ব্যবস্থা নিতে হবে। কেননা শিক্ষার কাজে সামাজিক সমর্থন জরুরি। সবাই মিলে শিক্ষায় মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের দাবি তোলা এখন সময়ের জরুরি কাজ।

৪.

নতুন পদ্ধতি সত্যিই সব কাজেই নতুনত্বের দাবি নিয়ে এসেছে। এ পদ্ধতি অনুযায়ী পাঠ্যপুস্তক রচনা, শিক্ষক প্রশিক্ষণ সম্পাদন বা মূল্যায়নপ্রক্রিয়া চূড়ান্তকরণ রাতারাতি হবে না, তবে প্রক্রিয়াটি চালু হওয়ার পর সব ক্ষেত্রে অগ্রগতি হচ্ছে। আরেকটি চ্যালেঞ্জ হলো স্কুলের অবকাঠামোগত উন্নয়ন, ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত ঠিক রাখা, শিক্ষাসহায়ক সুযোগ-সুবিধা (যেমন মাঠ, বিজ্ঞান ল্যাব, গ্রন্থাগার ইত্যাদি) বাড়ানো। সে অনুযায়ী দক্ষ লোকবল বৃদ্ধি। মোটকথা, শিক্ষায় প্রকৃত বাজেট বরাদ্দ ইউনেসকোর প্রস্তাব অনুযায়ী জিডিপির ৬ শতাংশ না হলেও বর্তমান ২ শতাংশের নিচে থাকা যাবে না, অন্তত আগামী বছরই তা ৪ শতাংশে তোলা দরকার।

এর বাইরে উন্নয়ন প্রকল্পের মতোই শিক্ষায় একাধিক মেগা প্রকল্প হাতে নেওয়া জরুরি। তার মাধ্যমেই গ্রন্থাগারসহ অন্যান্য সুবিধা তৈরি করা সম্ভব হবে। একবিংশ শতাব্দী ও ভবিষ্যতের উন্নত বাংলাদেশের উপযুক্ত নাগরিক তৈরি করতে হলে নতুন শিক্ষাপদ্ধতি সফল করার বিকল্প নেই।

আবুল মোমেন কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক