দেশে তখন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন। রাজধানী কলকাতা (তখন বলত কলিকাতা বা ক্যালকাটা)। বাংলার রাজস্ব আদায় নিয়ে নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। বড় লাট হয়ে এলেন লর্ড কর্নওয়ালিশ। ১৭৯৩ সালে তিনি চালু করলেন ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’। এই আইনের অধীন জমিতে জমিদার বা ভূস্বামীদের ব্যক্তিগত মালিকানা স্বীকৃত হলো। রায়ত বা প্রজাদের কাছ থেকে জমিদার নির্দিষ্ট হারে জমির খাজনা তুলবেন। তার একটি অংশ নিজের কাছে রেখে বাকিটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কোম্পানি তথা সরকারের কাছে জমা দেবেন।
জমিদার শুধু জমির মালিক হলেন না; তিনি প্রজাদেরও মালিক। তিনি হলেন দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। তাঁর ইচ্ছা-অনিচ্ছাই সব। তাঁর কথায় সূর্য ডোবে, চাঁদ ওঠে। প্রজার সন্তান স্কুলে যাবে কি না, বিয়েশাদি কোথায় হবে—এটিও তিনিই ঠিক করে দেন। এখান থেকেই এই শব্দগুচ্ছ চালু হয়েছে—‘হুজুর মা-বাপ’। জমিদারদের কেচ্ছাকাহিনি নিয়ে জমীদার দর্পণ নামে একটি স্যাটায়ারধর্মী নাটক লিখেছিলেন কুষ্টিয়ার মীর মশাররফ হোসেন। এটি ১২৭৯ বঙ্গাব্দে কলকাতায় প্রকাশিত হয়। এই নাটকে প্রজার প্রতি জমিদারের নিষ্ঠুরতা ও লাম্পট্যের বিবরণ আছে। এখানে জমিদারের নাম হায়ওয়ান। এর অর্থ জানোয়ার। লেখক ইচ্ছা করেই ঘৃণাবশত এই নাম রেখেছেন। নাটকের চারটি লাইন এ রকম:
মরি দুর্ব্বল প্রজার পরে অত্যাচার।/ কত জনে করে করে জমীদার/ জমীদার ধরে, জরিমানা করে,/ মনে সাধ পুরে, নাশিছে প্রজার।
১৯৫০ সালে এ দেশে আইন করে জমিদারি আইন বাতিল করা হয়। আইন বাতিল হলে কী হবে! প্রথা রয়ে গেছে আজও। দেশের প্রায় সব জায়গায় এই জমিদারেরা আছেন। নিজ নিজ এলাকায় তাঁদের প্রবল প্রতাপ। তাঁদের সালাম না দিয়ে বা উপেক্ষা করে সাধারণ মানুষ মানসম্মান নিয়ে নিরাপদে বসবাস করতে পারেন না। তাঁদের বলা হয় এমপি। কিছু ব্যতিক্রম থাকতে পারে।
একজন এমপির হাতে আছে আলাদিনের চেরাগ। তাঁর অসীম ক্ষমতা। উপজেলা পরিষদ তাঁর কথায় চলে। ইউনিয়ন পরিষদ তো নস্যি। কে চেয়ারম্যান-ভাইস চেয়ারম্যান হবে, কে মেম্বার হবে, তিনি ঠিক করে দেন। ঢাকার খবরের কাগজগুলোয় অনেক সময় ছাপা হয়, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে প্রতিদ্বন্দ্বীরা হলেন সিটিং এমপি বা এমপি–প্রত্যাশীদের নমিনি।
এমপিরা প্রায় সবাই রাজধানীতে থাকেন। তাঁদের জন্য এখানে সরকারি ফ্ল্যাট আছে। তবে তাঁদের বেশির ভাগই সেখানে থাকেন না। সেখানে থাকে তাঁদের চাকর-বাকর বা জ্ঞাতিগুষ্টির লোক। রাজউকের আবাসন প্রকল্পে তাঁদের জন্য প্লট বরাদ্দ হয়। বিনা শুল্কে তাঁরা গাড়ি আমদানির সুযোগ পান। বড় বড় দামি গাড়ি। অনেকেই আবার সেটা বেচে দেন। মাছের তেলে মাছ ভাজা আরকি।
একজন এমপি যখন তাঁর এলাকায় যান, তাঁর বাড়িতে স্থানীয় নেতা-পাতিনেতাদের ভিড় লেগেই থাকে। তাদের বেশির ভাগের পেশা ব্যবসা, ঠিকাদারি ও তদবির–বাণিজ্য। তাঁকে ঘিরে চলে একটি ‘নেক্সাস’, দুর্বৃত্তায়ন–প্রক্রিয়া। তিনি যখন হাঁটেন, তাঁকে ঘিরে থাকে এসব লোক। তিনি গাড়িতে চললে আগে–পিছে থাকে মোটরসাইকেলের বহর। দেখলেই বোঝা যায়, রাজধানী থেকে লাটসাহেব এসেছেন।
একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল। কয়েক বছর আগের কথা। তখন নানান চ্যানেলে টক শোতে নিয়মিত অংশ নিতাম। সেখানেই মাঝেমধ্যে এমপি সাহেবরা আসতেন। তো এ রকম একটা শোতে কবি রেজোয়ান সিদ্দিকী আর আমি ছিলাম। শুনলাম আরেকজন আসবেন। তো তিনি এলেন। সঙ্গে আরও তিনজন। একজন তাঁর বডিগার্ড, একজনের হাতে তাঁর অ্যাটাচি ব্যাগ, একজনের হাতে মোবাইল ফোন। তিনি সরাসরি ফোন ধরেন না। ফোন এলে ফোনবরদার নেতার দিকে তাকিয়ে বলেন, বস, অমুক কথা বলতে চায়। ‘কাল দুপুরে ফোন করতে বল, আমি এখন একটা বিয়েবাড়িতে আছি।’ আমরা দুজন যে এখানে বসে আছি, তাঁর ভ্রুক্ষেপ নেই। আপাদমস্তক দুর্বিনীত।
রেজোয়ান সিদ্দিকী খেদের সঙ্গে আমাকে কানে কানে বললেন, ‘ব্যাটা আস্ত বেয়াদব। আমরা দুজন বয়োজ্যেষ্ঠ লোক বসে আছি, একটা সালাম পর্যন্ত দিল না।’ শো শুরু হলে পরিচয় পেলাম, তিনি একজন এমপি। রেজোয়ান সিদ্দিকী কিছুদিন আগে প্রয়াত হয়েছেন। ভদ্রলোক ছিলেন।
একজন এমপির হাতে আছে আলাদিনের চেরাগ। তাঁর অসীম ক্ষমতা। উপজেলা পরিষদ তাঁর কথায় চলে। ইউনিয়ন পরিষদ তো নস্যি। কে চেয়ারম্যান-ভাইস চেয়ারম্যান হবে, কে মেম্বার হবে, তিনি ঠিক করে দেন। ঢাকার খবরের কাগজগুলোয় অনেক সময় ছাপা হয়, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে প্রতিদ্বন্দ্বীরা হলেন সিটিং এমপি বা এমপি–প্রত্যাশীদের নমিনি।
উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে এখন অনেক বাজেট বরাদ্দ হয়। রাস্তা, কালভার্ট, সেতু তৈরির মচ্ছব চলে। প্রয়োজন না থাকলেও এসব বানাতে হবে। বাড়ির উঠানে, ধানখেতের মধ্যে, যেখানে খুশি কালভার্ট বানিয়ে রাখা হচ্ছে। আশপাশে কোনো রাস্তা নেই। প্রকল্প মানেই টাকা। সেখানে এমপি, স্থানীয় সরকারের কর্মকর্তা আর দলীয় ঠিকাদারের এক অদ্ভুত মেলবন্ধন।
রাজধানী থেকে সব নিয়ন্ত্রণ করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধীন এলজিইডি। এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকেন সরকারি দলের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা। জনগণের করের টাকায় দলের লোকদের পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়াই এই মন্ত্রণালয়ের প্রধান কাজ। এসব প্রকল্প সরকারপ্রধানের উপস্থিতিতে একনেকে পাস হয়। প্রকল্পের প্রস্তাব পাঠান এমপি সাহেবরা। কোনো সময় যদি কোনো এমপি প্রধানমন্ত্রীকে তাঁর এলাকায় নিয়ে একটা জনসভায় ভাষণ দেওয়াতে পারেন, তাহলে তো কেল্লা ফতে। প্রধানমন্ত্রীর হাতে তিনি ‘উন্নয়নের’ একটা ফর্দ তুলে দেন। প্রধানমন্ত্রী সেই ফর্দ থেকে পাঠ করেন। ব্যস, হয়ে গেল। এগুলো হয়ে যায় প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকার প্রকল্প। কার ঘাড়ে কয়টা মাথা যে সেটির জন্য বরাদ্দ পাওয়া যাবে না?
এমপি সাহেবরা সংবিধান পড়েন না। হয়তো সংবিধান চোখেই দেখেননি। দেখলেও পাতা ওলটাননি। তাঁর কাজ যে সংসদে আইন পাস করা ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিতর্ক করা, এটি তিনি জানেন না। তিনি প্রচুর বিনিয়োগ করে সংসদ সদস্য হন। প্রথমেই দলের মনোনয়ন কিনতে অনেক টাকা ঢালেন। মনোনয়ন পাওয়ার পর শুরু হয় তাঁর অ্যাকশন। ভাড়াটে মাস্তানদের কাজে লাগিয়ে দেন। তাদের জন্য থাকে বরাদ্দ—ন্যূনতম একটা মোটরবাইক আর দৈনিক ভাতা। এদের পুষতে হয় দেড়-দুমাস। এখন ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনেও কয়েক কোটি টাকা খরচ হয়। সংসদ নির্বাচনে একজন প্রার্থী কত খরচ করেন, তা একমাত্র আলিমুল গায়েবই জানেন।
একবার এমপি হয়ে গেলে তিনি হয়ে যান এলাকার জমিদার, লাট। তাঁর প্রতাপে এবং তাঁর চেলাচামুণ্ডাদের ভয়ে উপজেলা পর্যায়ে অনেক কর্মকর্তা নিয়মমাফিক কাজ করতে পারেন না। তাঁরা একটু আইনানুগ হওয়ার চেষ্টা করলেই তাঁদের ওপর নেমে আসে গজব। ধমকানো, গায়ে হাত তোলা, বদলির হুমকি—এসব দেখে অনেকেই আতঙ্কে থাকেন। অনেকেই স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে তদবির করে কর্মস্থল পাল্টান, অনেকেই নিজেকে নিরাপদ রাখতে স্থানীয় দুর্বৃত্তায়নের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। আর তাঁদের মধ্যে কিছু মন্দ লোক তো আছেনই।
উপজেলা পরিষদ ও ইউনিয়ন পরিষদ হচ্ছে আমাদের দেশের স্থানীয় সরকারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্তর। আমরা অনেকেই বুঝতে চাই না, স্থানীয় সরকারও একটা সরকার। এটি হতে হয় স্বশাসিত। পশ্চিমের ও পুবের সভ্য দেশগুলোয় আছে এ রকম ব্যবস্থা। আমাদের কর্তারা নানান প্রশিক্ষণের নাম করে পাবলিকের টাকায় এসব দেখতে যান। কিছুই শেখেন বলে মনে হয় না। আমাদের দেশে স্থানীয় সরকারকে কেন্দ্রীয় সরকারের ‘অ্যাপেন্ডিক্স’ বানিয়ে রাখা হয়েছে। ওপরের স্তরের সিদ্ধান্ত গ্রাম, ইউনিয়ন, উপজেলা পর্যায়ে বাস্তবায়নের জন্যই ইউনিয়ন ও উপজেলা পরিষদকে ব্যবহার করা হয়। সবার ওপরে সিন্দাবাদের দৈত্যের মতো চেপে বসে আছেন এমপি। সরকার যায়, সরকার আসে; কিন্তু এই ব্যবস্থা বদলায় না।
আমরা গণতন্ত্রের কথা বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলে ফেলি। কিন্তু স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করার চিন্তা কারও মধ্যে দেখি না। সরকারের যে কাঠামো, তা গণতান্ত্রিক বিধিব্যবস্থার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। স্বশাসিত স্থানীয় সরকারকে মন্ত্রী, এমপি, কর্মকর্তারা এমন নজরে দেখেন, মনে হয় যেন তাঁদের আঙিনায় কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী ঢুকে গেছে, যেন তাঁদের ভাগে কম পড়বে। সব জায়গায় একটা দখলি স্বত্ব বজায় রাখার আপ্রাণ চেষ্টা।
আমরা দেখেছি, রাজনৈতিক সরকারগুলো একেকটা সিন্ডিকেট। তারা সব ক্ষমতা নিজেদের গোষ্ঠীর মধ্যে রেখে দিতে চায়। নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলাম, তো আমি সব পেয়ে গেলাম। তাঁদের ‘হাম কেয়া হনু রে’ ভাব দেখে মনে হয়, তাঁরা আসমান থেকে নাজিল হয়েছেন। তাঁরা ভোটের আগে হয়ে যান বিনয়ের অবতার। ভোট ফুরালেই আঙুল উঁচিয়ে জনগণকে চোখরাঙানি দেন।
ইদানীং সংস্কার শব্দটি বেশ চাউর হয়েছে। তো স্থানীয় সরকার নিয়ে কর্তাদের চিন্তাভাবনা কী, সেটা জানা দরকার। বিশেষ করে এমপিদের জমিদারি প্রথা কি বহাল থাকবে, নাকি তাঁরা স্থানীয় প্রশাসন থেকে সম্পূর্ণ বিযুক্ত হয়ে আইন প্রণয়নের কাজে নিজেদের নিয়োজিত রাখবেন, সংসদে জাতীয় ও জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা ও বিতর্ক করবেন, সে ব্যাপারে একটা মীমাংসা হওয়া দরকার। এ ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান স্পষ্ট হওয়া উচিত।
● মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক