কোটা নিয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের প্ল্যাটফর্মের আনুষ্ঠানিক নাম ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’। ‘বৈষম্যবিরোধী’ কথাটা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। দেশে যখন এত এত খাতে বৈষম্য তৈরি হয়েছে, ‘বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন’ সংগত কারণেই সরকারকে চিন্তায় ফেলেছে। কোটা সংস্কার ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সম্পর্ক নিয়ে লিখেছেন আফসানা বেগম
‘বাবুমশাই, জীবন গুরুত্বপূর্ণ হতে হবে, কেবল লম্বা নয়!’
‘আনন্দ’ সিনেমার বিখ্যাত এই ডায়ালগ লেখা ছিল তাঁর শেষ ছবিতে। মুগ্ধ নামের ছেলেটির নাতিদীর্ঘ জীবন আজ গুরুত্বপূর্ণ বটে। কারণ, তাঁর বেঁচে থাকাকে বিপদ মনে করা হয়েছে। মুগ্ধর মতো অনেককে নির্বিচারে মারা হয়েছে। কয়েক দিনে এ তালিকা দীর্ঘ হয়েছে কেবল।
দেশ ঠিকঠাকমতোই চলছিল (মানে এমনিতে যেমনটা চলে, সবার কাছে ঠিক লাগে)—এ অভিনয় নাগরিকদের দীর্ঘকালের। এর মধ্যে কিনা ছাত্রছাত্রীরা বিশৃঙ্খলা তৈরি করেছেন; তাঁরা বৈষম্য দূর করার দাবি তোলেন। ‘রাজাকারের বাচ্চা, নাতি’—এসব খেতাব জুটে যায় তাঁদের কপালে।
এটা অবশ্য নতুন নয়। ২০১৮ সালে যখন সরকারি চাকরির কোটাপ্রথা সংস্কারের জন্য ছাত্ররা আন্দোলন করেছিলেন, তখনো সংসদে প্রশ্ন তোলা হয়েছিল, ‘মুক্তিযোদ্ধার সন্তানেরা সুযোগ পাবে না, রাজাকারের বাচ্চারা সুযোগ পাবে? তাদের জন্য মুক্তিযোদ্ধা কোটা সংকুচিত হবে?’
অনেকে অবাক হয়েছেন, একটা দেশে এতগুলো মানুষ শুধু সরকারি চাকরির জন্য এতটা মোহগ্রস্ত হতে পারে! তাঁদের কথার সুর এমন, এ আন্দোলন তো হচ্ছে বেশি বেশি সরকারি চাকরি পাওয়ার জন্য। সরকারি চাকরিতে ক্ষমতা আছে, দুর্নীতি করার লাইসেন্স মেলে আর তা দিয়ে বানানো যায় অঢেল সম্পদ। এ জন্যই সরকারি চাকরির কোটা নিয়ে এত চেঁচামেচি।
আরেকবার ভেবে দেখুন, ছাত্রদের আন্দোলন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ল, সেটা কি শুধু এ কারণেই? বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা, সরকারি চাকরির প্রতি যাঁরা তুলনামূলকভাবে কম আগ্রহী কিংবা বিসিএস না দিয়ে যাঁরা আইইএলটিএস বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা করছেন, তাঁরাও কেন এক স্বরে কথা বলতে লাগলেন? কেবল চাকরিপ্রার্থীরা নন, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা পর্যন্ত কোন মন্ত্রে আন্দোলনের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেল? এ কি কেবল কোটা সংস্কারের আন্দোলনের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল?
কোটা নিয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের প্ল্যাটফর্মের আনুষ্ঠানিক নাম ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’। ‘বৈষম্যবিরোধী’ কথাটা বেশ তাৎপর্যপূণ। সরকারি চাকরিতে অসামঞ্জস্যপূর্ণ অগ্রাধিকারসহ কথিত দুর্নীতির মাধ্যমে দেশের মানুষের মধ্যে আয়-ব্যয়ের বিপুল ব্যবধান তৈরি করা হয়েছে। অর্থ পাচারের মাধ্যমে কিছু ব্যাংক প্রায় অচল হয়ে গেছে।
দেশে যখন এত এত খাতে বৈষম্য তৈরি হয়েছে, ‘বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন’ সংগত কারণেই সরকারকে চিন্তায় ফেলেছে। আন্দোলনকারীদের দমাতে সরকার তাই তার অনুগত বাহিনীগুলো দিয়ে সর্বশক্তি প্রয়োগ করেছে।
সরকারের অবশ্য চিন্তা নেই; অনুগত বাহিনীর মতো আছে অনুগত মুখপাত্র ও প্রচারমাধ্যম। তাদের কাজই হলো দিন শেষে যেকোনো ঝামেলার জন্য বিরোধীদের দায়ী করা। তাদের মুখে মুখেই সমস্যা চিহ্নিত হয়, তারপর মুখে মুখেই তদন্ত শেষ করে ‘রায়’ দেওয়া হয়। যেমন কেউ একজন বলেন, এই কোটা আন্দোলনের পেছনে রয়েছে বিএনপি-জামায়াতের ইন্ধন।
এরপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্তারাও বলতে থাকেন, তাঁদের সব জানা আছে। এই আন্দোলনের পেছনে জামায়াত-শিবির আর বিএনপির কোন কোন নেতা কোথা থেকে কলকাঠি নাড়ছেন। তাঁদের কাছে নাকি দুষ্কৃতকারীদের তালিকাও আছে। অবিলম্বে তিনি তালিকা ধরে ধরে গ্রেপ্তার করবেন। কিন্তু দেখা গেল, গুলিতে হতাহত হয়েছেন শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষ। এখন আবার গ্রেপ্তার-আটক-রিমান্ডের নামে তাঁরাই দমন-পীড়নের শিকার হচ্ছেন।
বাস্তবে না থাকলেও সরকারের কল্পনায় বিরোধী দলের সর্বময় উপস্থিতি। কল্পনার বিরোধী দলকে নিয়ে অনেক গল্প বলা যায়, আঁতকেও ওঠা যায়; কিন্তু তাদের কি গ্রেপ্তার করা যায়? শায়েস্তা করা যায়? তাই সামনে যে থাকে, তাকেই একহাত দেখে নিতে হয়। তাই তো জলজ্যান্ত তাজা টগবগে ছেলেগুলো রাস্তায় গুলিতে ঝাঁজরা হলো।
বাহিনী মানেই বিনা বিবেচনায় নির্দেশ পালনকারী বা রোবট তো নয়! সাধারণ মানুষ মনে করেছিলেন, প্রশিক্ষিত বাহিনীর সদস্যরা তাঁদের আবেগ বুঝবেন এবং এ কারণেই পাখির মতো হাত মেলে দাঁড়ালে অস্ত্রধারী মানুষটি তাঁকে গুলি করতে পারেন না, পাঠাতে পারেন না। কিন্তু সে বিশ্বাসের গুড়ে বালি। কয়েক গজ দূর থেকে একের পর এক গুলি!
আচ্ছা, একটি-দুটি গুলির পরও তাঁদের মধ্যে কেন দয়ামায়া জাগল না? পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে করতে তাঁরা কীভাবে এমন নির্মম-নৃশংস হয়ে উঠলেন?
এরপর এই প্রজন্ম যদি কোথাও লেখা দেখে ‘পুলিশ জনগণের বন্ধু’, তবে তাদের গায়ে কাঁটা দেবে। বিশেষ বিপদে পড়লেও পুলিশের সহায়তা চাইতে তারা দ্বিতীয়বার ভাববে। তাদের কাছে পুলিশকে কেবল একটা ভয় সৃষ্টিকারী ও সরকারের আজ্ঞাবহ বাহিনী ছাড়া অন্য কিছু মনে হওয়ার সুযোগ আছি কি? আচ্ছা, পুলিশের কি তাদের বয়সী সন্তান নেই?
যাঁরা ভাবেন শুধু একটা দুর্নীতিপরায়ণ সরকারি চাকুরে হওয়ার জন্য ছাত্রদের আন্দোলন এই মারমুখী রূপ নিয়েছিল, তাঁরা কি জানতেন, আদিবাসী ও প্রতিবন্ধী কোটা নামমাত্র রেখে নারী, জেলা ও মুক্তিযোদ্ধা কোটা মিলে আছে ৫৬ শতাংশ। কিছু সুচতুর সরকারি প্রতিনিধি আছেন, যাঁরা হাসি হাসি মুখে স্মার্ট ভঙ্গিতে বলতেন, কোটায় যাঁরা আসেন, তাঁরা কি মেধাবী নন? তাঁদের প্রত্যেককে তো প্রিলিমিনারি আর লিখিত পরীক্ষায় বসতে হয়। আর কোটা প্রয়োগ করা হয় একেবারে শেষ ধাপে! বাহ্, শুনলে শিক্ষিত লোকদেরও বিভ্রান্ত হওয়ার জোগাড়।
এ ছাড়া ওই যে ৪৪ শতাংশ মেধাভিত্তিক তালিকা, তা থেকেই-বা কী লাভ হচ্ছিল, যেখানে বছরের পর বছর সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বিসিএসের প্রশ্ন টাকার বিনিময়ে কারও কারও হাতে তুলে দিতেন। প্রশ্ন বিক্রি করে অর্জিত কোটি কোটি টাকার সম্পদ দেখিয়ে কেবল নিম্নশ্রেণির কর্মচারীকেই বলির পাঁঠা বানানো হয়, রাঘববোয়ালেরা থাকেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।
যা–ই হোক, প্রশ্ন এভাবে ফাঁস হয়ে গেলে মেধার কী মূল্যায়ন থাকে তখন? একে তো ৫৬ শতাংশ কোটা, তার ওপর প্রশ্ন কেনা ‘অমেধাবী’ লোকেরা মেধাতালিকা দখল করে থাকেন। তা-ও ঘটে সরকারের অসচেতনতা ও বিসিএসের প্রশ্ন নিয়ে ব্যবসা করার ধান্দার কারণেই।
এই যে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন, এতে অংশগ্রহণকারীরা কি এরও একটা বিহিত চান না? তাঁরা কি কেবল চাকরিই চান? এই যে এত দিন ধরে চলে আসা দুর্নীতি, টাকা পাচার, মানুষের কথা বলার অধিকার কেড়ে নেওয়া, পণ্যের মূল্যের লাগামছাড়া ঊর্ধ্বগতি—এর কিছুই কি তাঁদের হিসাবে ছিল না?
ছিল এবং তাঁদের মাথায় যে এসব ছিল, তা সরকারেরও জানা ছিল। এ কারণে আন্দোলনের ঢেউ তাদের কাছে অস্তিত্বে ধাক্কা লাগার মতো মনে হয়েছে। আন্দোলন দমাতে তখন সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগের দিকে যেতে হয়েছে।
এরপর আছে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে ছাত্রলীগের ‘অগ্রাধিকার’। ২০১৪ সালের ১৩ নভেম্বর চট্টগ্রামে ছাত্রলীগের কোন্দল-পরবর্তী সভায় প্রধানমন্ত্রীর তৎকালীন রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম (হোসেন তৌফিক ইমাম) বিসিএসে অংশগ্রহণ করে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের চেষ্টা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘তোমরা শুধু লিখিত পরীক্ষায় পাস করে আসো, তারপর আমরা দেখব।’
রাষ্ট্রীয় আইন ও রীতিনীতিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সেই সভায় এইচ টি ইমাম জানিয়ে দিয়েছিলেন যে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে ছাত্রলীগের কর্মী হলে লিখিত পরীক্ষার পর মৌখিক পরীক্ষায় উতরানোর ব্যবস্থা করা হবে।
যে ছাত্রলীগের হম্বিতম্বির ওপর নির্ভর করে বিপুল সাধারণ ছাত্রকে নিশ্চুপ রাখা যায়, তাদের কাজের প্রতিদান দিতে হবে বৈকি। সাম্প্রতিক উদারহরণগুলো ধরা যাক। মিছিল ছত্রভঙ্গ করতে ছাত্রলীগ, মারধর করতে ছাত্রলীগ, হেলমেট পরিহিত ছাত্রলীগ। কালক্রমে তাদের নামই হয়ে গেছে ‘হেলমেট বাহিনী’।
ছাত্রলীগ তাদের ‘অপারেশন’ চালাচ্ছে, পুলিশ বাহিনী তাদের পাশে দাঁড়িয়ে আছে—এমন দৃশ্য গত ১০-১৫ বছরে প্রচুর দেখা গেছে। পুলিশও তাদের সাহায্যকারী কিংবা কখনো ‘বি টিম’ হিসেবে মেনে নিয়েছে—এমনটা প্রতীয়মান হওয়ার অনেক কারণ আছে। আর এই ক্ষমতাধর ছাত্রলীগ সদস্যরা সরকারি চাকরিতে প্রবেশের পর কী ভূমিকা পালন করবেন, সেটা খুব সহজেই অনুমেয়।
ইতিহাস বলে, সাত কোটির মধ্যে গুটিকয় ছিল রাজাকার। যাঁরা পরিবার ছেড়ে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করতে যেতে পারেননি, তাঁরা কি নিরবচ্ছিন্ন নিরাপত্তায় দিন কাটিয়েছেন ৯ মাস? অস্তিত্ব রক্ষায় নিজেরই অস্তিত্ব বাজি রাখেননি? কিংবা সম্মুখযোদ্ধাদের সংগ্রামের পথ সহজ করতে প্রাণপাত পরিশ্রম করেননি তাঁরা? যাঁরা সম্মুখযোদ্ধা ও সাহায্যকারী যোদ্ধা, আমাদের কাছে তাঁরা চিরকালের জন্য শ্রদ্ধার পাত্র। তবে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধাকে বিভিন্ন স্বার্থ উদ্ধারে ব্যবহার, তাঁদের প্রতি অশ্রদ্ধারই শামিল।
আন্দোলন থামাতে তাৎক্ষণিকভাবে কোটা সংস্কার হলো। কিন্তু কী হবে, যেসব শিক্ষার্থীকে নির্বিচার হত্যা করা হলো? ওদিকে শিক্ষার্থীদের তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, নির্যাতন করা হচ্ছে। সম্পদ ধ্বংসের জন্য হাজার হাজার মানুষকে প্রমাণ ছাড়াই শুধু সন্দেহের ভিত্তিতে আটক করা হচ্ছে। এই অরাজকতার ফল ভালো হতে পারে না।
এতগুলো তরতাজা মৃত্যুর স্মৃতি এত সহজে মানুষের মন থেকে যাবে না। তাকে ছাপিয়ে ওঠা সম্ভব নয়। জোরপূর্বক মানুষে মানুষে যোগাযোগ বন্ধ রেখে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর নির্ভর করে একটা দেশ চিরকাল চলতে পারে না। ভুলে গেলে চলবে না, ‘বহু মানুষকে কিছু সময়ের জন্য আর কিছু মানুষকে সব সময়ের জন্য বোকা বানিয়ে রাখা চলে, কিন্তু সব মানুষকে সব সময়ের জন্য বোকা বানানো যায় না।’
আফসানা বেগম কথাসাহিত্যিক