বিএনপি রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের জন্য একটি রূপরেখা ঘোষণা করেছে। দু-একটি বিষয় বাদ দিলে খুব বেশি নতুন কিছু নেই এতে। মূলত জিয়াউর রহমানের ১৯ দফা ও খালেদা জিয়ার ভিশন-২০৩০-এর সংমিশ্রণে এই রূপরেখা প্রণয়ন করা হয়েছে। যেমন অনেক দিন ধরেই বিএনপি নির্বাচন পরবর্তী জাতীয় ঐকমত্যের সরকার গঠনের কথা বলে আসছে।
এর পাশাপাশি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রবর্তন, বিচার, আইন ও নির্বাহী বিভাগের মধ্যে ক্ষমতার সমন্বয়, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করা, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কমিশন ফিরিয়ে আনার কথা বলছে দলটি। সবাইকে নিয়ে একটি রেইনবো নেশন গঠনের অঙ্গীকার করেছে বিএনপি।
এ বিষয়গুলো নিয়ে বিএনপি বেশ কিছু সময় ধরেই কথা বলে আসছে। বিভিন্ন সমাবেশ ও সেমিনারে বিএনপির নেতারা এসব বিষয়ে বক্তব্য দিয়েছেন। তাই বিএনপির ঘোষণায় নতুন করে খুব বেশি কিছু আসেনি। তবে পরপর দুই মেয়াদে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী পদে না থাকার ঘোষণায় কিছুটা নতুনত্ব আছে। কিন্তু আমাদের দেশে পরপর দুই মেয়াদে কেউই প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হননি। যদি মোটামুটি সুষ্ঠু নির্বাচন হয় তবে পরপর দুই মেয়াদে নির্বাচিত হয়ে আসার সুযোগ কম।
আর কেউ যদি জোর করে ক্ষমতা ধরে রাখেন, তখন এই আইনের কোনো মূল্য থাকবে না। পরপর দুবার নির্বাচিত না হওয়ার রীতি অধিকতর স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্রে কার্যকর বেশি।
বিএনপির এসব প্রস্তাবে কিছু কিছু বাহুল্যও আছে। যেমন ন্যাশনাল রিকনসিলিয়েশন কমিশন গঠন করা হবে। বলা হয়েছে বৈষম্যবিহীন, অংশগ্রহণমূলক সমাজ গঠনে একটি সামাজিক চুক্তিতে পৌঁছানো হবে। আধুনিক জাতি রাষ্ট্রে রিকনসিলিয়েশন, সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট এই শব্দবন্ধগুলো রাজনৈতিক নেতারা চমক তৈরির জন্য গত শতকে ব্যবহার করতেন।
বিশেষ করে গত শতকে আফ্রিকা ও লাতিনের কিছু দেশের জাতিগত সংঘাত, বিভাজনের পর এই শব্দবন্ধগুলো আলোচনায় আসে। আমাদের দেশে ওই অর্থে জাতিগত বিভেদ নেই। তাই ন্যাশনাল রিকনসিলিয়েশন বা সোশ্যাল কন্ট্রাক্টের আলোচনা এখানে চটকদার আলাপ ছাড়া কিছুই নয়।
রূপরেখায় দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠনের কথা বলা হয়েছে। বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করে উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠা করা হবে। দুই কক্ষবিশিষ্ট সংসদের সুবিধা ও অসুবিধা দুটিই আছে। বিএনপির প্রস্তাবনা শুনে মনে হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলো নিজস্ব বিবেচনায় উচ্চকক্ষের সদস্য মনোনীত করবেন। সম্ভবত সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে উচ্চকক্ষের প্রতিনিধি নির্ধারিত হবে না।
আবার নির্বাচনও হতে পারে। আমরা জানি জাতীয় সংসদেও প্রতিটি আসনে বিএনপি থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশীর সংখ্যা অনেক বেশি। বিদ্রোহী প্রার্থী হতে পারেন অনেকেই। তাই পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্যই হয়তো বিএনপি দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংগঠন গঠন করে প্রার্থীদের সামাল দেওয়ার চেষ্টা করবে।
এ ধরনের দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের জটিলতা হচ্ছে উচ্চকক্ষ শেষ পর্যন্ত অভিজাত ও বয়স্ক রাজনৈতিক নেতাদের পুনর্বাসন কেন্দ্রে পরিণত হয়। এতে জ্ঞানীগুণীরা স্থান পান না। আর দুই কক্ষের মধ্যে ভারসাম্য আনাও কঠিন হয়ে পড়ে। দুই কক্ষের মধ্যে দায়িত্ব নির্ধারণ করা সহজ নয়।
রাষ্ট্রের মৌলিক চরিত্র পরিবর্তনে জরুরি বিষয় হচ্ছে সাধারণ মানুষের ক্ষমতায়ন। রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি হচ্ছে জনগণ। বিএনপি বলেছে বটে রাষ্ট্রের মালিকানা জনগণের হাতে ফিরিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন, দুই কক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠন, দুবারের বেশি রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী না হওয়া রাষ্ট্রের চরিত্র পরিবর্তনে খুব বেশি ভূমিকা রাখবে না বা জনগণের ক্ষমতায়ন হবে না। জনগণের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়ার সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা বিএনপির রূপরেখায় নেই।
এক কক্ষ আরেক কক্ষের ওপর দায় চাপানোর চেষ্টা করে। দুই কক্ষের সদস্যদের মধ্যে আসনকেন্দ্রিক জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে। এতে একধরনের মাথাভারী গোঁজামিলের সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে। নিম্নকক্ষ দুর্নীতিবাজ, সন্ত্রাসী, অগ্রহণযোগ্য নেতাদের দখলে চলে যেতে পারে। এ ছাড়া আমাদের মতো দেশের জন্য দুই কক্ষবিশিষ্ট সংসদ অপচয়মূলক একটি বিষয়।
বিএনপির রাষ্ট্র মেরামতের রূপরেখায় রাষ্ট্রের কাঠামো ও রাষ্ট্র পরিচালনার বিষয়টি গুলিয়ে ফেলেছে। রাষ্ট্র মেরামতের ক্ষেত্রে কাঠামোকে গুরুত্ব দিতে হবে। বিএনপি রাষ্ট্র পরিচালনা বা নীতি পদ্ধতির প্রণয়ন ও বাস্তবায়নকেই রাষ্ট্রের মেরামত হিসেবে মনে করতে পারে।
রূপরেখায় অধিকাংশই রাষ্ট্রের নিয়মিত কাজ সম্পর্কে বলা হয়েছে। যেমন জবাবদিহি, স্বচ্ছতা, সাংবিধানিক দায়বদ্ধতা, অর্থ পাচারের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনা, গুম ও বিনা বিচারে হত্যার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিচার করা, বিভিন্ন সংস্কার কমিশন গঠন করা, স্বাস্থ্যবিমা চালু করা, চাকরির বয়সসীমা বাড়ানো, শ্রমিকের বেতন বৃদ্ধি করা। বস্তুত এই রূপরেখায় একগুচ্ছ প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বিএনপি। এই ধরনের প্রতিশ্রুতি তেমন নতুন কিছুই নয়। কেবল কমিশন গঠন করলেই সমস্যার সমাধান হবে না।
বিএনপির আমলেই দুর্নীতি দমন কমিশন গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু এরপরও দেশে দুর্নীতি কমেনি, বরং বেড়েছে। মূলত এই ধরনের বিভিন্ন কমিশন গঠন রাষ্ট্রের মৌলিক চরিত্র পরিবর্তনে কোনো ভূমিকা রাখতে পারে না। বিএনপি রাষ্ট্র সংস্কারের রূপরেখাও রাষ্ট্রের মৌলিক চরিত্রে তেমন কোনো পরিবর্তন আনতে পারবে বলে মনে হয় না। কিন্তু মেরামত করতে গেলে রাষ্ট্রের যে মৌলিক স্তম্ভগুলো রয়েছে, তা মেরামত ও শক্তিশালী করতে হবে।
রাষ্ট্রের মৌলিক চরিত্র পরিবর্তনে জরুরি বিষয় হচ্ছে সাধারণ মানুষের ক্ষমতায়ন। রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি হচ্ছে জনগণ। বিএনপি বলেছে বটে রাষ্ট্রের মালিকানা জনগণের হাতে ফিরিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন, দুই কক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠন, দুবারের বেশি রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রী না হওয়া রাষ্ট্রের চরিত্র পরিবর্তনে খুব বেশি ভূমিকা রাখবে না বা জনগণের ক্ষমতায়ন হবে না। জনগণের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়ার সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা বিএনপির রূপরেখায় নেই।
রাষ্ট্র মেরামতের জন্য প্রথমেই রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কারের প্রস্তাব দেওয়া প্রয়োজন ছিল। দলগুলো গণতান্ত্রিক না হলে বিভিন্ন সাংবিধানিক পরিবর্তন, নীতি প্রণয়ন, কমিশন গঠন করে কোনো কাজ হবে না। স্থায়ীভাবে গণতন্ত্র আসবে না। রাজনৈতিক দলগুলো গণতান্ত্রিক না বলেই রাষ্ট্রের ভিত্তি অত্যন্ত দুর্বল। রাজনৈতিক দলের সংস্কার না করে বিভিন্ন সাংবিধানিক, প্রশাসনিক সংস্কার, কমিশন গঠন করে মাথাভারী প্রশাসন সৃষ্টি হবে। ব্যয় বাড়বে।
দলগুলোর মধ্যে গণতান্ত্রিক চর্চা বাধ্যতামূলক করার ঘোষণা দিতে পারত বিএনপি। একদম তৃণমূল থেকে প্রতিটি ইউনিটে কর্মীদের সরাসরি ভোট ও মতামতের ভিত্তিতে নেতৃত্ব নির্বাচন, কর্মসূচি গ্রহণ করা প্রয়োজন। দলে এক নেতার একাধিক পদ না রাখার ঘোষণা দিতে পারত। প্রতিটি ইউনিটের কমিটিতে লৈঙ্গিক ও ধর্মীয় অনুপাতে পদ নির্ধারণ করার প্রস্তাব দিতে পারত। ধরা যাক, প্রতিটি কমিটিতে ১০ শতাংশ করে পদ নারী ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জন্য নির্ধারিত থাকবে। এসব পদে কাউকে না পাওয়া গেলে প্রয়োজনে খালি থাকবে।
পুনর্বাসনমূলক দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ গঠন করে কার্যকর দ্বিকক্ষবিশিষ্ট শাসনপদ্ধতি প্রণয়নের ঘোষণা দিতে পারত বিএনপি। এর জন্য স্থানীয় সরকারব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। উপজেলা ও পৌরসভার যেকোনো একটিকে বাতিল করে একমুখী স্থানীয় সরকারব্যবস্থা প্রণয়ন করা যেতে পারে। স্থানীয় সরকারব্যবস্থা হতে পারে অনেকটা এ রকম—ইউনিয়ন পরিষদ-উপজেলা পরিষদ। ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের উপজেলা সরকারের সদস্য হবেন।
উপজেলা চেয়ারম্যানদের দিয়ে আঞ্চলিক সরকার পরিষদ গঠন করা হবে। প্রতিটি পরিষদ হবে স্বায়ত্তশাসিত। তাদের নিজস্ব উন্নয়ন ও শাসন পরিকল্পনা থাকবে। রাষ্ট্র পরিচালনার যাবতীয় চাহিদা ও পরিকল্পনা মাঠপর্যায় থেকে উঠে আসবে। এর ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় সরকার আইন ও নীতি প্রণয়ন করবে। সংসদে উত্থাপন করা হবে। সংসদে অনুমোদনের পর বিভাগীয় সরকার পরিষদে পাঠানো হবে অনুমোদনের জন্য।
সেখানে আলোচনা ও অনুমোদনের পর আইন বাস্তবায়ন করা হবে। ৩০০ আসনের সংসদ উচ্চকক্ষ ও বিভাগীয় সরকার পরিষদ নিম্নকক্ষ হিসেবে কাজ করবে। এতে সরকার ও প্রশাসনব্যবস্থা সহজ ও জনপ্রতিনিধিত্বশীল হবে।
এই রূপরেখায় জনপ্রতিনিধিত্বশীল রাষ্ট্রীয় কাঠামো নির্মাণের নির্দেশনা নেই। আগেই বলেছি ২৭ দফা হচ্ছে ভবিষ্যতে রাষ্ট্র পরিচালনার প্রতিশ্রুতি। আপাতত দৃষ্টিতে এই রূপরেখাকে একগাদা কমিশন গঠনের পরিকল্পনা বলে মনে হবে। এতে কমপক্ষে ছয়টি কমিশন ও কাউন্সিল গঠনের প্রস্তাব রয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনায় কী কী ধরনের মৌলিক পরিবর্তন আনা হবে, তার সুনির্দিষ্ট উল্লেখ নেই।
রাষ্ট্র কী এবং এর কাঠামো কীভাবে সক্রিয় থাকে, সে সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা নেই রূপরেখাতে। রাষ্ট্র সম্পর্কে দুর্বল ধারণা নিয়ে কর্তৃত্ববাদ ধরনের শাসনের বিরুদ্ধে সফল হওয়া দুষ্কর হবে বিএনপির জন্য। বিএনপি অনেকটা ক্ষয়ে যাওয়ার কাঠামোর ওপর চুনকাম করে সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করেছে। চুনকাম পুরোনো হয়ে গেলেই সমস্যা আবার ফুঁড়ে বেরিয়ে আসবে।
২৭ দফায় শাসকগোষ্ঠীর বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বলা হয়েছে। কিন্তু এখানে জনগণের অংশীদারত্ব কোথায়। কেবল পাঁচ বছরে একবার ভোট দেওয়াই জনগণের অংশীদারত্ব নয়। ভারসাম্য আনতে হবে রাষ্ট্রের মালিক জনসাধারণের সঙ্গে সরকার বা শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে। এটাই হবে রাষ্ট্রের প্রকৃত মেরামত। সরকারের বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে যে ভারসাম্য আনার প্রস্তাব দিয়েছে বিএনপি, তার অপারেশনাল বা পরিচলনগত সংস্কার।
সর্বোপরি বিএনপির এই রূপরেখা পড়ে সুলিখিত মনে হলেও সুচিন্তিত মনে হয়নি। বিভাগীয় সমাবেশগুলোর মাঠে গণমানুষের উপস্থিতিকে বুদ্ধিবৃত্তিক ভাষায় রূপান্তরিত করতে পারেনি বিএনপি। বরং বুমার জেনারেশনের (১৯৪৬-৬৪ সাল পর্যন্ত যাদের জন্ম) ভাষা ও ভাবনার মধ্যেই আটকে আছে। মিলেনিয়াম জেনারেশনের জন্য এই রূপরেখায় তেমন কিছু নেই। তরুণদের আকৃষ্ট করার মতো তেমন কিছু নেই রূপরেখায়।
বিএনপির সমাবেশে সারা দেশ থেকে হাজার হাজার মানুষ যোগ দিয়েছেন। অনেকেই চিড়া-মুড়ি নিয়ে সমাবেশে এসেছিলেন। রাজনীতিতে তাঁদের অবস্থান কোথায়? তরুণদের স্বপ্ন কোথায় এখানে? তাঁদের জন্য নতুন দিনের রাজনীতির আভাস আমরা পাইনি। দিন বদলের সনদের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালে কোটি কোটি তরুণদের আকৃষ্ট করেছিল। এই তরুণদের বিএনপির দিকে ফিরিয়ে আনার তেমন স্লোগান এই রূপরেখায় চোখে পড়েনি।
ড. মারুফ মল্লিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক