ক্ষুব্ধ মানুষেরা দল বেঁধে কমলা হ্যারিসকে ভোট দিতে যাননি
ক্ষুব্ধ মানুষেরা দল বেঁধে কমলা হ্যারিসকে ভোট দিতে যাননি

এই তামাশা ডেমোক্র্যাটদের নিয়ে

এক মার্কিন কৌতুক অভিনেতা আছেন। নাম টনি হিঞ্চক্লিফ। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ঠিক আগের দিন নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমাবেশে এসেছিলেন তিনি। সেখানে তাঁর রসিকতা নিয়ে এক কেলেঙ্কারি হয়েছিল। 

হিঞ্চক্লিফ সমাবেশের শুরুতেই আমেরিকার বিভিন্ন অভিবাসীকে নিয়ে খুব আপত্তিজনক কিছু নোংরা রসিকতা করেন। যেমন পুয়ের্তো রিকোকে বলেন, ‘আবর্জনার ভাসমান দ্বীপ’, কালো মানুষদের ‘তরমুজখেকো’, ফিলিস্তিনিদের ‘পাথর ছোড়ার দল’ ইত্যাদি।

অনেক মানুষই এই কাণ্ডে ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। তাঁরা ধরে নিয়েছিলেন যে এই কথাবার্তায় ট্রাম্পের জয়ের সম্ভাবনা কমবে। মানে লাতিন আর অন্যান্য আক্রান্ত মানুষ দল বেঁধে সবাই কমলা হ্যারিসকে ভোট দেবেন। কিন্তু দেখা গেল, হিস্পানিক ভোটারদের ৪৬ শতাংশ ট্রাম্পকে ভোট দিয়েছেন।

এ রকম জনপ্রিয় কমেডিয়ান আগেও ছিলেন আমেরিকায়। যেমন লেনি ব্রুস। ব্রুস শপথ নিয়েছিলেন, যে সমাজ মুখের অশ্লীল কথার জন্য জেলে ঢোকায় কিন্তু জাতিগত নির্যাতন, পুলিশি সহিংসতা আর দুর্নীতি সহ্য করে, তিনি সেই সমাজের ভণ্ডামি উন্মোচন করবেন। ১৯৬১ সালে ব্রুসকে ‘অশ্লীল’ শব্দ ব্যবহার করার জন্য গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। নিষিদ্ধ করা হয়েছিল টেলিভিশন থেকে। পাঁচ বছর পর ব্রুসের মৃত্যু হয়। মৃত্যুর আগপর্যন্ত পুলিশ তাঁকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে।

ব্রুসের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল বাক্‌স্বাধীনতা। তিনি বিশ্বাস করতেন যে কৌতুক অভিনেতার কাজ হলো তথাকথিত ভালো রুচির সীমানা পার হয়ে সত্য বলা। হিঞ্চক্লিফও এ ব্যাপারে একমত। এপ্রিলে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, সবাই মিলে তাঁর পেছনে লাগলেও কৌতুকের জন্য কৌতুক অভিনেতাদের কখনোই ক্ষমা চাওয়া উচিত নয়। তবে ব্রুস আর হিঞ্চক্লিফের মধ্যে একটি বড় তফাত রয়েছে। ব্রুস ছিলেন ফ্রি জ্যাজের আদলে একজন হিপস্টার। বিট কবিদের মতো কালো মানুষদের গানের ধরনে পাল্টা সাংস্কৃতিক বয়ান তৈরিতে আন্তরিক ছিলেন। নিজেদের প্রগতিশীল মনে করেন, এমন বুদ্ধিজীবী আর শিল্পীরা ব্রুসকে সমর্থন করতেন।

অপর দিকে হিঞ্চক্লিফ আপত্তিকর কথাগুলো বলেছেন রিপাবলিকান পার্টির সমাবেশে। তাঁর কথা শুনে যাঁরা হাসিতে গড়িয়ে পড়ছিলেন, তাঁরা আর যা–ই হোন, কোনোভাবেই প্রগতিশীল নন। তাঁরা নির্দ্বিধায় সেই ট্রাম্পকে আপন করে নিয়েছেন, যিনি অভিবাসীদের ‘অপরাধী’ ও ‘ধর্ষক’ বলেন। হাইতিয়ান আমেরিকানদের সাদা মানুষের পোষা প্রাণী খাওয়ার অদ্ভুত অভিযোগে অভিযুক্ত করেন।

যে ট্রাম্প খোলাখুলি তাঁর প্রতিপক্ষকে বন্দী করে রাখা আর সমালোচকদের পিষে ফেলার কথা বলেন। হিঞ্চক্লিফও স্বাধীনতা চান। তবে সে স্বাধীনতা যারা সাদা মানুষ নয়, পুরুষ নয়, তাদের যাচ্ছেতাই অপমান করার স্বাধীনতা। সহনশীলতার কথা বলা ব্রুসের সঙ্গে হিঞ্চক্লিফের বিস্তর ব্যবধান।

কিন্তু হিঞ্চক্লিফকে রক্ষণশীল আর ব্রুসকে প্রগতিশীল হিসেবে মোটাদাগে দেখলে আসল জিনিসটাই চোখ এড়িয়ে যাবে। হিঞ্চক্লিফও ট্রাম্পের মতোই কোনোভাবে রক্ষণশীল নন। হিঞ্চক্লিফ সম্পর্কে ব্রুসের মতোই বলা যেতে পারে যে তিনি আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়, সংবাদমাধ্যম, প্রকাশনা সংস্থা, বিভিন্ন ফাউন্ডেশন ও এনজিওগুলোয় দাপিয়ে বেড়ানো এলিটদের অস্বস্তিতে ফেলতে সিদ্ধহস্ত।

ট্রাম্পের ভোটাররা সেই সব লোক, যাঁদের এই সব শহুরে পেশাদারেরা বর্জন করেন, ঘৃণা করেন। তাঁরা হলেন হিলারি ক্লিনটন যাঁদের বলেছিলেন, ‘শোচনীয়’ সব মানুষ। যাঁদের সব সময় লিঙ্গ, জাতি ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিয়ে লেকচার দেওয়া হয়। যাঁদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকদের মতো দেখা হয়।

ট্রাম্পের বিজয় রক্ষণশীলতার জয় নয়। বরং উল্টো। এটা সাংস্কৃতিকভাবে বঞ্চিতদের বিদ্রোহ। এই বঞ্চিতরা আমূল পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া একজন আত্মস্বীকৃত বহিরাগতর ভেতর দিয়ে নিজেদের রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতায়িত বোধ করে। এর মধ্যে রয়েছেন হিস্পানিকের মতো লোক যাঁরা ‘লাতিনো’ নামে পরিচিত হতে চান না। আছেন বেশ কিছু কালো পুরুষও।

অনেক উদারপন্থী মানুষ ট্রাম্পের বিজয়ে হতাশ হয়েছেন। তাঁরা ট্রাম্পের ভোটারদের বর্ণবাদী, গোড়া বলতে পারেন। তবে তা হবে গুরুতর ভুল। অভিজাত দল হয়ে থেকে বড় শহরের বাইরে বিপুলসংখ্যক আমেরিকান ভোটারের আস্থা তাঁরা অর্জন করতে পারবেন না। যাঁদের কলেজের ডিগ্রি নেই, যাঁরা ধর্মভীরু, গ্রামীণ ভোটার, তাঁদের সমর্থন ছাড়া ডেমোক্র্যাটরা ব্যর্থ হতে বাধ্য।

উদারপন্থীদের অবশ্যই জাতি ও লিঙ্গভিত্তিক রাজনীতির চেয়ে শ্রেণিকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। সংস্কৃতির যুদ্ধ নিয়ে শহুরে ভোটারদের মন পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু জাতীয় রাজনীতিকে তা দিয়ে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করা যায় না।

ইয়ান বুরুমা রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও লেখক

প্রজেক্ট সিন্ডিকেট থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত