মিয়ানমার জান্তা সরকারের একের পর এক সামরিক ঘাঁটি দখল করছে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো
মিয়ানমার জান্তা সরকারের একের পর এক সামরিক ঘাঁটি দখল করছে বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো

মতামত

মিয়ানমারে যুদ্ধ: নতুন ভূরাজনৈতিক চ্যালেঞ্জে বাংলাদেশ

অনেক দিন আগে থেকেই বলে আসছি যে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতিকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের সামনে বড় ধরনের ভূরাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ তৈরি হচ্ছে। বিষয়টি বোঝার জন্য মিয়ানমারের সাম্প্রতিক পরিবর্তিত পরিস্থিতির ধারাবাহিকতা তুলে ধরা জরুরি মনে করছি।

মিয়ানমারের পরিস্থিতির দ্রুত পরিবর্তন হতে থাকে ২০২০ সালের সাধারণ নির্বাচনের পর থেকেই। সেই নির্বাচনে সাবেক স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চির ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) সেনাসমর্থিত দলকে বিপুল ভোটে পরাজিত করে। সংবিধান সংশোধনের যে প্রতিশ্রুতি এনএলডি দিয়েছিল, তা সেনাবাহিনী পছন্দ করেনি।

২০২১ সালে সেনাবাহিনী নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে মিয়ানমারের জনপ্রিয় নেতা অং সান সু চিসহ শীর্ষ এনএলডি নেতাদের কারাগারে পাঠায়। মিয়ানমারে সামরিক শাসন কোনো নতুন বিষয় নয়, কিন্তু এবার সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে যে প্রতিরোধ শুরু হয়, তা মিয়ানমারের ইতিহাসে কখনো দেখা যায়নি।

দেশটির প্রধান ও প্রভাবশালী জনগোষ্ঠী বামারদের মধ্য থেকেই প্রতিরোধ তৈরি হয়। এরই ধারাবাহিকতায় এনএলডি ও নির্বাচিত সদস্যদের নিয়ে প্রবাসী ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট গঠন করা হয়। একই সঙ্গে এই সরকারের সামরিক উইং ন্যাশনাল ডিফেন্স ফোর্স (এনডিএফ) গঠিত হয়।

এনডিএফ জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলার পাশাপাশি ১৯৪৮ সাল থেকে ফেডারেল সরকার ও স্বায়ত্তশাসনের জন্য বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সশস্ত্র বিদ্রোহীদের সঙ্গে সমন্বয় করে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। উদ্দেশ্য, মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর সরকার হটিয়ে একটি ফেডারেল রাষ্ট্র তৈরি ও বেসামরিক গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করা।

এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে ২০২১ সাল থেকে দেশটির প্রধান ১৪টি জাতিগত গোষ্ঠীর দলগুলো মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী বা তাতমাদো সরকারের বিরুদ্ধে তাদের সংগ্রাম জোরদার করে। এসব জাতিগত গোষ্ঠীর অধিকাংশই দেশটির পশ্চিম-উত্তর ও পূর্বাঞ্চলে সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াইয়ে লিপ্ত ছিল। একসময় তিনটি সশস্ত্র গোষ্ঠীর সমন্বয়ে গড়ে ওঠে কথিত থ্রি ব্রাদার্স অ্যালায়েন্স (থ্রি বিএইচএ)। এদের মধ্যে জনবল, সামরিক শক্তি ও কৌশলের দিক থেকে সবচেয়ে প্রভাবশালী সংগঠন হচ্ছে আরাকান আর্মি (এএ)। বাকি দুটি হচ্ছে কাচিন ইন্ডিপেনডেন্ট আর্মি ও তাং ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি।

আলোচিত ‘থ্রি বিএইচএ’ চীন সীমান্তের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছোট শহর ও সরকারি ঘাঁটি দখল করায় চীনের সঙ্গে মিয়ানমারের ব্যবসা প্রায় বন্ধ হওয়ার পথে ছিল। মিয়ানমার জান্তার জন্য সবচেয়ে বড় ধাক্কা এসেছে যখন তারা উত্তর শান স্টেটের কোকাং স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের রাজধানী লোঙ্ককাইং দখল করে। চীনের সঙ্গে মিয়ানমারের অন্যতম প্রধান পথ ছিল এটি। লোঙ্ককাইং দখলের পরই চীন তৎপর হয়ে উঠেছে এবং তারা সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে সমর্থন দিতে শুরু করে।

‘অপারেশন ১০২৭’-এর আওতায় এই অভিযান একযোগে শুরু হয় গত বছরের অক্টোবরে। বিশেষ করে রাখাইন রাজ্যে এই অভিযান জোরালোভাবে শুরু হয়। চীন এদের সমর্থন এবং একই সঙ্গে বিশেষ করে সীমান্ত অঞ্চলে তাতমাদোর সঙ্গে যুদ্ধবিরতি কার্যকর করেছে। এর মাধ্যমে একদিকে চীন তার সীমান্ত এলাকাকে সুরক্ষিত ও বৃহত্তর পরিসরে স্থিতাবস্থা বজায় রাখার চেষ্টা করছে। কারণ, মিয়ানমার চীনের প্রধান ভূরাজনৈতিক সহায়ক রাষ্ট্র। শুধু ভূরাজনৈতিক নয় বরং মিয়ানমার চীনের বড় ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ক্ষেত্র।

বিশেষ করে দক্ষিণ রাখাইনের গভীর সমুদ্রবন্দরের মাধ্যমে বঙ্গোপসাগর থেকে চীনের দক্ষিণ-পূর্বের কুনমিং শহর পর্যন্ত বহুমুখী যোগাযোগ এবং জ্বালানি সরবরাহ চীনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তথ্যে প্রকাশ যে গ্যাস ও তেলের টার্মিনাল ও পাইপলাইন পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহৃতও হচ্ছে।

বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা ও রোহিঙ্গা প্রশ্নে শুধু দ্বিপক্ষীয় সমঝোতার চেষ্টা ও চীনের ওপর নির্ভরতা যেহেতু কাজে দিচ্ছে না, তাই কেন্দ্রের দাবিদার এনইউজি (ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট) ও আরাকান আর্মি তথা তাদের রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ ও সম্পর্ক তৈরির বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে। কারণ, শুধু রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনই নয়, তাদের স্থায়ী নাগরিকত্বেরও প্রশ্ন রয়েছে।

রাখাইন অঞ্চলে যা ঘটেছে ও ঘটবে, তার প্রভাব বাংলাদেশের ওপরও পড়বে। বিভিন্ন সময় মিয়ানমার সরকারের জাতিগত নির্মূলপ্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে বাংলাদেশে প্রায় ১২ থেকে ১৫ লাখ রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু আশ্রয় নিয়েছে। বাংলাদেশ সরকার দীর্ঘদিন ধরে প্রচেষ্টা চালিয়েও এদের দেশে ফেরত পাঠাতে পারেনি। এখন আরাকান আর্মি যখন উত্তর রাখাইন দখলের পথে, তখন তা আমাদের জন্য এক নতুন বাস্তবতা হিসেবে হাজির হতে যাচ্ছে।

আরাকান আর্মির আক্রমণের মুখে মিয়ানমারের সেনাসদস্য থেকে শুরু করে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদস্য ও বিভিন্ন পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তারা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়ে আত্মসমর্পণ করতে শুরু করেছেন। এই সংখ্যা এরই মধ্যে ২০০ ছাড়িয়ে গেছে।

অপর দিকে আরাকান আর্মি ও থ্রি বিএইচএ ভারতের অন্যতম বৃহৎ বহুমুখী যোগাযোগব্যবস্থা কালাদান প্রকল্পের অন্যতম স্থলবন্দর চিন রাজ্য সীমান্তের সন্নিকটে পেলেতওয়া দখল করার পর কালাদান নদীর দুই পারের জনপদ, আরাকান বা রাখাইনের পুরোনো ঐতিহাসিক শহর মার্ক-ইউ তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে।

রাখাইনের রাজধানী সিতওয়েতে ভারতের তৈরি করা গভীর সমুদ্রবন্দর ও অর্থনৈতিক অঞ্চলও আক্রমণের মুখে রয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা যাচ্ছে। এককথায় শিলিগুড়ি করিডরের বিকল্প হিসেবে ভারত যে কালাদান প্রকল্প হাতে নিয়েছিল, তা এখন চীন–সমর্থিত আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে পড়তে যাচ্ছে। এর ফলে উত্তর রাখাইনে ভারত-চীনের ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্ব নতুন রূপ নিতে পারে।

ভারতের সঙ্গে রাখাইনের প্রধান শক্তি আরাকান আর্মি এবং তাদের রাজনৈতিক অঙ্গ ইউনাইটেড আরাকান লিগের সম্পর্ক ঐতিহাসিকভাবে তিক্ত। বর্তমান পরিস্থিতিতে ভারতের বিভিন্ন সংস্থা আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তেমন সফল হয়নি বলে নানা সূত্রে জানা গেছে। এটা এখন পরিষ্কার যে রাখাইন পরিস্থিতির ওপর একদিকে এ অঞ্চলে চীন-ভারতের দ্বন্দ্ব এবং অন্যদিকে বাংলাদেশে অবস্থিত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনের বিষয়টির ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে।

এখানে উল্লেখযোগ্য যে বিদ্রোহীদের সমর্থন জুগিয়ে গেলেও চীন তাতমাদোর সঙ্গেও সমান্তরাল সম্পর্ক বাজায় রেখেছে। তবে রাখাইন অঞ্চলে ভবিষ্যতে আরাকান আর্মি ও ইউএএল যে বড় ধরনের প্রভাববলয়ে থাকবে, তাতে সন্দেহ নেই।

অপর দিকে বার্মা অ্যাক্টের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ন্যাশনাল ইউনিটি সরকার, পিডিএফ, চিন, কারেন, কাচিন ও কায়ান গোষ্ঠীকে দিয়ে জান্তা সরকারকে কাবু করার পথে রয়েছে।

এ লেখার মূল বিষয়টি হলো রাখাইনসহ মিয়ানমারের ভবিষ্যৎ, ভূরাজনৈতিক বিবেচনায় চীন, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের ত্রিমাত্রিক হিসাব-নিকাশে বাংলাদেশের অবস্থান, বিশেষ করে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন ও আমাদের সীমান্ত এবং সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পথ খোঁজা।

একই সঙ্গে রাখাইন তথা মিয়ানমারকে ঘিরে ত্রিশক্তির যে দ্বন্দ্ব এবং বঙ্গোপসাগরভিত্তিক নিরাপত্তা ও ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজির গুরুত্ব ও করণীয় নিয়েও আলোচনা জরুরি হয়ে পড়েছে।

মিয়ানমারের বর্তমান পরিস্থিতিতে, বিশেষ করে রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ যে সমস্যার মধ্যে রয়েছে, তাতে মনে হয় প্রচলিত দ্বিপক্ষীয় আলোচনা বা শুধু চীনের মধ্যস্থতা কোনো সুফল দেবে না। এখানে মনে রাখতে হবে যে মিয়ানমারের বিবদমান পক্ষগুলো মিয়ানমারকে ভাঙার পক্ষে কোনো অবস্থান নেয়নি।

তাদের দাবি হলো, আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন ও দেশটিকে একটি ফেডারেল রাষ্ট্রে পরিণত করা। এ ধরনের কিছু ঘটলে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর বিষয়টি নিয়ে নতুন করে ভাবার কারণ রয়েছে।

কোনো পক্ষ না নিলেও রাখাইন অঞ্চলে আরাকান আর্মি ও তাদের রাজনৈতিক অংশের উত্থানকে বাংলাদেশের বিবেচনার মধ্যে রাখতে হবে।

একই সঙ্গে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা ও রোহিঙ্গা প্রশ্নে শুধু দ্বিপক্ষীয় সমঝোতার চেষ্টা ও চীনের ওপর নির্ভরতা যেহেতু কাজে দিচ্ছে না, তাই কেন্দ্রের দাবিদার এনইউজি (ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট) ও আরাকান আর্মি তথা তাদের রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ ও সম্পর্ক তৈরির বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে। কারণ, শুধু রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনই নয়, তাদের স্থায়ী নাগরিকত্বেরও প্রশ্ন রয়েছে।

এ বিষয়ে এনইউজি ও আরাকান আর্মি উভয়ই নমনীয় ও প্রকারান্তরে সহমত বলে জানা যায়। আরাকান আর্মির দাবি, তারা ইতিমধ্যেই রাখাইনের রোহিঙ্গাদের সমর্থন পাচ্ছে।

মিয়ানমারের চলমান পরিস্থিতি ও ভূরাজনীতির ঝড়ের মধ্যে আমাদের অবশ্যই সজাগ থাকতে হবে। রাখাইন ঘিরে ভূরাজনীতি, রাখাইন পরিস্থিতি ও রোহিঙ্গাদের ভবিষ্যৎ—এই সবই সরকারের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ, সন্দেহ নেই।

● ড. এম সাখাওয়াত হোসেন নির্বাচন বিশ্লেষক, সাবেক সামরিক কর্মকর্তা এবং এসআইপিজির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো (এনএসইউ)

hhintlbd@yahoo.com