ভোটে দাঁড়াও, মাল কামাও, কোটিপতি হও

সম্প্রতি প্রথমা প্রকাশন আয়োজিত ‘অব্যাহত মুক্তিযুদ্ধ’ শীর্ষক একক বক্তৃতায় অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেছেন, স্বাধীনতা এসেছে, মুক্তি আসেনি। স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পেরোলেও অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রাম এখনো চলছে। মুক্তির সংগ্রামের কথা বলতে গিয়ে তিনি গণতন্ত্র, সুশাসন, সম্পদের সমতা ও ন্যায়বিচারের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন।

জাতীয় সংসদে কারা প্রতিনিধিত্ব করছেন, সে বিষয়ও উঠে এসেছে তাঁর বক্তৃতায়। রেহমান সোবহান মনে করেন, জাতীয় সংসদের চরিত্র ক্রমাগত বদলে গেছে। সংসদ এখন সুযোগসন্ধানীদের জায়গা হয়ে গেছে। আইনপ্রণেতাশ্রেণির রূপান্তর হচ্ছে।

এই রূপান্তরের কিছু চিত্র দেশবাসী জানতে পেরেছে ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে প্রার্থীদের হলফনামায়। এই নির্বাচনে এটাই সবচেয়ে ইতিবাচক দিক। নির্বাচন কমিশন সব দলকে এক করতে না পারলেও আমাদের জনপ্রতিনিধিদের একাংশের চেহারা উন্মোচন করেছেন। বিএনপি নির্বাচনে এলে ষোল আনা পূর্ণ হতো। কী করা যাবে কাজী আউয়াল কমিশনকে এই মনোবেদনা নিয়েই নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে।

তবে প্রার্থীরা স্বেচ্ছায় যেই হলফনামা দিয়েছেন, তাতে সম্পদের প্রকৃত মূল্য উঠে আসেনি। আসার কথাও নয়। হলফনামা দেওয়ার আগে তারা অভিজ্ঞ আয়কর আইনজীবীদের বাড়িতে ধরনা দিয়েছেন। জমি ফ্ল্যাট বাড়ি গহনার দাম যত কম দেখানো যায়। প্রার্থীদের হলফনামা দেখে সহকর্মী সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোয় লিখেছিলেন, ‘হলফনামায় ফিরে এসেছেন শায়েস্তা খাঁ।’

তিনি কারও নাম উল্লেখ করেননি। তারপরও কেউ কেউ ‘ঠাকুর ঘরে কে রে আমি কলা খাইনা’ বলে শোরগোল তুলেছেন।  শায়েস্তা খাঁর আমলে টাকায় আট মণ চাল পাওয়া যেত। আর আমাদের একজন প্রার্থী হলফনামায় বলেছেন, তাঁর ২০ বিঘা জমির দাম ২ হাজার টাকা। সম্ভবত শায়েস্তা খাঁ কিংবা তাঁর বংশধরদের কারও সঙ্গে দেখা হয়ে থাকবে।

প্রার্থীদের দেওয়া হিসাব বিশ্লেষণ করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) কোটিপতি ও শত কোটিপতিদের একটা তালিকা করেছে। এতে দেখা যায়,  আওয়ামী লীগের ৮৭ শতাংশ প্রার্থী কোটিপতি। স্বতন্ত্র প্রার্থীদের প্রায় ৪৭ শতাংশ কোটিপতি। এবারের নির্বাচনে প্রতাপশালী ও সম্পদশালী স্বতন্ত্র প্রার্থীরা আওয়ামী লীগের। সে ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগে কোটিপতির সংখ্যা আরও অনেক বাড়বে। জাতীয় পার্টির প্রার্থীদের প্রায় ২২ শতাংশ কোটিপতি।

তবে একদা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের ধ্বজাধারী জাসদও একেবারে পেছনে আছে বলা যাবে না। তাদের ১০ শতাংশ প্রার্থী কোটিপতি। ওয়ার্কার্স পার্টি যারা শ্রমিকশ্রেণির রাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে রাজনীতি করেন, তাদের দলে কোটিপতি প্রার্থীর হার ১৭ শতাংশ।

সংস্থাটি কোটিপতির হিসাব করেছে নগদ ও ব্যাংকে জমা টাকা, শেয়ার, সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ, সোনাসহ বিভিন্ন অস্থাবর সম্পদের ভিত্তিতে। জমি, বাড়ি বা ফ্ল্যাটের মতো স্থাবর সম্পদ এই হিসাবে আসেনি।

টিআইবি এবারের নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে দেওয়া ১ হাজার ৯২০ জন প্রার্থীর হলফনামা বিশ্লেষণ করেছে। এতে আরও জানা যায়, নির্বাচনে সব প্রার্থী, তাঁদের ওপর নির্ভরশীল এবং প্রার্থীর স্বামী/স্ত্রীর অস্থাবর সম্পদের মোট মূল্য প্রায় ৬৭ হাজার কোটি টাকা। প্রার্থীদের ৭২ শতাংশের অস্থাবর সম্পদ ১ কোটি টাকার নিচে। ১ থেকে ১০ কোটি টাকার সম্পদ আছে ২১ শতাংশ প্রার্থীর। অন্যদের সম্পদ এর চেয়ে বেশি। ১৮ জন প্রার্থীর সম্পদ ১০০ কোটি টাকার বেশি।

বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি একবার গর্ব করে বলেছিলেন বাংলাদেশের চার কোটি মানুষের জীবনযাত্রার মান ইউরোপের মানুষের জীবনযাত্রার মানের সমান। তিনি ওপরের চার কোটির কথা বলেছেন। কিন্তু নিচের চার কোটির জীবনযাত্রার মান যে আফ্রিকার অনেক দেশের নিচে সে কথা বলেননি। আমাদের মন্ত্রী–এমপিরা মুদ্রার একটা পিঠই দেখতেই পছন্দ করেন।  

২০০৮ সালের নির্বাচনে ২৭৪ জন প্রার্থী ছিলেন কোটিপতি (১৭%)। সেটা বেড়ে এবার ৫৭১ জনে দাঁড়িয়েছে, যা মোট প্রার্থীর ২৭ শতাংশ। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কোটিপতি প্রার্থী ছিলেন মোট প্রার্থীর প্রায় ২৮ শতাংশ, যা বেড়ে এখন ৮৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।  বিএনপি এবারের নির্বাচনে অংশ নেয়নি। তবে ২০০৮ ও ২০১৮ সালে নিয়েছিল। ২০১৮ সালে তাদের মোট প্রার্থীর ৫১ শতাংশ ছিলেন কোটিপতি। ২০০৮ সালে হারটি ছিল প্রায় ৪৫ শতাংশ।

সে ক্ষেত্রে কোনো দলেই গরিবপ্রার্থী নেই বললেই চলে। বরং অনেকের আয় ও সম্পদ বেড়েছে  বহুগুণ। উদাহরণ হিসেবে ঢাকা-২০ (ধামরাই) আসনে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য বেনজীর আহমেদের নাম উল্লেখ করা যায়। ৫ বছরে তাঁর ২ হাজার ২৩৮ শতাংশ (প্রায় ৪ কোটি ৮৮ লাখ)। ১৫ বছরে সম্পদ বৃদ্ধিতে শীর্ষে রয়েছেন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার, হার ৬ হাজার ৩৫০ (প্রায় ১০ কোটি) শতাংশ।

সংবাদ সম্মেলনে টিআইবি বলেছে, তাদের কাছে প্রাপ্ত নির্ভরযোগ্য তথ্য অনুযায়ী সরকারের মন্ত্রিসভার একজন সদস্যের নিজ নামে যুক্তরাজ্যে একাধিক কোম্পানি রয়েছে, যা হলফনামায় দেখানো হয়নি। মন্ত্রী ও তাঁর স্ত্রীর মালিকানাধীন ছয়টি কোম্পানি এখনো যুক্তরাজ্যে আবাসন ব্যবসা পরিচালনা করছে। ছয়টি কোম্পানির বর্তমান সম্পদমূল্য বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ২ হাজার ৩১২ কোটি টাকা। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীর নাম তারা প্রকাশ করেনি। তবে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সরকারি কোনো কর্তৃপক্ষ চাইলে তাঁরা তথ্য-প্রমাণ দেবেন।

হলফনামায় কিশোরগঞ্জ-৩ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের শ্রমবিষয়ক সম্পাদক গোলাম কবির ভূঞা লিখেছেন, তাঁর ৬৪৬ একরের বেশি কৃষিজমি রয়েছে। সবচেয়ে বেশি ৮১৩ একর অকৃষিজমির মালিক জামালপুর-৫ আসনের জাতীয় পার্টির প্রার্থী মো. জাকির হোসেন। অথচ ভূমি সংস্কার আইন-২০২৩ অনুযায়ী একজন ব্যক্তি কৃষি-অকৃষি মিলিয়ে ১০০ বিঘার বেশি জমি রাখতে পারেন না। আইনের বাইরে এই বিপুল পরিমান জমির মালিক তাঁরা কীভাবে হলেন।

এর পাশাপাশি যাঁদের ভোটে মন্ত্রী–এমপিরা নির্বাচিত (!) হয়েছেন, কিংবা ভবিষ্যতে হবেন বলে আশা করছেন, তাঁদের আর্থিক অবস্থাটা মিলিয়ে দেখা যাক।

গত বছর অক্টোবরে ‘সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনী: বাংলাদেশ কোথায় দাঁড়িয়ে’ শীর্ষক ওয়েবিনারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক বজলুল হক খন্দকার বলেছিলেন, দেশের প্রায় ২৫ শতাংশ মানুষ অরক্ষিত। তারা যেকোনো ধাক্কায় হঠাৎ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যেতে পারে, কোভিডের সময় যা দেখা গেল। সে জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় ৫৫ থেকে ৬০ শতাংশ মানুষকে নিয়ে আসা উচিত।

সরকার সামাজিক নিরাপত্তা খাতে জিডিপির ২ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ৩ শতাংশ বরাদ্দ দিয়েছে। তবে সরকারি কর্মচারীদের পেনশন বাদ দিলে তা ১ দশমিক ৫ থেকে ১ দশমিক ৭ শতাংশে নেমে আসে।

সরকার ১ কোটি পরিবারকে সহায়ক স্মার্ট কার্ড দিয়েছে, যারা এই কার্ড দেখিয়ে সাশ্রয়ী দামে চাল, ডাল, পেঁয়াজ ও ভোজ্যতেল কিনতে পারবেন। প্রতি পরিবার সপ্তাহে ৫কেজি চাল দেওয়া হয় ৩০ টাকা করে। বাজারে ৫০টাকার কমে কোনো চাল পাওয়া যায় না। অর্থাৎ এই পরিবারগুলোর বাজার দামে অতি প্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্য কেনার সামর্থ্য নেই। টিসিবির ট্রাকের সামনে নারী–পুরুষের সারি আরও বড় হচ্ছে। প্রতি পরিবারে পাঁচজন সদস্য ধরলেও এই স্মার্টকার্ডের সুবিধা নিচ্ছেন ৫কোটি লোক।  এর বাইরে সরকারের সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় ভাতাধারীদের ধরলে আরও এক কোটি মানুষ যুক্ত হবে।এই ছয় কোটি মানুষের বেঁচে থাকার জন্য সরকারের কোনো না কোনো সহায়তা দরকার।

বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি একবার গর্ব করে বলেছিলেন বাংলাদেশের চার কোটি মানুষের জীবনযাত্রার মান ইউরোপের মানুষের জীবনযাত্রার মানের সমান। তিনি ওপরের চার কোটির কথা বলেছেন। কিন্তু নিচের চার কোটির জীবনযাত্রার মান যে আফ্রিকার অনেক দেশের নিচে সে কথা বলেননি। আমাদের মন্ত্রী–এমপিরা মুদ্রার একটা পিঠই দেখতেই পছন্দ করেন।  

বঙ্গবন্ধু যেই দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চেয়েছিলেন, তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি। বরং সেই দুঃখী, রিক্ত–নিঃস্ব মানুষকে নিয়ে যারা রাজনীতি করছেন, যারা এমপি মন্ত্রী হচ্ছেন, তারা সম্পদের পাহাড় গড়ছেন। এর অর্থ এই নয় যে যারা মন্ত্রী–এমপি হননি, তারা সবাই শুদ্ধাচার চর্চা করছেন।

আমাদের দেশের এই জনপ্রতিনিধিদের ৯০ শতাংশ ‘অস্থানীয়।’ অর্থাৎ তারা ৩০০ আসনে নির্বাচন করলেও স্থায়ীভাবে ঢাকায় থাকেন। আবার কেউ কেউ লন্ডন, ম্যানিলা, দুবাই, টরেন্টো. নিউইয়র্কেও বাড়ি করেছেন। এলাকাবাসীর সঙ্গে কেবল ভোটের সময়ই দেখা হয়। এটাই হলো স্মার্ট বাংলাদেশের স্মার্ট জনপ্রতিনিধিদের বৈশিষ্ট্য।

হলফনামায় বর্ণিত কোটিপতি, শতকোটিপতিদের আগাম মোবারকবাদ।

  • সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্মসম্পাদক ও কবি