বাংলাদেশে শিক্ষিত তরুণদের অবস্থা কতটা ভয়াবহ, তা জানতে কোনো জরিপ কিংবা গবেষণার প্রয়োজন হয় না। রাস্তায় নামলেই তাঁদের বেদনাদীর্ণ চেহারা দেখা যায়। প্রত্যেক বেকার তরুণ বা তরুণীর আছে একেকটি কাহিনি; বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ করেও যাঁদের বছরের পর বছর চাকরির জন্য অপেক্ষা করতে হয়। একের পর এক পরীক্ষা দিয়েও নিশ্চিত হওয়া যায় না। কেননা, পদের তুলনায় প্রার্থীর সংখ্যা অনেক অনেক গুণ বেশি।
কয়েক দিন আগে চাকরির বয়স ৩৫–প্রত্যাশী তরুণেরা আন্দোলন করতে গিয়ে পুলিশের হাতে মার খান। তারপরও তাঁরা কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছেন। সমাবেশ করেছেন। অনশন পালন করেছেন। মামলা দিয়ে ১৩ জন চাকরিপ্রার্থীকে আদালত পর্যন্ত পাঠানো হয়েছিল, যাঁদের মধ্যে তিনজন নারী ছিলেন। স্বাধীন দেশে চাকরি চাইতে গিয়ে কেন তরুণদের এভাবে হেনস্তা হতে হবে?
পুলিশের করা মামলার বিবরণ পড়লে মনে হবে, তাঁরা দুর্ধর্ষ অপরাধী। শাহবাগ থানায় করা মামলায় বলা হয়, ‘“সরকারি চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা ৩৫ চাই”-এর কেন্দ্রীয় কমিটির উদ্যোগে ১১ মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি মোড়ে রাজু ভাস্কর্যের সামনে বিভিন্ন ব্যানার–ফেস্টুন নিয়ে আসামিরা সভা ও মিছিল-মিটিং করেন। এদিন তাঁরা টিএসসি থেকে শাহবাগ মোড় ঘেরাও করার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন ব্যানার, ফেস্টুন, জীবননাশকারী পদার্থ দাহ্য জ্বালানিসহ আত্মহত্যার স্লোগান ও বিভিন্ন ভয়ভীতি দেখিয়ে মিছিল নিয়ে আসেন পাবলিক লাইব্রেরির সামনে পাকা রাস্তার ওপর।... হ্যান্ড মাইক ও মৌখিকভাবে রাস্তা ছেড়ে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করলে তাঁরা রাস্তা না ছেড়ে ডিউটিরত পুলিশের সঙ্গে মারামারিতে জড়িয়ে পড়েন।’
বেকার যুবকেরা মারামারিতে জড়িয়ে পড়েছেন আর পুলিশ শান্তির ললিত বাণী শুনিয়েছে, এটা ভাবার কোনো কারণ নেই। ৩৫–প্রত্যাশীরা যে শাহবাগ মোড়ে কতবার পুলিশের হাতে মার খেয়েছেন, কত মন্ত্রী–এমপি–আমলার বারান্দায় ঘুরেছেন, তার হিসাব নেই।
এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের গ্রন্থাগারে প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও বহিরাগতদের ঠেকাতে স্মার্ট কার্ড ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাদের অভিযোগ, বিসিএস পরীক্ষার্থীরা ভোর থেকেই গ্রন্থাগারের সামনে লাইন দিয়ে বসে থাকেন, খোলার সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা সেখানে ঢুকে বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে থাকেন। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য শিক্ষার্থীরা বসার জায়গা পান না।
জনপ্রশাসন, ব্যাংক–বিমা, বিশ্ববিদ্যালয়, সর্বত্র নিজস্ব লোক বসানোর বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছেন দুই অর্থনীতিবিদ। গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় আগামী দিনের করণীয় বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, ‘উচ্চ পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে শুধু রাজনৈতিক আনুগত্য দেখা হলে মেধাবঞ্চিত হয়। তাই সব ক্ষেত্রে না পারলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে অবশ্যই মেধাকে গুরুত্ব দিতে হবে।’
অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানের মতো পাবলিক সার্ভিস কমিশনও (পিএসসি) একটি পথনকশা তৈরি করেছিল। বছরে একটি বিসিএস পরীক্ষা শেষ করবে। কিন্তু সেটা তারা বাস্তবায়ন করতে পারেনি। পিএসসি হয়তো করোনাকে কারণ হিসেবে দেখাবে। দুই বছর আগেই করোনা শেষ হয়েছে। এর মধ্যে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে বাস্তবায়নের কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারত।
ডেইলি স্টার–এর প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ৪১তম বিসিএস পরীক্ষা শেষ করতে চার বছর চার মাস সময় নিয়েছে পিএসসি। ৪৩তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করতে সময় লেগেছে তিন বছর এক মাস। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এখনো এই পরীক্ষার গেজেট বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেনি। ৪৬তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি হয় ২৬ এপ্রিল, ফল প্রকাশিত হয় ১৩ দিনের মাথায়। এতে প্রমাণিত হয়, পিএসসি চাইলে পরীক্ষাজট কমাতে পারে। ৪৪ ও ৪৫তম বিসিএসও প্রক্রিয়াধীন। এটা কত দ্রুত তারা শেষ করতে পারে, সেটাই দেখার বিষয়।
৪১তম বিসিএসে অংশ নেওয়া একজন পরীক্ষার্থী তাঁর বঞ্চনার কথা জানাতে গিয়ে বলেছেন, ২০১৯ সালে শুরু হওয়া ৪১তম বিসিএসের চূড়ান্ত পরীক্ষা হয় ২০২৩ সালে। তিনি উত্তীর্ণ হয়েও চাকরি পাননি সুপারিশ করা পদ খালি না থাকায়। বাধ্য হয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যোগ দিয়েছেন। ইতিমধ্যে তাঁর বয়স ৩০ বছর পার হয়ে গেছে। এ রকম অনেক তরুণ–তরুণীর উজ্জ্বল সময় চলে গেছে চাকরির আবেদন করতে, পরীক্ষা দিতে ও ফল পেতে।
সে ক্ষেত্রে ৩৫–প্রত্যাশীদের দাবি অযৌক্তিক বলার সুযোগ কোথায়?
এই মুহূর্তে যে প্রশ্নটি সামনে আসে, তা হলো উচ্চশিক্ষিত তরুণেরা কেন দলে দলে বিসিএসে ঝুঁকে পড়েছেন? কারণ, বেসরকারি খাতে চাকরির বাজার মন্দা। সরকার ঘরে ঘরে চাকরি দেওয়ার যে অঙ্গীকার করেছিল, তার ধারেকাছেও যায়নি। কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বিদেশি বিনিয়োগ আসছে না। গ্যাস–বিদ্যুৎ–সংকটের কারণে বেসরকারি খাতেও স্থবিরতা চলছে। অন্যদিকে প্রতিবছর ২২ থেকে ২৩ লাখ জনশক্তি চাকরির বাজারে প্রবেশ করছে। তাঁদের মধ্যে খুব বেশি হলে ৬ থেকে ৭ লাখ বিদেশে যেতে পারেন। অন্যরা দেশেই থাকছেন এবং সরকারি চাকরির জন্য মরিয়া।
বিসিএস পরীক্ষার ফল প্রকাশে বিলম্ব কেন? পিএসসি বলছে, সাধারণত দুজন পরীক্ষককে দিয়ে খাতা দেখানো হয়। তাঁরা সময়মতো খাতা জমা না দেওয়ায় ফল প্রকাশে বিলম্ব হচ্ছে। আবার দুই পরীক্ষকের নম্বরের পার্থক্য ২০–এর বেশি হলে তৃতীয় পরীক্ষককে দেখাতে হয়। এখানে ঢাকঢাক–গুড়গুড়ের কোনো সুযোগ নেই। যেসব পরীক্ষক সময়মতো খাতা জমা দিতে পারছেন না, তাঁদের বাদ দিতে হবে। প্রয়োজনে অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও সরকারি কর্মকর্তাদেরও খাতা দেখাতে পারে পিএসসি। সেই সঙ্গে পরীক্ষকদের সম্মানী বাড়াতে হবে।
এ প্রসঙ্গে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বলেন, ১২ মাসে একটি বিসিএস শেষ করতে না পারার কোনো কারণ নেই। প্রতিবেশী ভারত প্রতিবছর একটি করে ব্যাচ তাদের সিভিল সার্ভিসে ঢোকাচ্ছে। আমরা কেন পারছি না? বেকারদের সোনালি সময় কারা কেড়ে নিচ্ছে? যেকোনো অবস্থায় এক বছরে বিসিএস শেষ করার প্রত্যয় থাকতে হবে।
সবচেয়ে দুঃখজনক হলো, সব প্রক্রিয়া শেষ করে পিএসসির সুপারিশের পরও চাকরি না হওয়া। এ ক্ষেত্রে পুলিশ ভেরিফিকেশনকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। পুলিশ ভেরিফিকেশন ব্রিটিশ আমল থেকে হয়ে আসছে। কিন্তু এখনকার মতো এতটা রাজনীতিকরণ হয়নি কখনো। বিরোধী দলের কোনো নেতা–কর্মীর সঙ্গে আত্মীয়তা আছে, এই অজুহাতে চূড়ান্ত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ কাউকে চাকরি থেকে বঞ্চিত করা কেবল বেআইনি নয়, অমানবিকও। জাতীয় রাজনীতিতে যদি এই আত্মীয়তা সমস্যা না হয়ে থাকে, বিসিএস পরীক্ষার্থীদের বেলায় কেন হবে?
বিএনপি ও জাতীয় পার্টির আমলে কি কোনো আওয়ামী লীগ নেতার আত্মীয়, তস্য আত্মীয় নিয়োগ পাননি? এখন যাঁরা প্রশাসনের শীর্ষ পদে আছেন, তাঁদের বেশির ভাগ বিএনপির আমলে নিয়োগ পাওয়া। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের দলীয় কর্মচারী হিসেবে গণ্য করা কোনোভাবে ঠিক নয়।
সরকার দেখতে পারে, সংশ্লিষ্ট প্রার্থীর বিরুদ্ধে কোনো ফৌজদারি মামলা আছে কি না কিংবা তিনি জেল খেটেছেন কি না। ফৌজদারি মামলারও রকমফের আছে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ফৌজদারি মামলা হলে সেটি এ ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে না।
জনপ্রশাসন, ব্যাংক–বিমা, বিশ্ববিদ্যালয়, সর্বত্র নিজস্ব লোক বসানোর বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছেন দুই অর্থনীতিবিদ। গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনের বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় আগামী দিনের করণীয় বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, ‘উচ্চ পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে শুধু রাজনৈতিক আনুগত্য দেখা হলে মেধাবঞ্চিত হয়। তাই সব ক্ষেত্রে না পারলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে অবশ্যই মেধাকে গুরুত্ব দিতে হবে।’
ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন এর চেয়েও যে কঠিন বার্তাটি দিয়েছেন, তা অনেকের পক্ষে হজম করা কঠিন। তাঁর ভাষায়, ‘রাজনীতিবিদেরা অর্থনীতিবিদদের গৃহভৃত্য না হলেও হুকুমের আজ্ঞাবহ হিসেবে দেখতে চান।’ নিশ্চয়ই তিনি দূর অতীতে দেশ শাসন করেছে, এমন কোনো সরকারের প্রতি এই ইঙ্গিত করেননি।
● সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
sohrabhassan55@gmail.com