যুদ্ধ কি পৃথিবীতে কম হয়েছে? তেলসংকট কি এর আগে কখনো হয়নি? হয়েছে তো। বিশ্বযুদ্ধের পর যে যুদ্ধগুলো তেল-সংকট সৃষ্টি করেছিল, তার মধ্যে ছিল সত্তরের দশকে ইয়ম কুপ্পির যুদ্ধ, আশির দশকে ইরাক-ইরান যুদ্ধ, নব্বইয়ের দশকে উপসাগরীয় যুদ্ধ। সত্তরের দশক থেকেই পুরো বিশ্ব অনুধাবন করেছে, জ্বালানি নিরাপত্তা রক্ষার জন্য দেশীয় জ্বালানির ওপর নির্ভরতা বাড়াতে হবে। সংকটে পড়েই দেশে দেশে নতুন নতুন জ্বালানি সম্পদ অনুসন্ধানের হিড়িক পড়ে গিয়েছিল। জ্বালানি খাতে স্বনির্ভরতার প্রবণতা তখন দক্ষিণ এশিয়া পর্যন্তও বিস্তৃত হয়েছিল।
বাংলাদেশে দেশীয় গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনও সে সময় থেকেই বাড়তে থাকে। গত পঞ্চাশ বছরে তেলের দামের ওঠানামা নিয়ে বিজ্ঞজনেরা অনেক গবেষণা করেছেন। শিখেছেন বৈশ্বিক সংকটে অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি যেন ধসে না যায়, সে জন্য কী করতে হবে। সত্তরের দশকের তেলসংকট, অর্থনৈতিক সংকট ও খাদ্যসংকট থেকে নতুন করে আবার পুরো বিশ্ব শিখেছে, কেন জ্বালানি খাত, কৃষি, খাদ্যশিল্প ও স্বাস্থ্য খাতকে কৌশলগত খাত হিসেবে বিবেচনা করা জরুরি। তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে, এ শিক্ষা কি সরকার ভুলে গেছে, নাকি জেনেও না জানার ভান করছে?
এ বছর প্রতি মাসে ৫ শতাংশ করে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী বলেছেন আর ভর্তুকি দেবেন না। যেন ভর্তুকির অর্থ জনগণের না। যেন আসমানি-অর্থ নাজিল হয়েছে সরকারের ইচ্ছা-অনিচ্ছায়। যেখানে-সেখানে খরচ করায় কারও কোনো আপত্তি গ্রহণযোগ্য নয়, তাই দাম নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের কাছ থেকে সম্পূর্ণ নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে সরকার।
জ্বালানি ও বিদ্যুতের এ সংকট বহুদিনের ভুল নীতির কারণেই তৈরি হয়েছে। নব্বইয়ের দশক থেকে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত উদারীকরণ করেছে। নব্বই ও ২০০০-এর দশকজুড়ে বেসরকারি ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্ল্যান্টগুলোকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের দায়িত্ব দেওয়ায় বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ বেড়েছে। ২০১০-এর দশকে এসে যখন রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্ট উৎপাদন বেড়েছে, সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা করেই জ্বালানি আমদানিনির্ভরতা বাড়ানো হয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিদেশি ঋণনির্ভর কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের মতো ব্যয়বহুল প্রকল্প। পায়রা, রামপাল ও আদানির গোড্ডা বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ গ্রিডে যুক্ত হয়েছে। বাড়তি উৎপাদন খরচ ও ক্যাপাসিটি চার্জ দিতেই বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে জনগণের ওপর বাড়তি আর্থিক বোঝা চাপানো হচ্ছে।
কেউ যদি বলে সব দোষ বৈশ্বিক রাজনীতির, এমন হবে আমরা জানতাম না, অথবা এগুলো আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই, তাহলে বলতে হবে এ অজ্ঞতা ক্ষমাযোগ্য নয়। সুষ্ঠু পরিকল্পনা সংকট মাথায় রেখেই করতে হয়, সংকটকে অদৃষ্টবাদীর মতো অদৃশ্য শক্তির হাতে ছেড়ে দিয়ে নয়।
প্রকল্পগুলোতে চীন, জাপান, রাশিয়া ও ভারতের ঋণে যৌথ মালিকানায় হলেও ঋণ পরিশোধের দায় তো পুরোপুরি বাংলাদেশেরই। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে রাশিয়ান ঠিকাদার দেরি করলেও নির্ধারিত দেরির ক্ষতিপূরণ দিতে হয় বাংলাদেশকেই। বিবিধ উপায়ে বাংলাদেশ যেসব চুক্তিতে আবদ্ধ হচ্ছে, তাতে আমদানিনির্ভর বিদ্যুৎ খাত একটা বোঝা হয়ে গেছে। অথচ এর আগের সংকট থেকে পুরো বিশ্ব শিখেছে, জ্বালানি নিরাপত্তা রক্ষার্থে দেশীয় জ্বালানির ব্যবহার করতে হবে।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে গ্যাস ছিল আশীর্বাদ। কিন্তু এ খাতই সবচেয়ে অবহেলিত ছিল এত দিন। ডেনমার্কের প্রকৌশল ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান র্যাম্বল বাংলাদেশের গ্যাস খাতে মহাপরিকল্পনা করেছিল ২০১৮ সালে। তাদের সুপারিশ ছিল, ২০২১ থেকে ২০৩০ সাল পর্যন্ত ৩ বিলিয়ন ডলার গ্যাস আমদানির পেছনে খরচ না করে, দেশীয় গ্যাস উত্তোলনে বিনিয়োগ করা উত্তম। সরকারের কমিশন করা প্রতিষ্ঠানই যখন এমন সুপারিশ করে, তখনো বাংলাদেশ অনাবিষ্কৃত গ্যাস অনুসন্ধান করেনি।
অথচ সংকট শুরুর পর গত এক বছরে বাপেক্সকে নড়েচড়ে উঠতে দেখা গেল। মোট ৯টি কূপ খনন করেছে এরই মধ্যে। মাত্র ৮১২ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে ১ লাখ কোটি টাকার এলএনজি আমদানি সাশ্রয় করেছে বাপেক্স। যে উদ্যোগ অনেক আগেই নেওয়া যেত, সেই উদ্যোগ সংকটের সময় নিতে হলো?
বিদ্যুৎ ও তেলের দাম যা বাড়ার বেড়ে গিয়ে মূল্যস্ফীতি তৈরি করেছে। এখন সরকারের সামনে মূল চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে আগের অঙ্গীকারবদ্ধ প্রকল্পের দায় পরিশোধ। সম্প্রতি নতুন নতুন প্রকল্প (রামপাল, আদানি, পায়রা) গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু করেছে। সামনে আরও প্রকল্পও সরবরাহ শুরু করবে। এর জন্য জ্বালানি কিনতে হলে ডলারে পরিশোধ করতে হবে।
এদিকে এ মাসেই রিজার্ভের পরিমাণ গত ছয় বছরে সর্বনিম্ন ৩১ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। ২০২২-এর মার্চে রিজার্ভ ছিল ৪৬ বিলিয়ন ডলার। এক বছরে গ্রস রিজার্ভ কমেছে ১৫ বিলিয়ন ডলার। আশঙ্কা রয়েছে, রিজার্ভ-সংকট আরও প্রকট হবে। রিজার্ভ দ্রুত কমে যাওয়ার মূল কারণ, আমাদের অর্থনীতির আমদানি নির্ভরতা এবং ঋণনির্ভর প্রকল্প। অথচ দায়ী করা হচ্ছে ডলারের দাম বৃদ্ধিকে। যেকোনো বৈশ্বিক কারণে ডলারের দাম যে যেকোনো সময় বেড়ে যেতে পারে, এসব কি আমাদের জানা ছিল না?
প্রতিটি প্রকল্পে এখন বাংলাদেশকে বেশি খরচ করতে হচ্ছে। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের আগে বিদ্যুতের দাম বলা হয়েছিল ৮ টাকা। কিন্তু জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরুর সময় জানা গেল, প্রতি ইউনিটের দাম ১৮ দশমিক ৩৯ টাকা। সংকট হলে যে যেকোনো জ্বালানির দাম বাড়তে পারে, তা কীভাবে চিন্তা না করে থাকতে পারেন তথাকথিত বিজ্ঞ নীতিনির্ধারকেরা? যদি বলেন, সংকট হবে জানতেন না, তাহলে জিজ্ঞেস করতে হবে, পরিকল্পনা কীভাবে সংকট মাথায় না রেখে হয়? পরিকল্পনার অন্যতম উদ্দেশ্যই তো সংকটে করণীয় নির্ধারণ করা।
যদিও বলা হচ্ছে বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ, আদতে খাদ্যদ্রব্য আমদানির ওপর নির্ভরতা কমেনি। গত এক বছরে ভোজ্যতেলের দাম বেড়েছে। মানুষের মধ্যে অসন্তোষ ছড়িয়ে পরায় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন শর্ষের তেল, বাদামের তেল, তিসির তেলের ওপর নির্ভরতা বাড়াতে। অথচ আমাদের দেশেই একসময় ভোজ্যতেল উৎপাদন হতো। রাষ্ট্রীয় মালিকানায় চিনি ও খাদ্যশিল্প প্রতিষ্ঠানের অধীনেই তেল উৎপাদন হতো এবং এ প্রতিষ্ঠানই নিজে তেল আমদানি করে অভ্যন্তরীণ বাজারে দাম সামর্থ্যের মধ্যে রাখতে পারত। উৎপাদন বন্ধ করে আমদানি করার জন্য যখন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেওয়া হয়, তখন থেকেই সরকার তেলের বাজারের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারানো শুরু করে।
এ মাসেই ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরের একটি আলোচনা সভায় উঠে এসেছে ব্রয়লার মুরগির উৎপাদন খরচ ১৩০ টাকা হলেও বিক্রি হচ্ছে ২৫০ টাকা দরে। কেউ কেউ মুরগির বেশি দাম দেখে না কিনেই, অথবা মুরগির পা, গিলা, কলিজা, চামড়া কিনে বাড়ি ফিরছেন। আস্ত মুরগি ক্রয়ক্ষমতায় কুলাচ্ছে না বলে পিস পিস হিসেবে বিক্রি হচ্ছে। যাঁরা অল্প পরিমাণ কিনে নিয়ে যাচ্ছেন, তাঁরা মুরগির মাংসই খেতে পারছেন না। খাচ্ছেন মুরগির গন্ধ। এদিকে মুরগির দাম নাকি অদৃশ্য উৎস থেকে আসা এসএমএসের মাধ্যমে নির্ধারিত হচ্ছে। বড় বড় উৎপাদক যে দামে বিক্রি করেন, অন্যরাও সে দামে বিক্রি করতে বাধ্য হন।
সক্রিয় হয়েছে অদৃশ্য সিন্ডিকেট। কাজেই আমরা দেখছি, সরকার বাজারের ওপর সব ছেড়ে দেওয়ায় ধীরে ধীরে মানুষের প্রধান খাদ্যের উৎস মুরগি ও ডিমের দামের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছে। যে সরকারের কথা ছিল বাজারকে অসাধু তৎপরতা থেকে রক্ষা করা, খাদ্যপণ্যের দাম মানুষের সামর্থ্যের মধ্যে রাখা, সে সরকার তা না করে সুবিধা করে দিচ্ছে গুটিকয় বৃহৎ ব্যবসায়ীদের। একদিকে তেলের দাম, পরিবহন খরচ বাড়িয়ে উৎপাদন খরচ বাড়ানো হয়েছে, অন্যদিকে এ উৎপাদন খরচের অজুহাত দেখিয়ে ব্যবসায়ীদের বেশি দামে খাদ্যপণ্য বিক্রির সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে। সবকিছুতে ইউক্রেন যুদ্ধ এবং ডলার-সংকটের দোষ দিয়ে প্রয়োজনমতো সরকার দেখাচ্ছে নিয়ন্ত্রণ আর তার হাতে নেই। অথচ নিয়ন্ত্রণ কার হাতে, তা আমরা ভালোমতোই দেখতে পাচ্ছি প্রতিদিন।
চিনির ক্ষেত্রেও ছয়টি রাষ্ট্রীয় চিনিকল বন্ধ করে সরকার বেসরকারি রিফাইনারি মালিকদের সুবিধা দিয়েছে। ঢাকার বাজারে এখন প্রতি কেজি চিনি বিক্রি হচ্ছে ১১০ থেকে ১২০ টাকা, যা এক বছর আগে ছিল ৭৫ থেকে ৮০ টাকা। অর্থাৎ, গত এক বছরে চিনির দাম ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। পবিত্র রমজান সামনে রেখে দাম কমাতে সরকার নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক কমিয়েছে এবং আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার করেছে। কিন্তু তাতেও দাম কমেনি। চিনির শুল্ক কমার অর্থ রাজস্ব আয় কমা। এ আয় জনগণের সেবায় ব্যবহারের কথা ছিল। ব্যবসায়ীদের এত সুবিধা দিয়েও জনগণের কাছে যে কোনো সুফল পৌঁছাচ্ছে না, এর পেছনে কারণ কী? খাদ্যশিল্প যে একটি কৌশলগত খাত, আর এর নিয়ন্ত্রণ যে পুরোপুরি বাজারের হাতে ছেড়ে দিলে হবে না, এ মৌলিক জ্ঞান সারা পৃথিবী পূর্ববর্তী সংকটের সময়ই উপলব্ধি করেছে। কিন্তু সেই জ্ঞানের চর্চা নেই। এর দায় কার? নিশ্চয়ই ইউক্রেন যুদ্ধের নয়। দোষ আমাদের অভ্যন্তরীণ ভুল নীতির।
কেউ যদি বলে সব দোষ বৈশ্বিক রাজনীতির, এমন হবে আমরা জানতাম না, অথবা এগুলো আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই, তাহলে বলতে হবে এ অজ্ঞতা ক্ষমাযোগ্য নয়। সুষ্ঠু পরিকল্পনা সংকট মাথায় রেখেই করতে হয়, সংকটকে অদৃষ্টবাদীর মতো অদৃশ্য শক্তির হাতে ছেড়ে দিয়ে নয়। ১১ মার্চ আন্তর্জাতিক বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলনকেন্দ্রে ‘বাংলাদেশ বিজনেস সামিট’ উদ্বোধনের সময় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন ‘বেসরকারি খাতের বিকাশে আমি সবকিছু উন্মুক্ত করে দিয়েছি।’ এ বেসরকারি খাত যে জনগণ নয়, গুটিকয় কয়েক ব্যবসায়ী—এটাই সংকটকালে আরও প্রকটভাবে অনুধাবন করছে সাধারণ মানুষ।
মোশাহিদা সুলতানা সহযোগী অধ্যাপক, অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
moshahida@du.ac.bd