গল্পটা ভবিষ্যতের।
নাম না জানা একটি গ্রহে গিয়ে গর্ভবতী এক নারী নভোচারী একটি ছেলে সন্তান প্রসব করে মারা গেলেন। ছেলেটি বেঁচে গেল। তার নাম সুহান। অনেক বছর পর সেই গ্রহে পৃথিবী থেকে আবার কয়েকজন মহাকাশবিজ্ঞানী ও কিরি নামের শক্তিধর একটি রোবট গেল। তত দিনে সুহান যুবক হয়েছে। একপর্যায়ে কিরির সঙ্গে সুহানের যুদ্ধ বাধল। সুহানের হাতে ছিল পাইপগানের মতো বন্দুক। সেই বন্দুকে কোনো প্রযুক্তি নেই। লেজার রশ্মি নেই। সেই অস্ত্র সে কিরির দিকে তাক করল।
কিরি দশম প্রজাতির রোবট। তার দিকে তাক করা অস্ত্রের লেজার রশ্মি দৃষ্টি নিবদ্ধ করা মাত্র কিরির কপোট্রনের হাইপার কিউব সেই তাক করা অস্ত্রের মেগা কম্পিউটারকে অচল করে দিতে পারে। কিরিকে গুলি করা মাত্র সে ছুটে আসা বিস্ফোরকের গতিপথ অস্ত্রধারীর দিকেই ঘুরিয়ে দিতে পারে।
কিরি সুহানকে বলল: তুমি কি জানো আমি অজেয়? আমাকে হত্যা করতে যাওয়ার অর্থ নিশ্চিত মৃত্যু?
কিরি অজেয়—এই কথা জেনেও সুহান ট্রিগার টানল। কিরি হতবাক হয়ে দেখল, সুহানের মান্ধাতা আমলের অস্ত্র থেকে ছুটে আসছে শুধু একটি সাদামাটা গোলা। কিরির কপোট্রনের শক্তিশালী বিদ্যুৎক্ষেত্র গোলাটির গতি নিয়ন্ত্রণকারী কম্পিউটারকে বিকল করতে চাইল। কিন্তু সে দেখল, এই বিস্ফোরকটিতে কোনো কম্পিউটারই নেই। কিরি দেখল, সুহানের প্রাগৈতিহাসিক অস্ত্র থেকে ছুটে আসছে একটি অন্ধ বিস্ফোরক, তাকে থামানোর কোনো উপায় তার হাতে নেই।
মান্ধাতা আমলের প্যারাগ্লাইডার ধরনের ‘যানে’ উড়ে উড়ে, উঁচু উঁচু লোহার তারের বেড়া ডিঙিয়ে ফিলিস্তিনি যোদ্ধাদের ইসরায়েলের মাটিতে নামার দৃশ্য যখন চোখে পড়ছিল, তখন মুহম্মদ জাফর ইকবালের সায়েন্স ফিকশন নিঃসঙ্গ গ্রহচারীর সেই সুহান আর কিরির অসম যুদ্ধের ছবি চোখে ভাসছিল।
এর আগে অনেকবার ফিলিস্তিনের হামাস যোদ্ধারা ইসরায়েলের দিকে প্রত্যাঘাত হিসেবে অগণিত ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে। কিন্তু ইসরায়েলের তাতে ক্ষতি হয়েছে সামান্যই। কারণ, ইসরায়েলের হাতে আছে ক্ষেপণাস্ত্রবিধ্বংসী প্রযুক্তি ‘আয়রন ডোম’।
আয়রন ডোম ইসরায়েলের দিকে ছুটে আসা রকেট রাডারে শনাক্ত করে আকাশেই ধ্বংস করে দিতে পারে। কিন্তু হামাসের যোদ্ধারা যে উড়ুক্কু ‘যানে’ চড়ে আক্রমণ চালিয়েছে, তা ছিল নিঃসঙ্গ গ্রহচারী সুহানের বন্দুকের মতো।
সুহানের বন্দুকে কোনো কম্পিউটারাইজড সিস্টেম কিংবা লেজার রশ্মি না থাকায় রোবট কিরি যেমন প্রতিরোধ করতে না পেরে অসহায়-বিস্ময়ে চেয়ে থেকেছিল, ইসরায়েলের রাডার সিস্টেম প্যারাগ্লাইডারে নেমে আসা যোদ্ধাদের দেখে অনেকটা সে রকম অসহায় হয়ে পড়েছিল। আবাবিলের মতো ঝাঁক বেঁধে ফিলিস্তিনি যোদ্ধারা নেমেছে ইসরায়েলের মাটিতে। অন্যদিকে গাজা থেকে তারা রকেট ছুড়েছে এবং বুলডোজার দিয়ে লোহার উঁচু বেড়া ভেঙে ফেলে ইসরায়েলের দখল করে নেওয়া জমিতে ঢুকে পড়েছে।
মধ্যপ্রাচ্যের নিউজ পোর্টাল মিডল ইস্ট আই-কে গাজার একজন ফিলিস্তিনি সাংবাদিক বলেছেন, ভেঙে ফেলা বেড়া ডিঙিয়ে তিনি যখন ইসরায়েলের দখল করা জমিতে পা রাখলেন, তখন তাঁর চোখ ভিজে গিয়েছিল। এই মাটিতে পূর্বপুরুষদের বসতি ছিল। আগ্রাসী ইসরায়েল দেয়াল তুলে সেই মাটি দখল করেছে। সেখানে ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনভাবে পা রাখার সুযোগ নেই।
হামাসের হামলায় এখন পর্যন্ত ইসরায়েলি সেনারাসহ নয় শতাধিক জনের মতো নিহত হয়েছে। বন্দিবিনিময়ের মাধ্যমে ইসরায়েলের কারাগারে বছরের পর বছর আটক থাকা ফিলিস্তিনি রাজবন্দীদের ছাড়িয়ে আনার কথা মাথায় রেখে হামাস যোদ্ধারা ইসরায়েলের শতাধিক সেনা ও বেসামরিক লোককে বন্দী করেছে।
অন্যদিকে, ইসরায়েলের সেনারা গাজায় ঢুকে হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ শুরু করেছে। গাজার আবাসিক ভবনগুলোতে বিমান থেকে বোমা ফেলা হচ্ছে। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু গাজাকে ‘জনমানবহীন’ করে ফেলার ঘোষণা দিয়েছেন।
পশ্চিম তীরের প্রায় পুরোটাই ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীদের দখলে চলে গেছে। কয়েক দিন আগেও নেতানিয়াহু জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ অধিবেশনে বলে এসেছেন, ইসরায়েলের নেতৃত্বে তিনি নতুন মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্র তৈরি করবেন। তাঁর সেই মানচিত্রে তিনি গাজার অস্তিত্ব রাখেননি। এখন ইসরায়েল বলছে, গাজাকে গিলে ফেলবে। তারা গেলা শুরু করেও দিয়েছে। আর বরাবরের মতো চুপ করে আছে বিশ্ববিবেক। পিঠ ঠেকে যাওয়া ফিলিস্তিনিরা এখন কী করবে?
যুক্তরাষ্ট্রসহ বড় বড় শক্তি ইসরায়েলের পক্ষ নিয়েছে, তাদের সমর্থনে যুদ্ধ সরঞ্জাম পাঠাচ্ছে। তার মানে এই রক্তক্ষয় প্রলম্বিত হবে। ইসরায়েলে অভিযান চালানোর পরিণতি ভয়াবহ হবে—এটি হামাসের না জানার কারণ নেই। হামাস তাহলে কেন এই হামলা চালাল? সে প্রশ্নের জবাব খুঁজতে বিশ্লেষকেরা ধারাভাষ্য দিয়ে যাচ্ছেন।
সাধারণভাবে যেসব ভাষ্য পাওয়া যাচ্ছে, সোজাসাপ্টা ভাষায় তা হলো, এই অতর্কিত অভিযান চালানো ছাড়া ফিলিস্তিনিদের সামনে পথও খোলা ছিল না। বলা যায়, পশ্চিম তীরের প্রায় পুরোটাই ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীদের দখলে চলে গেছে। কয়েক দিন আগেও নেতানিয়াহু জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ অধিবেশনে বলে এসেছেন, ইসরায়েলের নেতৃত্বে তিনি নতুন মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্র তৈরি করবেন। তাঁর সেই মানচিত্রে তিনি গাজার অস্তিত্ব রাখেননি। এখন ইসরায়েল বলছে, গাজাকে গিলে ফেলবে। তারা গেলা শুরু করেও দিয়েছে। আর বরাবরের মতো চুপ করে আছে বিশ্ববিবেক। পিঠ ঠেকে যাওয়া ফিলিস্তিনিরা এখন কী করবে?
‘দুনিয়া ঘনিয়ে আসছে আমাদের দিকে/ ধরিত্রী ঠেসে ধরছে একেবারে শেষ কোনাটায়.... / শেষ প্রান্তে ঠেকে গেলে যাবটা কোথায়?/ শেষ আসমানে ঠেকে গেলে পাখিগুলো উড়বে কোথায়?/ হয়ার শুড দ্য বার্ডস ফ্লাই আফটার দ্য লাস্ট স্কাই?’
ফিলিস্তিনিদের ক্রমেই কোণঠাসা হতে থাকা জীবনের অসহায়ত্ব নিয়ে লেখা এই কথাগুলো ফিলিস্তিনের চিরনির্বাসিত জাতীয় কবি মাহমুদ দারবিশের এই ‘দ্য আর্থ ইজ ক্লোজিং অন আস’ থেকে নেওয়া।
কবিতাটির ‘আফটার দ্য লাস্ট স্কাই’ বা ‘শেষ আসমানের পর’ কথাটি নিয়ে এডওয়ার্ড সাঈদ লিখেছিলেন ফিলিস্তিনি জীবনবিষয়ক বই আফটার দ্য লাস্ট স্কাই। সেখানে সাঈদ বলেছিলেন, ‘শেষ আসমানের পর আর কোনো আসমান নাই। শেষ ভূখণ্ডের পর আর কোনো ভূখণ্ড নাই। তাই ফিলিস্তিনিদের আমৃত্যু লড়াই ছাড়া আর কোনো পথও খোলা নাই।’ সেই বাস্তবতা এখন আরও বাস্তব হয়ে উঠেছে।
সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক
sarfuddin 2003 @gmail.com