বেইলি রোডের বহুতল ভবনে আগুন জ্বলছে
বেইলি রোডের বহুতল ভবনে আগুন জ্বলছে

মতামত

বেইলি রোড: অগ্নিকাণ্ডের কাঠামোগত ভিত্তি যেভাবে বহাল থাকে

বেইলি রোডে সাম্প্রতিক অগ্নিকাণ্ডের আগেও দেশে একাধিক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। একই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হওয়ায় প্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহির অভাব স্পষ্ট। এর ফলে প্রশ্ন উঠেছে, এগুলো কি দুর্ঘটনা, না সামগ্রিক গাফিলতির ফলাফল? এসব ঘটনায় নিহত ব্যক্তিরা কি কাঠামোগত হত্যাকাণ্ডের শিকার? এই লেখায় এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন কল্লোল মোস্তফা

বেইলি রোডের একটি বহুতল ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৪৬ জনের মৃত্যুর পর বহু ধরনের অনিয়ম ও গাফিলতির তথ্য উন্মোচিত হচ্ছে। রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) বলছে, গ্রিন কোজি কটেজ নামের আটতলা ভবনটিতে রেস্তোরাঁ ব্যবসার অনুমোদন ছিল না। এক থেকে সাততলা পর্যন্ত অফিসকক্ষ এবং আটতলায় আবাসিক স্থাপনার অনুমোদন ছিল। (প্রথম আলো, ১ মার্চ, ২০২৪)

অন্যদিকে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স জানিয়েছে, ভবনটিতে কোনো অগ্নিনিরাপত্তার ব্যবস্থাই ছিল না। ঝুঁকিপূর্ণ জানিয়ে মালিকপক্ষকে তিনবার চিঠি দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু তারা কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। (প্রথম আলো, ১ মার্চ ২০২৪)। 

রেস্তোরাঁ ব্যবসার অনুমোদন না থাকার পরও অগ্নিনিরাপত্তাহীন এই ভবনে আটটি রেস্তোরাঁ চলছিল বছরের পর বছর ধরে। যার খেসারত হিসেবে অগ্নিকাণ্ডে এত মানুষের অকালমৃত্যু হলো।

কোনো ভবনে ফায়ার অ্যালার্ম বা অগ্নিসতর্কসংকেতের ব্যবস্থা থাকলে এবং ভবন থেকে বের হওয়ার জন্য ফায়ার এক্সিট বা বাইরের দিকে মুখ করা সিঁড়ি থাকলে আগুন লাগলেও সাধারণত মানুষের মৃত্যু হওয়ার কোনো কারণ থাকে না। ফায়ার অ্যালার্ম শুনে মানুষ নিরাপদে ফায়ার এক্সিট ব্যবহার করে বের হয়ে যেতে পারেন। কিন্তু রাজধানীর বেইলি রোডের এই বহুতল ভবনে ফায়ার অ্যালার্ম সিস্টেম ছিল না বা থাকলেও কাজ করেনি। সেই সঙ্গে বাইরের দিকে মুখ করা কোনো সিঁড়িও ছিল না। 

এ রকম অবস্থায় প্রিয়জনকে সঙ্গে নিয়ে বিভিন্ন রেস্তোরাঁয় খেতে বসা মানুষগুলোর পক্ষে আগুন লাগার খবর সময়মতো জানা সম্ভব হয়নি। ধোঁয়া ও আগুন দেখে যখন তাঁরা ব্যাপারটি বুঝতে পারলেন, তাঁদের বেশির ভাগই আর বের হতে পারেননি। কারণ, গ্যাসের সিলিন্ডার দিয়ে ঠাসা একমাত্র সিঁড়ি ততক্ষণে ধোঁয়া ও আগুনে পূর্ণ হয়ে গেছে।

■ প্রতিটি ক্ষেত্রেই ঘাটতি ও গাফিলতিগুলোর কথা জানা যায় দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর। ■ ভবনের নির্মাতা, ফ্লোরের মালিক, রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ী, রাজউক, ফায়ার সার্ভিস ও সিটি করপোরেশন—কেউই দায় এড়াতে পারে না।  ■ তদারককারী সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিদের জবাবদিহি ও শাস্তির মুখোমুখি হওয়ার ঘটনা বিরল।

কোনো ধরনের অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা ছাড়াই ভবনটিতে বছরের পর বছর রেস্তোরাঁ চালানো হলেও ভবনের ডেভেলপার, রাজউক, ফায়ার সার্ভিস, সিটি করপোরেশন—কেউই এই অনিয়মের দায় নিচ্ছে না। ভবনটির নির্মাতাপ্রতিষ্ঠান আমিন মোহাম্মদ গ্রুপ বলছে, তারা ডেভেলপার হিসেবে ভবনটি নির্মাণ করে ২০১৫ সালে। এরপর নিয়মানুযায়ী জমির মালিক ও ফ্ল্যাটের ক্রেতাদের রেজিস্ট্রেশন করে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন নাকি ওই ভবনের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। এদিকে রাজউক বলছে, তাদের দায়িত্ব নাকি কেবল ভবন নির্মাণের সময়। নির্মাণের পর ভবন হস্তান্তর হয়ে যাওয়ার পর তাদের কোনো দায়িত্ব নেই। (আগুন-বিস্ফোরণ: ‘সরকারি কর্মকর্তারা কোথায়?’, বিডিনিউজ২৪ ডটকম, ৩ মার্চ ২০২৪)

ফায়ার সার্ভিস বলছে, অগ্নিপ্রতিরোধ ও নির্বাপণ আইনে (২০০৩) তাদের মামলা করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এই আইনের বিধিমালা স্থগিত থাকার কারণে চিঠি দেওয়া ছাড়া তাদের করার কিছু থাকে না। ব্যবস্থা নিতে সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে চিঠির অনুলিপি দেওয়া হয়, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা তারা নিতে পারে। আর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন বলছে, ট্রেড লাইসেন্স দেওয়ার সময় তারা এসব দেখে না। তারা চুক্তিপত্র ও সাধারণ কয়েকটি বিষয় দেখে ব্যবসার অনুমতি প্রদান করে। (প্রথম আলো, ৩ মার্চ ২০২৪) 

অবস্থাদৃষ্টে স্পষ্ট যে, ভবনটির নির্মাতাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে সরকারি তদারকি সংস্থাগুলো দায়িত্ব এড়াতে চাইছে। এতে করে রেস্তোরাঁটিতে খেতে গিয়ে আগুনে পুড়ে মারা যাওয়া মানুষ ছাড়া আর কাউকেই কি ‘দোষী’ বলা যাবে? প্রকৃতপক্ষে ভবনটির নির্মাতা আমিন মোহাম্মদ গ্রুপ, ভবনটির বিভিন্ন ফ্লোরের মালিক, রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ী, রাজউক, ফায়ার সার্ভিস ও সিটি করপোরেশন—কেউই দায় এড়াতে পারে না। 

নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান দায়ী। কারণ, তারা একই সঙ্গে আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবন বানিয়েছে মাত্র একটি সিঁড়ি রেখে এবং কোনো ধরনের ফায়ার এক্সিটের ব্যবস্থা না রেখে। তারা যদি দাবি করে, শুরুতে এটি কেবল আবাসিক ভবন ছিল, ফ্লোর মালিকেরা পরে একে বাণিজ্যিক ভবনে রূপান্তর করেছেন, তাতেও দায়মুক্তি মিলবে না। কারণ, ভবনের ফ্লোরগুলো বিভিন্নজনের কাছে বিক্রি করে দিলেও ভবনটির ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ছিল নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানেরই একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান আমিন মোহাম্মদ প্রোপার্টি ম্যানেজমেন্ট সার্ভিসেস (এএমপিএম)। এই প্রতিষ্ঠানই ভবনটির সিকিউরিটি, সেফটি, গার্ডস ও লিফট ম্যানেজমেন্টের দায়িত্ব পালন করে আসছিল। (ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ছিল ‘এএমপিএম’, পলাতক কর্মকর্তারা, বাংলা ট্রিবিউন, ৩ মার্চ ২০২৪)।

ভবনটির বিভিন্ন ফ্লোর মালিকেরা দায়ী। কারণ, তাঁরা রাজউকের কাছ থেকে অফিস হিসেবে ব্যবহারের অনুমোদন নিয়ে ভবনের প্রতিটি ফ্লোরে রেস্তোরাঁ ভাড়া দিয়েছেন। কারণ, রেস্তোরাঁর উপযোগী কাঠামো না থাকা সত্ত্বেও ভবনটিতে তাঁরা রেস্তোরাঁ ব্যবসা করেছেন। ভবনটির সিঁড়িসহ যেখানে-সেখানে গ্যাস সিলিন্ডার রেখে বাড়তি ঝুঁকি তৈরি করেছেন। তাঁরা কর্মচারী ও ক্রেতাদের নিরাপত্তার বিষয়ে গুরুতর অবহেলা করেছেন।

রাজউকের কর্মকর্তারা দায়ী। কারণ, আবাসিক হিসেবে নির্মিত একটি ভবনকে তাঁরা অফিস হিসেবে ব্যবহারের অনুমোদন দিয়েছেন। কিন্তু অফিস হিসেবে ব্যবহার করতে হলে যে ফায়ার এক্সিটসহ একাধিক সিঁড়ির ব্যবস্থা থাকতে হয়, সেটি তাঁরা নিশ্চিত করেননি। শুধু তা-ই নয়, অফিস হিসেবে অনুমোদন দেওয়ার পর সেটি আসলেই অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে কি না, সে বিষয়টি তাঁরা তদারক করেননি। পুলিশের মামলাতেও বলা হয়েছে, ‘আসামিগণ ও অন্যান্য রেস্টুরেন্টের মালিক/ ম্যানেজারগণ যথাযথ নিয়ম ব্যতিরেকে রাজউকের দোকান পরিদর্শক অফিসারদের ম্যানেজ করে অবৈধভাবে রেস্টুরেন্ট স্থাপন করে গ্যাসের চুলা ও সিলিন্ডার ব্যবহার করে ব্যবসা পরিচালনা করে আসছে।’ রাজউকের দোকান পরিদর্শক কর্মকর্তারা এই ‘ম্যানেজ’ হওয়ার দায় এড়াতে পারেন না।

ফায়ার সার্ভিসের দায় হলো, প্রতিষ্ঠানটি কেবল ভবনটিকে ঝুঁকিপূর্ণ বলে মালিকদের চিঠি দিয়েই দায় সেরেছে। অগ্নিপ্রতিরোধ ও নির্বাপণ আইনে (২০০৩)-এর ধারা ৮(৪) অনুযায়ী ভবনটিকে ব্যবহারের অনুপযোগী ঘোষণা করেনি। অথচ ভবনটিকে ঝুঁকিপূর্ণ ও ব্যবহার অনুপযোগী হিসেবে ঘোষণা করে সাইনবোর্ড টানিয়ে দিলে ও ওয়েবসাইটে তালিকা প্রকাশ করলে একদিকে সাধারণ মানুষ ঝুঁকি সম্পর্কে জানতে পারতেন, অন্যদিকে প্রয়োজনীয় সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়ার ব্যাপারে ভবনটির মালিকদের ওপরও চাপ পড়ত। 

সিটি করপোরেশনের দায় হলো, প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা রেস্তোরাঁগুলোকে ট্রেড লাইসেন্স দিয়েছেন। বছর-বছর তাদের কাছ থেকে রেস্তোরাঁ বা কমার্শিয়াল স্পেসের জন্য কর আদায় করেছেন। কিন্তু ভবনটি রেস্তোরাঁ ব্যবসার জন্য উপযুক্ত কি না, ভবনটিতে যথাযথ অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা আছে কি না ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো বিবেচনা করেননি।

বাংলাদেশে অবশ্য অগ্নিকাণ্ডে মানুষের মৃত্যু নতুন কোনো বিষয় নয়। দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর সংশ্লিষ্ট স্থাপনাটির মালিকপক্ষ থেকে শুরু করে সরকারের বিভিন্ন তদারকি সংস্থার অবহেলা ও গাফিলতির ঘটনা উন্মোচিত হওয়াও নতুন কিছু নয়। নিমতলী (জুন ২০১০), তাজরীন (নভেম্বর ২০১২), টাম্পাকো (সেপ্টেম্বর ২০১৬), চুড়িহাট্টা (ফেব্রুয়ারি ২০১৯), এফআর টাওয়ার (মার্চ ২০১৯), হাশেম ফুডস (জুলাই ২০২১) ইত্যাদি সব ঘটনাতেই কয়েকটি সাধারণ প্রবণতা দেখা গেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সংশ্লিষ্ট স্থাপনাটিতে যথাযথ অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা না থাকা, ভবন বা কারখানা পরিচালনার ক্ষেত্রে অগ্নিনিরাপত্তায় অবহেলা এবং সংশ্লিষ্ট তদারকি সংস্থাগুলোর গাফিলতি।

প্রতিটি ক্ষেত্রেই এই ঘাটতি ও গাফিলতিগুলোর কথা জানা যায় দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর। প্রতিটি ক্ষেত্রেই তদন্ত কমিটির রিপোর্টে সমস্যাগুলো সমাধানে যেসব সুপারিশ করা হয়, সেগুলো বাস্তবায়ন করা হয় না এবং এর জন্য দায়ী ব্যক্তিদের কোনো বিচার বা শাস্তি হয় না। ফলে খুব সাধারণ ও প্রতিরোধযোগ্য কতগুলো কারণে অগ্নিকাণ্ডে নিয়মিতই মানুষের মৃত্যু ঘটতেই থাকে।

আভিধানিক সংজ্ঞা অনুসারে দুর্ঘটনা হলো একটি অদৃষ্টপূর্ব, অকল্পনীয় ও আকস্মিক ঘটনা। কিন্তু নির্দিষ্ট কিছু ঘটনা যখন একই রকম কারণে বারবার ঘটতে থাকে, যেসব কারণ ব্যবস্থা বা কাঠামোর সঙ্গে সংযুক্ত, তখন সেগুলো আর আকস্মিক বা অদৃষ্টপূর্ব থাকে না। ফলে সেগুলো আর সাধারণ দুর্ঘটনা থাকে না, হয়ে ওঠে ব্যবস্থাপনাগত বা কাঠামোগত বিষয়। তাই এই প্রশ্ন সামনে এসেছে, বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ ভবনে অগ্নিকাণ্ডে ৪৬ জন নিহত হওয়ার ঘটনাটি নিছক দুর্ঘটনা, নাকি কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড? এটা খতিয়ে দেখার জন্য রাজধানী ঢাকার বনানীর একটি বাণিজ্যিক ভবনে ২০১৯ সালে ঘটা একই ধরনের একটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ও তার পরবর্তী তৎপরতাকে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে।

২০১৯ সালের ২৮ মার্চ রাজধানীর বনানীর এফআর টাওয়ার নামের একটি বাণিজ্যিক ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ২৭ জনের মৃত্যু হয়। এ ঘটনার পর গঠিত একাধিক তদন্ত কমিটির রিপোর্ট ও পুলিশের করা মামলায় অগ্নিকাণ্ডে মানুষের মৃত্যুর জন্য কিছু কারণের কথা বলা হয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো নকশা জালিয়াতি করে অবৈধভাবে ভবনের ১৯ থেকে ২৩তম তলা নির্মাণ, ফায়ার অ্যালার্ম না থাকা, ফায়ার এক্সিট সিঁড়িতে প্রতিবন্ধকতা থাকায় জরুরি নির্গমন পথে বাধা সৃষ্টি, ফায়ার এক্সিট দরজার সামনে রুম করে ভাড়া দেওয়া, ভবনের দুটি সিঁড়ির একটি সার্বক্ষণিক বন্ধ করে রাখা, ভবনে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র, হোস পাইপসহ বিভিন্ন সরঞ্জামের মেয়াদ না থাকা, ভবনে কোনো প্রকার ভেন্টিলেশন ব্যবস্থা না থাকা ইত্যাদি। (এফআর টাওয়ার: কার কী ‘দোষ’, বাংলা ট্রিবিউন, ২৮ জুন ২০১৯; এফআর টাওয়ারে নকশা জালিয়াতি, পাঁচজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র, প্রথম আলো, ২৯ অক্টোবর ২০১৯; দুই পক্ষের দ্বন্দ্বের জেরে ভবনে অব্যবস্থাপনা, ৮ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র, প্রথম আলো, ১৪ মার্চ)

গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের তদন্ত রিপোর্টে এফআর টাওয়ারের এসব জালিয়াতি ও অনিয়মের জন্য রাজউক ও মালিকপক্ষের মোট ৬২ জনকে দোষী হিসেবে সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। কিন্তু চার বছর পার করে ২০২৩ সালের মার্চে মাত্র আটজনকে আসামি করে মামলার অভিযোগ গঠন করা হয়। (দুই পক্ষের দ্বন্দ্বের জেরে ভবনে অব্যবস্থাপনা, প্রথম আলো, ১৪ মার্চ ২০২৩) 

এ বিষয়ে বেইলি রোডের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর সাবেক গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, ‘দুর্ভাগ্য, সর্বোচ্চ পর্যায়ের একটি কমিটি রিপোর্ট দেওয়ার পরও সবার বিরুদ্ধে মামলা হয়নি। তারপর চার্জশিট দেওয়ার সময় অনেককে বাদ দেওয়া হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা সে সময় ১ হাজার ৩০০ ভবনকে চিহ্নিত করেছিলাম গণপূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে, যে ভবনের প্ল্যান ঠিক নেই, যে ভবনের অধিকাংশ ফ্লোর অননুমোদিতভাবে করা হয়েছে, সে ভবনগুলো কিন্তু ভাঙা সম্ভব হয়নি। এটাও কিন্তু একপ্রকার দায়মুক্তি দেওয়া।’(অননুমোদিত ভবন চিহ্নিত করা হলেও ভাঙা সম্ভব হয়নি, প্রথম আলো, ২ মার্চ ২০২৪)

লক্ষণীয় হলো, যেসব কারণে এফআর টাওয়ার অগ্নিকাণ্ডে প্রাণহানি ঘটেছিল, ঠিক একই ধরনের কারণের কথা উঠে আসছে বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ ভবনের ঘটনার বেলায়। এফআর টাওয়ারের ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে যদি অন্যান্য বাণিজ্যিক ভবনগুলোর সংস্কার করা হতো, যদি দায়ী ব্যক্তিদের বিচার করে কঠোর শাস্তি দেওয়া হতো, তাহলে কি একইরকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটত?

শুধু এফআর টাওয়ারের ঘটনাই নয়, বাংলাদেশে দুর্ঘটনার জন্য কোনো কারখানা বা ভবন বা কোনো প্রতিষ্ঠানের মালিক ও ব্যবস্থাপক থেকে শুরু করে অনুমোদন ও তদারককারী সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিদের জবাবদিহি ও শাস্তির মুখোমুখি হওয়ার ঘটনা বিরল। বিশ্বের অনেক দেশেই সংশ্লিষ্ট নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষকে রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছে এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বকে প্রতিটি দুর্ঘটনার জন্য জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে হয়। এসব দেশে দুর্ঘটনা ও দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার অনেক কম। বাংলাদেশে এমন কোনো জবাবদিহিমূলক প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে ওঠেনি বলেই দুর্ঘটনার কাঠামোগত ভিত্তিগুলো দিনের পর দিন অক্ষুণ্ন রয়েছে।

 কল্লোল মোস্তফা লেখক-গবেষক