রিমান্ড শুনানির পর রাউস অ্যাভিনিউতে সিবিআই বিশেষ আদালতে অরবিন্দ কেজরিওয়াল। ২২ মার্চ
রিমান্ড শুনানির পর রাউস অ্যাভিনিউতে সিবিআই বিশেষ আদালতে অরবিন্দ কেজরিওয়াল। ২২ মার্চ

কেজরিওয়ালের গ্রেপ্তার কি মোদিবিরোধী জোটকে শক্তিশালী করবে

দ্য ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস ও আম আদমি পার্টি (এএপি) রাজনীতিতে পরস্পরের বিরোধী। তবে ক্রনি ক্যাপিটালিজমের (স্বজনতোষী পুঁজিবাদী ব্যবস্থা) বিরুদ্ধে ২৭–দলীয় জোটে এ দুই দলই সবচেয়ে উচ্চকণ্ঠ। স্বজনতোষী পুঁজিবাদী ব্যবস্থা বলতে যে চক্রের কথা বলা হচ্ছে, সে চক্রে আছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও ধনকুবের গোষ্ঠী; বিশেষত আম্বানি ও আদানিরা।

দিল্লি, পাঞ্জাব, গোয়া, এমনকি মোদির নিজের রাজ্য গুজরাটেও এএপি হুমকি হয়ে উঠেছিল। সে কারণে গত বৃহস্পতিবার সরকারি বাসভবন থেকে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালের গ্রেপ্তার প্রতিহিংসাবশত—এমন আলোচনা আছে।  

তবে আমি মনে করি, কেজরিওয়ালকে গ্রেপ্তারের কারণে ভারতের বিরোধী দলগুলো আরও একতাবদ্ধ হওয়ার সুযোগ পেল। এর আগে মোদির বিরুদ্ধে তাদের অনেকটাই দ্বিধাবিভক্ত মনে হচ্ছিল। বিভিন্ন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠানে বহুমূল্য পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে এবং সংবাদমাধ্যমকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে এনে মোদি যে শক্ত অবস্থানে ধরে রেখেছেন, তাতে বিরোধী দলের পক্ষে হালে পানি পাওয়া কঠিন।  

দুর্নীতির অভিযোগে কেজরিওয়ালকে দেশটির অর্থনৈতিক অপরাধবিষয়ক এজেন্সি গ্রেপ্তারের পর গত শুক্রবার আদালত তাঁকে রিমান্ডে পাঠাতে বলেছেন।

বলা হচ্ছে, ইলেকটোরাল বন্ড নিয়ে যে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে, তা থেকে দৃষ্টি সরাতেও মোদি সরকার এ কাণ্ড ঘটিয়ে থাকতে পারে। ভারতের শীর্ষ আদালত সম্প্রতি ইলেকটোরাল বন্ড–সম্পর্কিত তথ্য প্রকাশের নির্দেশ দিয়েছেন। এ বন্ড থেকে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)। (উল্লেখ্য, মোদি সরকার এই বন্ডের উদ্ভাবক। এ ব্যবস্থায় ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বন্ড কিনে নামপরিচয় গোপন রেখে রাজনৈতিক দলগুলোকে দান করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে)।

শুক্রবার বিকেলে কেজরিওয়ালকে দিল্লির আদালতে তোলা হয়।

কেজরিওয়ালকে গ্রেপ্তারের পর তাঁর আইনজীবী শাদান ফারাসাত এএফপি নিউজ এজেন্সিকে বলেন, ‘আমরা আমাদের পরবর্তী কার্যক্রম কী হবে, তা ভাবছি।’

এদিকে রাজধানীতে আম আদমি পার্টির আরও কয়েক ডজন কর্মীকে আটক করা হয়। জাতীয় নির্বাচনের কয়েক সপ্তাহ আগে এই ধরপাকড়ের বিরুদ্ধে ভারতের বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভ হয়েছে। এএপির নেতারা বলেছেন, তাঁরা আন্দোলন–সংগ্রাম চালিয়ে যাবেন। এর মধ্যে একটি বিক্ষোভ সমাবেশ নরেন্দ্র মোদির বাসভবনের বাইরে হওয়ার কথা রয়েছে।

এএপি নেতা ও দিল্লির অর্থমন্ত্রী অতিশি সিং এক বিবৃতিতে বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচনের প্রচারণা থেকে দূরে রাখতেই কেজরিওয়ালকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ভোট চুরির কায়দা এটা।’

রাহুল গান্ধী নিজেও বিজেপির এক সদস্যের দায়ের করা মানহানি মামলায় দোষী প্রমাণিত হন। আদালত তাঁকে দুই বছরের কারাদণ্ড দেন। ফলে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়। পরে অবশ্য গত বছরের আগস্টে উচ্চ আদালত রাহুলের দণ্ডাদেশ স্থগিত করেন।

দিল্লির একটি মদ–সম্পর্কিত নীতিকে কেন্দ্র করে দুর্নীতির অভিযোগে কেজরিওয়ালকে গ্রেপ্তার করা হয়। কেজরিওয়াল এএপির তৃতীয় নেতা, যাঁকে এই অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হলো। এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরের কেজরিওয়াল ছাড়াও উপপ্রধানমন্ত্রী মণীশ সিসোডিয়া ও এএপির সংসদ সদস্য সঞ্জয় সিংকে গত বছর গ্রেপ্তার করে।

২০১৩ সালে দিল্লিতে ক্ষমতা নেওয়ার পর ২০২২ সালে এএপি পাঞ্জাবের নির্বাচনে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক আসন পায়। ওই একই বছর মোদির রাজ্য গুজরাটেও কিছু আসন তারা জিতে নিয়েছিল।

এদিকে মোদিকে উদ্দেশ্য করে রাহুল গান্ধী তাঁর এক্স হ্যান্ডেলে লিখেছেন, একজন ভীত স্বৈরাচার একটি নিষ্ক্রিয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চান। নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী গ্রেপ্তার এখন ডালভাত হয়ে গেছে। কেজরিওয়ালের গ্রেপ্তার ভারতের গণতন্ত্রের ওপর আঘাত বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

ন্যাশনালিস্ট কংগ্রেস পার্টির (সরোদচন্দ্র পাওয়ার) নেতা সরোদ পাওয়ার বলেন, ক্ষমতার জন্য বিজেপি কোথায় নামতে পারে, তা-ই পরিষ্কার হলো এই গ্রেপ্তারে।

বিবিসি সমাজবাদী পার্টির প্রধান অখিলেশ যাদবকে উদ্ধৃত করে বলেছে, কেজরিওয়ালের গ্রেপ্তার নতুন করে আন্দোলনে যুক্ত হতে অনেককে উৎসাহিত করবে। বিজেপি জানে, তারা আর ক্ষমতায় আসছে না। এই ভয় থেকে তারা বিরোধীদলীয় নেতাকে নির্বাচনের সময় জনগণের মধ্য থেকে সরিয়ে দিল। গ্রেপ্তার একটা অজুহাত ছাড়া আর কিছু নয়।

কেরালার মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন বলেন, কেজরিওয়ালের গ্রেপ্তার জাতীয় নির্বাচনের আগে বিরোধী দলকে থামিয়ে দিতে নেওয়া ষড়যন্ত্রের অংশ।

তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী এম কে স্ট্যালিন বলেন, ‘বিজেপির কোনো নেতাকে কোনো জবাবদিহি বা গ্রেপ্তারের মুখোমুখি হতে হয়নি। এতে প্রমাণ হয়ে যায় যে ক্ষমতার অপব্যবহার হচ্ছে, গণতন্ত্রও ক্ষয়ে যাচ্ছে। ধারাবাহিকভাবে বিরোধীদলীয় নেতাদের গ্রেপ্তারে পরিষ্কার হয়ে গেছে যে সরকার বেপরোয়া ও বেছে বেছে বিরোধীদলীয় লোকজনকেই নিশানা করছে। এই মাস্তানি জনমনে ক্ষোভের সঞ্চার করেছে এবং বিজেপির প্রকৃত চরিত্র কী, তা প্রকাশ করে দিয়েছে।

বিগত বছরগুলোয় বিরোধীদলীয় আরও অনেক নেতাকে কারারুদ্ধ করে জেরা করা হয়েছে বা রাষ্ট্রীয় সংস্থা তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে।

ভারত রাষ্ট্র সমিতির (বিআরএস) নেতা কে কবিতাকে কেজরিওয়ালকে যে মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে, সেই একই মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি অভিযোগ অস্বীকার করেন। গত জানুয়ারিতে ঝাড়খন্ডের মুখ্যমন্ত্রী ও ঝাড়খন্ড মুক্তি মোর্চার নেতা হেমন্ত সরেনকে রাষ্ট্রীয় কর সংস্থা অর্থ পাচার ও জমি দখলের অভিযোগে গ্রেপ্তার করে। সোরেনও অভিযোগ অস্বীকার করেন।

রাহুল গান্ধী নিজেও বিজেপির এক সদস্যের দায়ের করা মানহানি মামলায় দোষী প্রমাণিত হন। আদালত তাঁকে দুই বছরের কারাদণ্ড দেন। ফলে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়। পরে অবশ্য গত বছরের আগস্টে উচ্চ আদালত রাহুলের দণ্ডাদেশ স্থগিত করেন।

পাকিস্তানের ডনে প্রকাশিত ও বাংলায় অনূদিত।

  • জাভেদ নাকভি একজন সাংবাদিক ও কলাম লেখক।