মতামত

জলবায়ু সম্মেলনের খাদ্য ও কৃষিবিষয়ক ঘোষণা কতটা কৃষক আর কৃষিবান্ধব

দুবাইয়ে অনুষ্ঠিত জলবায়ু সম্মেলন ২০২৩–এ (কপ-২৮) টেকসই কৃষি, খাদ্য ও জলবায়ুসংক্রান্ত একটি ঘোষণা তৈরি হয়েছে
ছবি: এএফপি

ক্রমবর্ধমান জলবায়ু পরিবর্তন এবং তার নেতিবাচক প্রভাবে খাদ্য ও কৃষিব্যবস্থা হুমকির মধ্যে পড়ছে। বিপদাপন্ন মানুষের আর্থিক সামর্থ্য কমছে এবং তাদের বাজারে প্রবেশাধিকার কঠিন হয়ে উঠছে। ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার মানুষেরা ক্ষুধা ও অপুষ্টিতে ভুগছে এবং তাদের বিপন্নতার মাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ার লাখ লাখ শিশুর ভবিষ্যৎও ক্রমেই ঝুঁকিতে পড়ছে। আরও খারাপ দিক হলো, তারা একটি বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠার আগেই আরেকটি বিপর্যয়ের শিকার হচ্ছে, যা যেকোনো অগ্রগতিকে পেছনের দিকে নিয়ে যায়।

দুবাইয়ে অনুষ্ঠিত জলবায়ু সম্মেলন ২০২৩–এ (কপ-২৮) বিষয়টি মাথায় রেখে টেকসই কৃষি, খাদ্য ও জলবায়ুসংক্রান্ত একটি ঘোষণা তৈরি হয়েছে।

আশা করা হচ্ছে, এর মধ্য দিয়ে একটি শক্তিশালী ও উদ্ভাবনমূলক কৃষি ও খাদ্যব্যবস্থার দ্বার উন্মোচিত হবে। এখানে যে বেশ কিছু ইতিবাচক বিষয়ের অবতারণা ঘটেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

এ ঘোষণায় জাতীয় খাদ্যনিরাপত্তার পাশাপাশি সবার জন্য নিরাপদ, পর্যাপ্ত, সাশ্রয়ী ও পুষ্টিকর খাদ্যে প্রবেশাধিকারের বিষয়টি গুরুত্বসহকারে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে এবং তা কৃষিশ্রমিক, ক্ষুদ্র ও পারিবারিক কৃষক, মৎস্যজীবীসহ বিভিন্ন পর্যায়ের উৎপাদকের জীবন ও জীবিকার মৌলিক বিষয়গুলোর ওপর আলোকপাত করা হয়েছে।

কিন্তু কোভিড-১৯-এর অভিজ্ঞতা এবং বর্তমানে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে কৃষি খাতে যে সংকট ও সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, সে বিষয় এ ঘোষণায় অনুপস্থিত থেকে গেছে। অনুপস্থিত থেকে গেছে বীজের মালিকানাসংক্রান্ত আলোচনা, যা খুবই জরুরি ছিল। কারণ, কৃষিতে বীজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।


বীজের সঙ্গেই কৃষির স্থায়িত্বশীলতা, ন্যায্যতা ও কৃষকের অধিকারের প্রশ্ন জড়িত। বীজের সঙ্গেই নিরাপদ, পর্যাপ্ত, সাশ্রয়ী ও পুষ্টিকর খাবারে প্রবেশাধিকারের সম্পর্ক নিহিত। কিন্তু বীজের অধিকার নিয়ে এ ঘোষণায় তেমন কিছু উল্লেখ করা হয়নি। এ কারণে কপ-২৮-এর খাদ্য ও কৃষিবিষয়ক ঘোষণায় গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয়ে অস্পষ্টতা থেকে গেছে।

প্রথমত, বীজের অধিকার যদি কৃষকের কাছে থাকে, তাহলে তিনি তাঁর বীজ প্রয়োজনমতো ব্যবহার করতে পারেন। আর কোম্পানির কাছে থাকলে তাঁকে বীজ কিনে ব্যবহার করতে হয়। এতে কৃষককে কোম্পানির ওপর নির্ভরশীল হতে হয়। তাই বীজের মালিকানা কৃষকের কাছে থাকাই জরুরি। তাতে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায় কার্যকর ভূমিকা পালনে অধিক সক্ষমতা দেখানো সম্ভব হবে। কারণ, আবহাওয়ার ধরন, পরিবর্তন, চরম আবহাওয়ার ক্রমবর্ধমান ঘনত্বের সঙ্গে সংগতি রেখে কৃষকই তাঁর ফসল বোনা, কাটা ও মাড়াইয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন এবং তাঁরাই এ ধরনের পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করেন। তাঁরাই অঞ্চলভেদে বালাই দমনে নিজস্ব ব্যবস্থাপনাও দাঁড় করিয়ে থাকেন। অন্যদের উচিত তাঁদের উৎসাহ দেওয়া এবং তাঁদের উদ্ভাবনগুলোকে সহায়তা করা।

এসব বিষয় যদি কোম্পানির হাতে থাকে, তাহলে কোম্পানি লাভের আশায় অতিমাত্রায় রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারের দিকেই নিয়ে যাবে। ফলে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার যেমন অব্যাহত থাকবে, কোম্পানিগুলোর একচেটিয়া দৌরাত্ম্যও অব্যাহত থাকবে।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মাধ্যমে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের অপর্যাপ্ততায় কৃষককে যে দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে, তা আমরা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। শুধু বাংলাদেশেই দেখা গেছে, গত কয়েক বছর সারের ভর্তুকি ছিল চার হাজার কোটি টাকা। সেখানে ২০২২-২৩ অর্থবছরে খরচ করতে হয়েছে ১৬ হাজার কোটি টাকা (বাংলাদেশ ইকোনমিক রিভিউ ২০২৩)।

এ সম্মেলনে সেই দুর্ভোগ থেকে বের হওয়ার জন্য প্রকৃতিগত সমাধানের কোনো নির্দেশনা নেই। আমাদের কৃষকসমাজ ইতিমধ্যে প্রকৃতিগত সমাধানের ক্ষেত্রে সফলতা দেখাতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু কপ-২৮ সম্মেলনের ঘোষণায় সেসব ক্ষেত্র সম্পৃক্ত করা হয়নি এবং সে ক্ষেত্রে অদূরদর্শিতার পরিচয় দেওয়া হয়েছে। এ কারণে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষক, যাঁরা খাদ্যনিরাপত্তায় সর্বাপেক্ষা ভূমিকা রাখেন, তাঁরাও এ ঘোষণার সুফল থেকে বঞ্চিত হবেন। বঞ্চিত হবেন দক্ষিণ এশিয়ার কৃষিকে যাঁরা বাঁচিয়ে রেখেছেন, সেসব কিষানিও।

মানুষের অপরিণামদর্শী কার্যকলাপে প্রকৃতিতে যে বিরূপ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল, করোনাকালে সেখানে মানুষের কম হস্তক্ষেপে আমরা একটা ইতিবাচক অবস্থা লক্ষ করেছি। আইএমএফের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২০ সালে বাতাসে কার্বন নিঃসরণের মাত্রা সামগ্রিকভাবে ৪ দশমিক ৬ শতাংশ হ্রাস পায়। এতে মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর ক্রমান্বয়ে প্রকৃতির সঙ্গে সহাবস্থানের একটা পরিবেশ তৈরি হচ্ছিল। কিন্তু মানুষের অতিরিক্ত লাভ ও লোভের প্রবণতায় সে ধারাবাহিকতা ধরে রাখা সম্ভব হয়নি।

মানুষ খুব দ্রুত সবকিছু হাতের মুঠোয় পেতে চায়। একইভাবে রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সমগ্র বিশ্বের কৃষি খাত যখন সার ও কীটনাশকের সংকটে বিপন্ন, তখন তা থেকে উত্তরণে কৃষককুল প্রাণান্ত পরিশ্রম করে প্রকৃতিগত সমাধানের অনেক ক্ষেত্র পুনরুদ্‌ঘাটন করে। কিন্তু কপ-২৮-এর ঘোষণায় সে বিষয়গুলো টিকিয়ে রাখা বা তার সম্প্রসারণে কোনো দিকনির্দেশনা নেই।

সুতরাং, কৃষি নিয়ে যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে জনস্বাস্থ্য ও প্রাণপ্রকৃতি সুরক্ষার বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ; গুরুত্বপূর্ণ ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক তথা কিষানির স্বার্থ সংরক্ষণের বিষয়টিও। ইতিমধ্যে এ ঘোষণায় ১৩৪টি দেশ স্বাক্ষর করেছে। এ রকম একটি বৈশ্বিক সম্মেলনের মধ্য দিয়ে যে ঘোষণা বেরিয়ে আসবে, সেখানে বিশ্বের প্রতিটি দেশ স্বাক্ষর করবে এবং তা মান্য করবে—সেটাই প্রত্যাশিত।

এখন প্রশ্ন হলো, কৃষিকে আমরা কোন দৃষ্টিতে দেখছি? এটাকে কি আমরা শুধু একশ্রেণির ব্যবসায়ীর মুনাফা সৃষ্টির কারখানা হিসেবে বিবেচনা করছি? এ কারণে প্রতিনিয়ত আমরা এক বাণিজ্যিক কৃষিব্যবস্থার দিকে ঝুঁকে পড়ছি, নাকি কৃষির সঙ্গে আমাদের পরিবেশ-প্রকৃতি, জনস্বাস্থ্য ও জীবচক্রের যে নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে, তা ভুলে যেতে বসেছি? বিষয়টি এখনই গভীরভাবে অনুধাবন করা প্রয়োজন।

যে কৃষিব্যবস্থায় আমরা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি, তাতে অতিমাত্রায় রাসায়নিক সার, কীটনাশক ও পানি ব্যবহার করার প্রয়োজন পড়ছে। এতে বিনষ্ট হচ্ছে জমির স্বাস্থ্য এবং হারিয়ে যাচ্ছে জমির উৎপাদনক্ষমতা। ভূগর্ভস্থ পানির ওপরও চাপ পড়ছে, দূষিত করে ফেলছি ভূ-উপরিস্থ পানি।

জমিতে ব্যবহৃত সার ও কীটনাশক বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে যখন জলাশয়ে পড়ছে, তখন তা ভূ-উপরিস্থ পানিকেও দূষিত করে ফেলছে। এ কারণে সুপেয় পানি পাওয়া এখন দুষ্কর হয়ে পড়েছে। সংকটে পড়ছে প্রাণবৈচিত্র্য, বিপন্ন হচ্ছে জনস্বাস্থ্য। জটিল সব রোগে আক্রান্ত হয়ে মানুষের স্বাস্থ্য খাতের ব্যয় জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

সুতরাং, কৃষি নিয়ে যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে জনস্বাস্থ্য ও প্রাণপ্রকৃতি সুরক্ষার বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ; গুরুত্বপূর্ণ ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক তথা কিষানির স্বার্থ সংরক্ষণের বিষয়টিও। ইতিমধ্যে এ ঘোষণায় ১৩৪টি দেশ স্বাক্ষর করেছে। এ রকম একটি বৈশ্বিক সম্মেলনের মধ্য দিয়ে যে ঘোষণা বেরিয়ে আসবে, সেখানে বিশ্বের প্রতিটি দেশ স্বাক্ষর করবে এবং তা মান্য করবে—সেটাই প্রত্যাশিত।

একইভাবে সব শ্রেণি–পেশার মানুষের খাদ্যনিরাপত্তা, জনস্বাস্থ্য ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার বিষয়টি প্রাধান্য পাবে—সেটাই কাম্য। পাশাপাশি ক্রমবর্ধমান জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলা করেও বাংলাদেশের মতো নিম্নাঞ্চলের মানুষের খাদ্য ও কৃষিব্যবস্থা টিকে থাকবে একটি স্থায়িত্বশীল পন্থায়—সেটাও আমাদের কাম্য। আমাদের প্রত্যাশা, এ-জাতীয় একটি বৈশ্বিক সম্মেলনের ঘোষণা তৈরি হবে সামগ্রিকতার বিচারে, যেখানে প্রান্তে অবস্থিত মানুষগুলোর কথাও বিবেচনায় রাখা হবে।

  • ফারাহ্ কবির কান্ট্রি ডিরেক্টর, একশনএইড বাংলাদেশ