চীনে তরুণদের বিক্ষোভ সি চিন পিংয়ের জন্য হুঁশিয়ারি

চীন সরকারের শূন্য কোভিড নীতি জনগণের কাছে ক্লান্তিকর মনে হচ্ছে
ছবি: রয়টার্স

চীনের শূন্য কোভিড নীতি নিয়ে হতাশা ও ক্ষোভ থেকে দেশটির এক ডজনের বেশি শহরে বিক্ষোভ হয়েছে। ১৯৮৯ সালে দেশটির তিয়েনআনমেন স্কয়ারে যে বিক্ষোভ হয়েছিল, তারপর এত বড় বিক্ষোভ আর হয়নি।

নতুন এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছে তরুণ সম্প্রদায়। তঁাদের এই সামাজিক প্রতিবাদগুলো শুধু কোভিড-১৯ নীতির বিরুদ্ধে নয়, তঁারা দেশের শাসন ও রাজনীতিতেও পরিবর্তনের ডাক দিতে শুরু করেছেন। চীন থেকে বের হতে থাকা এই দৃশ্যপটের প্রধান বার্তা হলো: আমলাতন্ত্রের নীতি বিতর্ককে ক্রমবর্ধমান দমনপীড়নের মাধ্যমে যতই দমিয়ে রাখা হোক না কেন, তা রাতারাতি সামাজিক অস্থিরতার বিস্ফোরণ ঘটাতে পারেন। তবে এই মুহূর্তে চীনে কোভিড–১৯ ভাইরাসের সংক্রমণের মাত্রা বাড়তি থাকা সত্ত্বেও দেশটির ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টি ক্রমবর্ধমান প্রতিবাদের মুখে অনেক শহরে মহামারিসংক্রান্ত বিধিনিষেধ শিথিল করে দিয়েছে।

তবে প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের মূল পরীক্ষাটি সামনে রয়েছে। এখন এই প্রশ্ন উঠছে, চীনের রাজপথে, বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং কারখানাগুলোতে যে ক্ষোভের প্রকাশ দেখা যাচ্ছে, তা থেকে তিনি আসলে কী শিক্ষা নিয়েছেন? 

সংস্কারপন্থী নেতা হু ইয়াওবাংয়ের মৃত্যুর কারণে শুরু হওয়া ১৯৮৯ সালে ছাত্রদের নেতৃত্বে তিয়েনআনমেন স্কয়ারে বিক্ষোভের পর ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট সরকার ওই ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়েছিল। তারা একটি যৌথ নেতৃত্বের মডেল গ্রহণ করেছিল এবং সরকারি নীতি নিয়ে বিতর্কের দিককে আরও উন্মুক্ত করেছিল। ওই ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে জিয়াং জেমিন, হু জিনতাওসহ পরবর্তী চীনা নেতারা দমনের রাজনীতি থেকে দূরে সরে ক্ষমতা ভাগাভাগির মডেলের দিকে গিয়েছিলেন।

দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের বাতাস প্রবাহিত করার এই পদক্ষেপটি বিভিন্ন স্তরে নীতি বিতর্ককে উৎসাহিত করেছিল এবং এটি একটি বিকেন্দ্রীকরণ প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল, যা স্থানীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে কর্মকর্তাদের ক্ষমতায়িত করেছিল।

এখন সরকারের শূন্য কোভিড নীতি জনগণের কাছে ক্লান্তিকর মনে হচ্ছে। এ কারণে দ্রুত চীনা সরকারের লকডাউনের ধারণা থেকে সরে আসা উচিত। তাদের কাছে পরিষ্কার হওয়া উচিত, করোনাভাইরাসের অমিক্রন ধরনটির উচ্চ সংক্রমণ লকডাউন দিয়ে সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করার আশা করা অবাস্তব। সি চিন পিংকে বুঝতে হবে, তাঁর এই জিরো কোভিড নীতি যত দীর্ঘায়িত হবে, তরুণদের বিক্ষোভ তত ঘনীভূত হবে।

আগে চীনের রাজনৈতিক খেলার মডেল ছিল, ‘যে জিতবে সে-ই সব পাবে’। সেখান থেকে সরকারকে ‘ক্ষমতার ভারসাম্য’ মডেলে রূপান্তরিত করা হয়। এর ফলে পলিটব্যুরোর স্থায়ী কমিটির সদস্যদের প্রায় সমান রাজনৈতিক কর্তৃত্ব ন্যস্ত করা হয়েছিল, যাতে আরও ক্ষমতা ভাগাভাগি এবং উচ্চস্তরের জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়।

কিন্তু সি চিন পিং ২০১২ সালে হু জিন তাওয়ের স্থলাভিষিক্ত হওয়ার পর একজন ‘গেম চেঞ্জার’ হয়ে ওঠেন এবং একটি ‘পুনঃকেন্দ্রীকরণ’ প্রক্রিয়া শুরু করেন, যা দলের মূল নেতা হিসেবে তঁার ক্ষমতাকে সুসংহত করে। আয়ের বৈষম্য এবং দুর্নীতির কারণে ক্ষুব্ধ ও অসন্তুষ্ট সমাজের মুখোমুখি হয়ে তিনি গণতন্ত্র এবং বাক্‌স্বাধীনতার মতো ধারণাগুলোর আলোচনাকে সীমাবদ্ধ করেন। সি চিন পিংয়ের নেতৃত্বাধীন সরকার সংবাদমাধ্যমের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে এবং সরকারের বিধিনিষেধের কারণে জননীতি বা মানবাধিকারের বিষয়ে ভিন্ন মতামত প্রকাশের বিষয়ে সুশীল সমাজ আগের চেয়ে বেশি সতর্ক হয়ে পড়ে। 

করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে চীনের প্রাথমিক সাফল্য দেশে-বিদেশে প্রশংসা কুড়ালেও ক্রমবর্ধমানভাবে এর কঠোর শূন্য কোভিড নীতির অর্থনৈতিক ও সামাজিক অভিঘাত অসহনীয় হয়ে উঠেছে। জনগণ অর্থনৈতিক চাপের মুখে পড়ে সরকারি বিধিনিষেধ ভাঙতে শুরু করেছে। লকডাউনের অনির্দিষ্টকালীন শৃঙ্খলের বিরুদ্ধে ক্ষোভ দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছে।

ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞায় জনগণের মেজাজ টগবগ করা পর্যায়ে পৌঁছেছে। সাম্প্রতিক বিক্ষোভগুলো দেখে মনে হচ্ছে, জনগণের এই বিচ্ছিন্ন ক্ষোভ ও অসন্তোষ কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। কয়েক দশকের মধ্যে এটিই প্রথম দেশব্যাপী বিক্ষোভ, যাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী এবং সাধারণ চীনা নাগরিকদের একত্র করেছে। জিনজিয়াং প্রদেশের উরুমকি এলাকায় লকডাউনের আওতায় থাকা একটি ভবনে আগুন লেগে জনা দশেক লোক মারা যাওয়ার পর মানুষের মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। এরপর গুইঝো প্রদেশে সম্প্রতি কিছু লোককে বাসে করে কোয়ারেন্টিনে নেওয়ার পথে দুর্ঘটনায় ২৭ জন নিহত হওয়ায় বিক্ষোভ সারা দেশে প্রবলভাবে ছড়িয়ে পড়ে।

এখন সরকারের শূন্য কোভিড নীতি জনগণের কাছে ক্লান্তিকর মনে হচ্ছে। এ কারণে দ্রুত চীনা সরকারের লকডাউনের ধারণা থেকে সরে আসা উচিত। তাদের কাছে পরিষ্কার হওয়া উচিত, করোনাভাইরাসের অমিক্রন ধরনটির উচ্চ সংক্রমণ লকডাউন দিয়ে সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করার আশা করা অবাস্তব। সি চিন পিংকে বুঝতে হবে, তাঁর এই জিরো কোভিড নীতি যত দীর্ঘায়িত হবে, তরুণদের বিক্ষোভ তত ঘনীভূত হবে। এতে উত্তরোত্তর জনসমর্থন হারাবেন তিনি।

  • চেন গ্যাং ইস্ট এশিয়ান ইনস্টিটিউট সিঙ্গাপুর ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সহকারী পরিচালক এবং সিনিয়র রিসার্চ ফেলো

আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত