১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত কোনো প্রধানমন্ত্রীই পাঁচ বছরের মেয়াদ পূরণ করতে পারেনি। পাকিস্তানকে নিত্য অস্থিতিশীলতা ও হঠাৎ করেই রাজনৈতিক আবহাওয়াবদলের সাক্ষী হতে হয়। এই প্রেক্ষাপটে গত সপ্তাহে পাকিস্তানে যে অবিস্মরণীয় নির্বাচন হয়ে গেল, তা দেশটির এই ভাবমূর্তির খুব একটা বদল ঘটাবে না। এই নির্বাচন নিয়ে নির্বাচন বিশ্লেষকদের পূর্বধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। কারাবন্দী সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের সমর্থকেরা সবচেয়ে বেশি আসন জিতেছেন। পাকিস্তান নিয়ে এখন একটিই ধারণা আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে করা যায়, নতুন একটি রাজনৈতিক অস্থিরতার যুগে প্রবেশ করল দেশটি।
৮ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে প্রায় ৬ কোটি ভোটার ভোট দিয়েছেন। নির্বাচনের দিন সন্ত্রাসী হামলার হুমকি ও সামাজিক অস্থিরতার কথা বলে সরকার দেশজুড়ে মোবাইল ও ইন্টারনেট-সেবা ব্লক করে দেয়। এই পদক্ষেপের ফলে সাংবাদিক, ভোটারদের ভোটকেন্দ্রের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করার ক্ষমতা ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়। ভোট গণনার ধীর প্রক্রিয়া নিয়ে পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে ভোটাররা অনিয়মের অভিযোগ তোলেন। সে কারণে রোববার যখন চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষণা শুরু হলো, তখন ইমরান খানের সমর্থকেরা গুরুতর ভোট কারসাজির অভিযোগ এনে দেশজুড়ে বিক্ষোভ শুরু করেন।
এরপরও ইমরান খানের পিটিআই সমর্থক স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ৯৭টি আসন পেয়ে প্রতিষ্ঠিত প্রতিদ্বন্দ্বীদের পেছনে ফেলেন। যদিও সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য যে ১৩৪ আসন প্রয়োজন, তার থেকে অনেক পেছনে পিটিআই। পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট তেহরিক-ই ইনসাফকে (পিটিআই) দলীয় প্রতীক ক্রিকেট ব্যাট ব্যবহার করতে না দেওয়ার সিদ্ধান্ত দেন। এ কারণে এ নির্বাচনে পিটিআই-সমর্থক প্রার্থীরা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেন। পাকিস্তানে সাক্ষরতার হার মাত্র ৪২ শতাংশ, গ্রামে অবস্থা আরও শোচনীয়। এ কারণেই ভোটের আগে প্রতীক খোয়ানো পিটিআইয়ের জন্য বিশাল এক ধাক্কা। সাক্ষরতাহীন জনগোষ্ঠীর বড় অংশটাই প্রতীক দিয়েই তাদের প্রিয় প্রার্থীকে শনাক্ত করে।
নির্বাচনের আগের দিন অনেক বিশ্লেষক বলেছিলেন, পিটিআই বিপদে থাকায় এবার তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের দল পাকিস্তান মুসলিম লিগ-নওয়াজ (পিএমএল-এন) বিজয়ী হতে চলেছে। লন্ডনে স্বেচ্ছানির্বাসনে থাকা নেওয়াজ গত বছর অক্টোবরে দেশে ফেরেন। এর পর থেকে বিশ্লেষকেরা তাঁকে পাকিস্তানের শক্তিশালী সেনাবাহিনীর পছন্দের প্রার্থী হিসেবে বিবেচনা করছিলেন। পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও বিদেশের সঙ্গে দেশটির সম্পর্ক নির্ধারণ করে দেশটির সেনাবাহিনী।
এখন পর্যন্ত পিএমএল-এন ৭৫টি আসন নিশ্চিত করেছে। পাকিস্তানের রাজনীতির আরেক পুরোনো দল পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) ৫৪টি আসনে পেয়েছে। হত্যার শিকার সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোর ছেলে বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি পিপিপিকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। ২০২২ সালের এপ্রিলে অনাস্থা ভোটে ইমরান খান সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর জোট সরকারে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন বিলাওয়াল। পিএমএল-এন ও পিপিপি কয়েক দশক ধরে পাকিস্তানের রাজনীতিতে আধিপত্য করে আসছে। দুটি দলই পাকিস্তানের রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছে। এই পরিবারতন্ত্রের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন ইমরান খান।
ইমরানের সমর্থকেরা নির্বাচনে অপ্রত্যাশিতভাবে সফল হওয়া সত্ত্বেও তাঁদের অত্যন্ত কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে। তত্ত্বগতভাবে স্বতন্ত্ররা সংখ্যাগরিষ্ঠ অথবা জোট সরকার গঠনে একত্র হতে পারেন; কিন্তু পাকিস্তানে এ ধরনের সরকার গঠনের কোনো নজির অতীতে নেই। দেশটির পার্লামেন্ট রাজনৈতিক দলের আধিপত্য বিরাজ করে। এ পরিস্থিতিতে একটা রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার মঞ্চ তৈরি হলো, যেখানে পিএমএল-এন, পিপিপি ও অন্যান্য দল ঠেলাঠেলি করে যা গঠন করতে পারবে, সেটা হলো একটা ঝুলন্ত পার্লামেন্টের ছায়ায় একটা নড়বড়ে জোট সরকার।
পরবর্তী সরকার যারাই গঠন করুক না কেন, পাকিস্তানকে অজস্র সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে। দেশটির ভঙ্গুর অর্থনীতি প্রায় ধসে পড়ার প্রান্তে। গত বছর অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার কর্মসূচির আওতায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের কাছ থেকে ৩০০ কোটি ডলারের ঋণ সহায়তা পেয়েছে পাকিস্তান। নতুন সরকারকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের নতুন কর্মসূচি পাওয়ার জন্য অর্থনৈতিক খাতে সংস্কার কর্মসূচি নিতে হবে। গত ডিসেম্বর মাসে পাকিস্তানে মূল্যস্ফীতি ছিল ৩০ শতাংশ, ২০২৪ সালে সেটা ২০ শতাংশ থাকবে বলে মনে করা হচ্ছে। পাকিস্তানে সাড়ে ৯ কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছেন।
হামিদ হাকিমি আন্তর্জাতিক থিঙ্কট্যাংক চাটাম হাউসের অ্যাসোসিয়েট ফেলো ও আটলান্টিক কাউন্সিলের সিনিয়র ফেলো
দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত