রোহিঙ্গা গণহত্যার নীলনকশা তৈরি হয় ১৯৬৬ সালে
প্রথম আলোর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে ফ্রি বার্মা কোয়ালিশনের প্রতিষ্ঠাতা মং জার্নি
ছয় বছর আগে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা নারী–পুরুষ ও শিশু যখন তাদের জন্মভূমি মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়, তখন বিশ্ববাসী হতবাক হয়ে গিয়েছিল সেই দেশটির শাসকদের নৃশংসতা দেখে। একটি জনগোষ্ঠীকে বিতাড়ন করার জন্য তারা গণহত্যার পাশাপাশি ঘরবাড়ি–দোকানপাট সব পুড়িয়ে দেয়। ব্যাপক হত্যাকাণ্ড ও ধর্ষণ চালায়। রক্ষায় পায়নি নারী, শিশু, বৃদ্ধ কেউই।
প্রতিবেশী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ মানবিক কারণেই তাদের আশ্রয় দিয়েছিল এবং আশা করা গিয়েছিল কিছুদিন পরই তারা মিয়ানমারে ফিরে যেতে পারবে। এর আগ থেকে আরও কয়েক লাখ রোহিঙ্গার অবস্থান বাংলাদেশে।
২০১৭ থেকে ২০২৩ সাল—এই ছয় বছরে একজন রোহিঙ্গাকেও ফেরত পাঠানো যায়নি। ইতিমধ্যে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা পুরো দেশের কর্তৃত্ব তাদের হাতে নিয়েছে, গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী অং সান সু চিকে ক্ষমতাচ্যুত করে। ২০১৫ সালের নির্বাচনে সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও তাঁকে সেনাবাহিনীর সঙ্গে ক্ষমতা ভাগাভাগি করতে হয়েছিল।
কিন্তু ২০২০ সালের নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ এনে সেনাবাহিনী ফের ক্ষমতা দখল করে। যদিও দেশটির বিরাট অংশ কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। সেখানে জান্তা সরকারের সঙ্গে গণপন্থী ও বিদ্রোহীদের এক প্রকার গৃহযুদ্ধ চলছে।
২০১৭ সালের শেষ দিকে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের বিষয়ে মিয়ানমার ও বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে একটি চুক্তি হয়। যেই দেশটি একটি জনগোষ্ঠীকে উচ্ছেদ করতে গণহত্যা চালিয়েছে, সেই দেশটির সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তির যৌক্তিকতা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছিলেন।
এই চুক্তির ভিত্তিতে ২০১৯ সালে দুই দফা প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও নিরাপত্তাহীনতার প্রশ্ন তুলে রোহিঙ্গারা ফিরতে রাজি হননি। ২০২১ সালের জানুয়ারিতে চীনকে সঙ্গে নিয়ে ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে পরীক্ষামূলকভাবে ৭ হাজার ১৭৬জন রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নেওয়ার কথা থাকলেও একজনও ফিরতে পারেননি। বাংলাদেশ আশা করছে, ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে হয়তো পরীক্ষামূলক প্রত্যাবাসন শুরু হবে।
যেখানে ১১ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত হয়ে বাংলাদেশে এসেছেন, সেখানে সাত হাজারের প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ সমুদ্রে গোষ্পদ ছাড়া কিছু নয়।
প্রশ্ন উঠেছে, আন্তর্জাতিক মহল কি মাতৃভূমি থেকে বিতাড়িত ফিলিস্তিনি কিংবা কুর্দিদের মতো রোহিঙ্গাদের দুঃখ–বেদনা ও দীর্ঘশ্বাসের কথা ভুলে যাবে? তারা কি আজীবন উদ্বাস্তু ও দেশহীন মানুষ হিসেবেই থেকে যাবে?
২০১৭ সালের আগেও অনেক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয়। আশি ও নব্বই দশকে বিভিন্ন কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় উল্লেখ্যযোগ্য সংখ্যক রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠানো সম্ভব হলেও ২০১৭ সালের পর একজন রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি।
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকদের মতে, বিশ্বে মোট রোহিঙ্গার সংখ্যা ৩৫ লাখের মতো, যার মধ্যে এককভাবে বাংলাদেশেই সবচেয়ে বেশি— ১১ লাখ। মিয়ানমারে এখন তিন থেকে সাড়ে তিন লাখ রোহিঙ্গা আছে। এ ছাড়া মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ভারত, পাকিস্তান, সৌদি আরবেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রোহিঙ্গা বসবাস করছে।
বিশ্বের শক্তিশালী দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের কোনো কোনো দেশ ছাড়া অন্য কোনো দেশের সমর্থন আমরা পাইনি। আমাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু চীন, রাশিয়া, ভারতসহ অনেক দেশ জাতিসংঘের বিভিন্ন ফোরামে বাংলাদেশের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে, অথবা ভোটদানে বিরত থেকেছে।
দুর্ভাগ্যজনক হলো রোহিঙ্গারা যে দেশটিতে শত শত বছর ধরে বাস করছে, সেই দেশটি তাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকার করছে না। তারা তাদের আদার পিপল বা বেঙ্গলি মুসলিম হিসেবেই চিহ্নিত করে থাকে। অথচ ১৯৬২ সালে মিয়ানমারে সেনাশাসন শুরু হওয়ার আগপর্যন্ত অন্যান্য সম্প্রদায়ের মতো রোহিঙ্গারাও সমান সুযোগ–সুবিধা ভোগ করত। দেশটির কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক পার্লামেন্টেও তাদের প্রতিনিধিত্ব ছিল। রোহিঙ্গারা এখন নিজ দেশে পরবাসী।
প্রথমেই বলতে হয়, বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গা সমস্যার ভয়াবহতা অনুধাবন করতে পারেনি। দ্বিতীয়তা এই সমস্যা সমাধানে যে বহুমাত্রিক ও সর্বাত্মক উদ্যেোগ নেওয়া দরকার ছিল, সেটা নিতেও তারা ব্যর্থ হয়েছে। তৃতীয়ত ভূ–রাজনীতির দ্বন্দ্বে পড়ে রোহিঙ্গা সমস্যাটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনোযোগ হারিয়েছে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে সরকারের নীতি–পরিকল্পনাও অস্পষ্ট। বিষয়টি যথাযথভাবে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তুলে ধরতে না পারা কূটনৈতিক ব্যর্থতাই বটে।
বিশ্বের শক্তিশালী দেশগুলোর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের কোনো কোনো দেশ ছাড়া অন্য কোনো দেশের সমর্থন আমরা পাইনি। আমাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু চীন, রাশিয়া, ভারতসহ অনেক দেশ জাতিসংঘের বিভিন্ন ফোরামে বাংলাদেশের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে, অথবা ভোটদানে বিরত থেকেছে।
আন্তর্জাতিক বিচার আদালতও মিয়ানমারের বিরুদ্ধে উত্থাপিত গণহত্যার দায়ে দেশটির বিরুদ্ধে কঠোর কোনো অবস্থান নিতে ব্যর্থ হয়েছে। তারা সেখানে সংঘটিত গণহত্যা সম্পর্কে দেশটির কাছে কৈফিয়ত ও ব্যাখ্যা চেয়েছে। একই আদালত ইউক্রেনে শিশু হত্যার দায়ে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে। এ কারণে পুতিন দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত ব্রিকস সম্মলনে যোগ দিতে পারেননি।
বর্তমান বিশ্বে রোহিঙ্গারাই বৃহত্তম উন্মূল জনগোষ্ঠী এবং তাদের একটা অংশ বাংলাদেশের ওপর চেপে বসেছে। অথচ তাদের প্রতি বিশ্ব সম্প্রদায়ের নজর কম। এর পেছনে ভূরাজনৈতিক জটিলতা যেমন কাজ করেছে, তেমনি আছে মিয়ানমারের প্রতি দুই বৃহৎ প্রতিবেশীর মাত্রাতিরিক্ত পক্ষপাত। পশ্চিমা বিশ্ব যখন মিয়ানমারের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি করে, তখন চীনই তাকে অর্থনৈতিক ও সামরিক সহায়তা দিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছিল।
যে রাখাইন প্রদেশ থেকে রোহিঙ্গারা উৎখাত হয়েছে, সেই রাখাইনে আছে চীনের বিশাল অর্থনৈতিক কর্মসূচি। সেখানে চীন গভীর সমুদ্রবন্দর করেছে, যাতে তারা সহজেই বঙ্গোপসাগরে যেতে পারে। এই অবস্থায় ভারতও পিছিয়ে থাকেনি। মিয়ানমারে তারাও বিনিয়োগ বাড়িয়েছে।
এই দুই বৃহৎ প্রতিবেশী রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পক্ষে কার্যত কোনো পদক্ষেপ নেয়নি, যদিও কিছু কিছু মানবিক সহায়তা তারা দিয়েছে। যে দেশটি গণহত্যা চালিয়েছে, সেই দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বসে সমস্যার সমাধান খোঁজায় মিয়ানমারের জান্তা সরকারই লাভবান হয়েছে। তারা বিশ্ব সম্প্রদায়কে দেখাতে চাইছে সমস্যা সমাধানে মিয়ানমার আন্তরিক।
রোহিঙ্গা সংকটের ছয় বছরেও সরকারের নীতিনির্ধারকেরা দেশবাসীকে কোনো সুসংবাদ দিতে পারেননি। রোহিঙ্গা শরণার্থীরা আমাদের অর্থনীতির ওপর মারাত্মক চাপ সৃষ্টি করেছে; তাদের জন্য গোটা কক্সবাজার অঞ্চলের পরিবেশ ও প্রতিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে; রোহিঙ্গারা ছড়িয়ে পড়েছে দেশের অন্যান্য স্থানেও।
তবে সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো রোহিঙ্গা শিবিরগুলোকে কেন্দ্র করে মাদক ও অস্ত্রের রমরমা ব্যবসা চলছে। রোহিঙ্গা শরণার্থী ঘিরে আরাকান সালভেশন আর্মি (আরসা) ও রোহিঙ্গা সলিডারিটি অরগানাইজেশনসহ (আরএসও) মিয়ানমারের অন্তত ছয়টি সন্ত্রাসী সংগঠন সশস্ত্র তৎপরতা চালাচ্ছে। বিভিন্ন শিবিরে আশ্রিত রোহিঙ্গারা প্রাণ বাঁচাতে কেউ এ পক্ষে, কেউ ও পক্ষে ভাগ হয়ে আছে। যাঁরা মিয়ানমারে ফেরত যেতে চান, তাঁরাই টার্গেট হন এসব সন্ত্রাসী সংগঠনের। রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ মিয়ানমারে ফেরত যাওয়ার জন্য আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন, আরসার সন্ত্রাসীরা তাঁকেও হত্যা করেছে।
গত ছয় বছরে কয়েক শ রোহিঙ্গা গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে মারা গেছে। ২০১৭ সালে আরসা নামের সংগঠনটি রোহিঙ্গা বিতাড়িত হওয়ার প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিল। কয়েকটি পুলিশ ও সেনাচৌকিতে আরসার হামলার পরই মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে পোড়ামাটি নীতি গ্রহণ করে এবং সর্বাত্মক অভিযান চালায়।
এখন যদি সেই সংগঠনই বাংলাদেশের মাটিতে বসে সন্ত্রাসী তৎপরতা চালাতে থাকে, সেটি যেমন মিয়ানমার সরকারের অভিযানকে ন্যায্যতা দেবে, তেমনি বাংলাদেশের নিরাপত্তাকেও হুমকির মুখে ঠেলে দেবে। রোহিঙ্গাদের মানবিক কারণে আমরা আশ্রয় দিয়েছি, এর অর্থ নয় যে তাদের শিবিরগুলো সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর ‘যুদ্ধক্ষেত্র’ হিসেবে ব্যবহৃত হবে।
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্মসম্পাদক ও কবি
ই–মেইল: sohrab.hassan@gmail.com