রাষ্ট্রের প্রত্যেক নাগরিক তাঁর মৌলিক মানবাধিকার, ন্যায়বিচার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সুশাসন ও ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকারী। অর্থনৈতিক সুশাসন, জাতীয় উন্নয়ন এবং দেশের প্রতিটি নাগরিকের জীবনযাত্রার অগ্রগতি সাধন ও ভবিষ্যৎ সাফল্যের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে জাতীয় বাজেট একটি শক্তিশালী হাতিয়ার।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য জাতীয় সংসদে ৭ লাখ ৫৯ হাজার কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করা হয়েছিল। ১৯৭২-১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের প্রথম বাজেট ছিল ৭৮৬ কোটি টাকা অর্থাৎ ৫১ বছরে জাতীয় বাজেটের আর্থিক আকার বর্তমানে ৯৬৭ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
জিডিপির এই উন্নয়নের সুফল শ্রমজীবী মানুষের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন বা অগ্রগতি ঘটায়নি। জাতীয় বাজেটে শিল্প বাজেট, কৃষি বাজেট, স্বাস্থ্য বাজেট, শিক্ষা বাজেট, প্রতিরক্ষা বাজেট ইত্যাদি বাজেট থাকলেও আলাদাভাবে শ্রমিকদের জন্য কোনো বাজেট বরাদ্দের খাত নেই। ১৯৭২ সালে ভূমিহীন মানুষের সংখ্যা ছিল ৩২ শতাংশ, বর্তমানে ভূমিহীন মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৭৬ শতাংশ (সূত্র: বিভিন্ন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা)।
দেশে বর্তমানে ১৭ কোটি মানুষের মধ্যে ১৪ কোটি মানুষের কোন নিজস্ব আবাসন নেই (সূত্র: বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি)। ব্যাপকভাবে বেড়েছে আয় বৈষম্য, স্বাস্থ্য বৈষম্য, শিক্ষা বৈষম্য, সম্পদ বৈষম্য ও খাদ্য বৈষম্য। অন্যদিকে একই অর্থনীতিতে অতি দ্রুত বেড়েছে ধনী ও অতি ধনীর সংখ্যা।
বাংলাদেশের পোশাকশিল্প গত চার দশক অতিক্রম করে এখন বিশ্ব প্রতিযোগিতায় শীর্ষ স্থানে অবস্থান করার পর্যায়ে। শিল্পের এই অগ্রগতির সঙ্গে আমরা যদি শ্রমিকদের জীবনমান উন্নত পর্যায়ে তুলে আনতে পারি, তাহলে কারও আপত্তি থাকার কথা নয়। আর এতে করে শিল্পেরও অস্থিরতা যেমন কমে আসবে, তেমনি টেকসই উন্নত শিল্প ব্যবস্থাপনাও গড়ে উঠবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, পোশাকশিল্প খাতে দক্ষ শ্রমিক সহজলভ্য হওয়ার পরও বৈদেশিক ব্র্যান্ড ও বায়ারদের অর্ডার বৃদ্ধি না পাওয়া বা অর্ডার কমে যাওয়ার কারণ হচ্ছে, এই শিল্পে শ্রম অসন্তোষ এবং রাজনৈতিক সংকট। শ্রমিকদের মধ্যে শ্রম অসন্তোষের প্রধান কারণ অস্বাভাবিকভাবে দফায় দফায় নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাওয়া।
রপ্তানি খাতে ৮৪ শতাংশ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী এই শিল্পে টেকসই উৎপাদন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে এবং ১০০ বিলিয়ন রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নের বিষয়টি এখন অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
আমরা জানি জাতীয় বাজেট তৈরি করা হয় জাতি ও দেশের স্বার্থে। দেশের জনসংখ্যার মধ্যে মোট শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যা ৬ কোটি ৮২ লাখ ৬ হাজার, যাদের মধ্যে ৮৫ শতাংশ অর্থাৎ ৫ কোটি শ্রমজীবী মানুষ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত।
রেশনিং ব্যবস্থা চালুর জন্য পোশাকশিল্পে শ্রমিকদের জন্য জাতীয় বাজেটের ১ দশমিক ৫ শতাংশ বরাদ্দ হলেই ১০ হাজার কোটি টাকা জোগাড় হয়ে যায়।
আদমজী শ্রমিকের খেলার মাঠ এখন র্যাব–১১–এর হেড কোয়ার্টার। আদমজী স্টাফ কলোনি ও বাগানবাড়ি এখনো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশের আঞ্চলিক কার্যালয় ও ব্যারাক। শ্রমিক এবং তাদের ছেলেমেয়েরা থাকবে কোথায়, চিকিৎসা করাবে কোথায়, লেখাপড়া করবে কোথায়, চিত্তবিনোদনের জন্য খেলাধুলাই–বা করবে কোথায়? ক্রমবর্ধমান এত বিশাল অঙ্কের বাজেটের অগ্রগতি বা দায়দায়িত্বের কোনো নির্দেশনা নেই।
বাজেটে শুধু ১০ শতাংশ বা টাকার অঙ্কে ৭০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হলে প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে সব শ্রমিকদের জন্য রেশনিং ব্যবস্থা চালুর মাধ্যমে খাদ্যনিরাপত্তা প্রদান করা সম্ভব। শ্রমিকদের যত বেশি সুযোগ-সুবিধা ও মৌলিক অধিকারগুলো প্রদান করা হবে—উৎপাদনে শ্রমিক আরও ভালো ভূমিকা রাখতে উৎসাহিত হবে এবং উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রাও তখন বেড়ে যাবে। উল্লেখ্য, পরাধীন পাকিস্তান আমলেও রেশন প্রদান করা হতো। স্বাধীনতার পরও ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত এই রেশনিং ব্যবস্থার প্রচলন ছিল।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে একজন ব্যাচেলর পুলিশ কনস্টেবলের সরকারিভাবে রেশনিং বরাদ্দ আছে ১৬০ টাকায় ৩০ কেজি চাল, ৩০ কেজি আটা, ১০ কেজি ডাল, ৮ লিটার তেল, ৮ কেজি চিনি, ১ কেজি পোলাওয়ের চাল। অনুৎপাদনশীল খাতে ২০ লাখ সরকারি কর্মচারী যদি এই রেশনিং পেতে পারে, তাহলে উৎপাদনশীল খাতে হাড়ভাঙা খাটুনি দিয়ে একজন শ্রমিক অনুরূপ রেশনিং পাওয়ার যৌক্তিক দাবি রাখে।
খাদ্যনিরাপত্তা পাওয়ার অধিকার একটি সভ্য গণতান্ত্রিক দেশে মানুষের একটি অন্যতম মৌলিক অধিকার। এ ছাড়া খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের একটি সাংবিধানিক দায়িত্ব। পোশাকশিল্পের বিশ্ববাজারে প্রতিযোগী দেশ ভিয়েতনাম-কম্বোডিয়া-ভারত-পাকিস্তান–মিয়ানমার এবং গণচীনে শ্রমিকদের জন্য রেশনিং ব্যবস্থা চালু আছে। বিশ্ববাজারে পোশাকশিল্পকে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য এবং টেকসই উৎপাদন ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য রেশনিং ব্যবস্থা চালু করা এখন এই শিল্পের জন্যই বেশি প্রয়োজন।
একটি সাধারণ হিসেবে দেখা যায় ১ জন শ্রমিক যদি মাছ-মাংস, দুধ-ডিম, ছানা, মাখন, ফলমূল না–ও খায়, যদি দিনে শুধু তিন বেলা ভাত খায়, তবে ৫ জনের পরিবারে প্রতিদিন ২ কেজি চাল, মাসে ৬০ কেজি, বছরে ৭২০ কেজি চাল লাগে। চালের দাম ১০ টাকা বৃদ্ধি পেলে তাদের খরচ ৭২০০ টাকা অতিরিক্ত বেড়ে যায়। আর চালের দাম ২০ টাকা বাড়লে ১৪ হাজার ৪০০ টাকা শুধু চালের ওপর বেড়ে যায়।
চাল ছাড়াও ডাল, তেল, লবণ, চিনি, বাসভাড়া, বাসাভাড়া ইত্যাদি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য অনুরূপভাবে বৃদ্ধির কারণে অতিরিক্ত আরও ১৪ হাজার ৪০০ টাকা সব মিলিয়ে মোট ২৮ হাজার ৮০০ টাকা এক বছরে বাড়তি দাম দিয়ে শ্রমিককে বাধ্য হয়ে ক্রয় করতে হয়।
শ্রমিকেরা এখন অতি মুনাফাকারী এই সিন্ডিকেট লুটতন্ত্রের শিকারে পরিণত হয়েছে।
সিন্ডিকেট কালোবাজারি ব্যবসায়ীরা যখন-তখন নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যের দাম বাড়িয়ে বছরে প্রায় ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা শ্রমিকদের পকেট থেকে লুটে নিচ্ছে। বর্তমানে এই চক্রের পুঞ্জীভূত কালোটাকার পরিমাণ ৮৮ লাখ ৬১ হাজার ৪৩৭ কোটি টাকা। এই পরিমাণ অর্থ দিয়ে কমপক্ষে ১৫টি জাতীয় বাজেট করা সম্ভব।
বাস্তবে এই দুর্নীতিপরায়ণ সিন্ডিকেট এবং এর সুবিধাভোগী মোট জনসংখ্যার সর্বোচ্চ ১ শতাংশ। অথচ এদের কারণেই ২০২২ সালে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই)–এর রিপোর্ট অনুযায়ী ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় ১২তম দেশ হিসেবে কলঙ্কিত হয়েছে। এদের কারণেই বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষ ১১৫ বিলিয়ন ডলারের ঋণের বোঝা বহন করে চলেছে।
প্রাথমিক পর্যায়ে পোশাকশ্রমিক পরিবারকে ৩০ কেজি চাল, ২০ কেজি আটা, ৫ কেজি চিনি, ৫ লিটার তেল রেশনিংয়ের মাধ্যমে স্বল্পমূল্যে প্রদান করলে ৩০ লাখ শ্রমিকের জন্য মাসে ৯০০ কোটি, বছরে ১০ হাজর ৮০০ কোটি টাকা ব্যয় হওয়ার কথা। বিজিএমইএ-বিকেএমইএ সূত্রে জানা যায়, রপ্তানিতে উৎসেকর হিসেবে প্রদেয় ১ শতাংশ হারে যার পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকা।
একই সূত্রে জানা যায়, শ্রমিক কল্যাণে সেন্ট্রাল ফান্ড, মুনাফার শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ, কল্যাণ ফান্ড, আয়কর, ভ্যাট, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর সব মিলিয়ে প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা সরকারি রাজস্বে জমা হয়। এ ক্ষেত্রে এই শিল্পকে রেশনিংয়ের মাধ্যমে ১০ হাজার ৮০০ কোটি টাকা প্রদান করা হলে ৩০ লাখ শ্রমিক পরিবারই শুধু উপকৃত হবে না, এর সঙ্গে মুদিদোকান, হোটেল-রেস্তোরাঁ, বিকাশ, রিকশা-ভ্যান, হকার, পরিবহন, ব্যাংক-বিমা বিভিন্নভাবে দেশের প্রায় ৪ কোটি লোক উপকৃত হবে।
উল্লেখ থাকে যে পরাধীন পাকিস্তান আমলেও শিল্প কলকারখানা নির্মাণের আগে মালিক পক্ষ শ্রমিকদের থাকার কলোনি, কোয়ার্টার নির্মাণ করে দিত। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে আদমজী জুট মিলে একসময়ে ২০ হাজার শ্রমিক থাকার মতো ২০টি শ্রমিক কোয়ার্টার, ১২টি শ্রমিক কলোনি, ৫টি খেলার মাঠ, শ্রমিক পরিবারের জন্য একটি হাসপাতাল, ২টি হাইস্কুল, ৩টি প্রাইমারি স্কুল ছিল। ২০০২ সালে আদমজী কারখানা বন্ধ করে রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (ইপিজেড) নির্মাণ করে সেখানে ৬৪টি নতুন কারখানা তৈরি ও ৭০ হাজার শ্রমিক নিয়োগ দেওয়া হলেও বর্তমানে একটিও খেলার মাঠ নেই, নেই কোনো থাকার কোয়ার্টার বা কলোনি।
আদমজী শ্রমিকের খেলার মাঠ এখন র্যাব–১১–এর হেড কোয়ার্টার। আদমজী স্টাফ কলোনি ও বাগানবাড়ি এখনো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পুলিশের আঞ্চলিক কার্যালয় ও ব্যারাক। শ্রমিক এবং তাদের ছেলেমেয়েরা থাকবে কোথায়, চিকিৎসা করাবে কোথায়, লেখাপড়া করবে কোথায়, চিত্তবিনোদনের জন্য খেলাধুলাই–বা করবে কোথায়? ক্রমবর্ধমান এত বিশাল অঙ্কের বাজেটের অগ্রগতি বা দায়দায়িত্বের কোনো নির্দেশনা নেই।
উপরিউক্ত বিভিন্ন প্রকার সংকটের কারণে পোশাকশিল্প আন্তর্জাতিক প্রতিযোগী দেশগুলোর সঙ্গে টিকে থাকতে না পারলে পোশাকশিল্পে নেমে আসবে অনাকাঙ্ক্ষিত বিপর্যয়। ৫০ লাখ শ্রমিক ও অন্যান্য কর্মজীবীরা বেকার হয়ে পড়বে। এমনিতেই প্রতিবছর ৩০ লাখ কর্মক্ষম মানুষ শ্রমবাজারে প্রবেশ করে থাকে, এ ক্ষেত্রে ২০ লাখ মানুষেরই কর্মসংস্থান হয় না। এই পরিস্থিতির মধ্যে বৃহৎ রপ্তানি শিল্প খাতের বিশাল শ্রমজীবী গোষ্ঠীকে রক্ষা করার দায়িত্ব রাষ্ট্র বা সরকার সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণেই অস্বীকার করতে পারে না।
দেশে শুধু মজুরির ওপর নির্ভরশীল শ্রমজীবী মানুষের জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে ন্যায্য মজুরি, রেশনিং, আবাসন এবং স্বাস্থ্য চিকিৎসা নিশ্চয়তা থাকলে কয়েক বছর পরপর শ্রমিকদের মজুরি নিয়ে আন্দোলন–সংগ্রাম বা শিল্পে অস্থিরতার সৃষ্টি হওয়ার কথা না। বাংলাদেশ ইতিমধ্যে নিম্ন আয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে।
সে কারণেই শ্রমিকদের জীবনমান দারিদ্র্যসীমা নিচে অবস্থান করতে পারে না। এ কারণেই দেশের উন্নয়নের শর্ত হোসেনের শ্রমিকদের খাদ্যনিরাপত্তা রেশনিং ব্যবস্থা চালু করা হলে একদিকে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের রাজনৈতিক সরকারের সুনাম এবং একই সঙ্গে শিল্পব্যবস্থাপনার উন্নয়ন ও শ্রমিকদের একটি মৌলিক অধিকার অর্জিত হবে।
প্রিসিলা রাজ, মাহবুবুর রহমান ইসমাইল, শহীদুল ইসলাম সবুজ
লেখকেরা সংগঠক, মানবাধিকারকর্মী ও সাংবাদিক