মতামত

আবারও নির্বাচন, সংখ্যালঘুদের কী হবে

বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ আয়োজিত মতবিনিময় সভায় বাঁ থেকে সামনের সারিতে সারওয়ার আলী, সুলতানা কামাল, রানা দাশগুপ্ত, নিমচন্দ্র ভৌমিক, রামেন্দু মজুমদার, শাহরিয়ার কবির, তানিয়া আমীর, বেনেডিক আলো ডি রোজারিও, শামসুল হুদা, সুব্রত চৌধুরী, মাসুদা রেহানা বেগম ও দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। গতকাল রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে।
ছবি: আশরাফুল আলম

ধর্মীয় কিংবা জাতিগত সংখ্যালঘুদের সমস্যা নিয়ে কথা বলার কথা সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়েরই। কেননা, যেকোনো দেশে সংখ্যালঘুরা যেসব সমস্যা-সংকটের সম্মুখীন, সেগুলো সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়েরই সৃষ্টি। সেটি হয়ে থাকে ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে। সংখ্যাগুরুরা এগিয়ে না এলে সংখ্যালঘুদের পক্ষে এর প্রতিকার অসম্ভব হয়ে পড়ে।

গত ৩১ মে ‘জাতীয় নির্বাচন ২০২৪: ধর্মীয়-জাতিগত সংখ্যালঘু জনগণের অধিকার’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় যোগ দিয়ে মনে হলো, সংখ্যালঘুদের পক্ষে কথা বলার লোক সমাজে কমে যাচ্ছে। আগে নাগরিক সমাজ ও বামপন্থীরা এ ব্যাপারে কিছুটা সোচ্চার ছিল। এখন বামপন্থীরা ক্ষীয়মাণ। ভয়ভীতি দেখিয়ে নাগরিক সমাজের মুখও প্রায় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। অনেকেই প্রশ্ন করেন, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গঠন করতে চায়; কিন্তু তারা কেন সাম্প্রদায়িক নাম নিয়েছে? অথচ তাঁরা এই প্রশ্ন করেন না যে কেন এই সংগঠনের উদ্ভব হলো? স্বৈরশাসক এরশাদ সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম প্রবর্তনের আগে এই নামে কোনো সংগঠন ছিল না। যে মুহূর্তে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করা হলো, তখন নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থেই সংগঠনটি তৈরি হলো। 

আমরা ১৯৭২ সালের সংবিধান নিয়ে এত গর্ব করি, সেই সংবিধানেও বাঙালি ছাড়া অন্য কোনো জাতিগোষ্ঠীর স্বীকৃতি নেই। আওয়ামী লীগ সরকার পঞ্চদশ সংশোধনীতে রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতি তথা জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা পুনর্বহাল করলেও রাষ্ট্রধর্ম বাতিল করেনি। একই সংবিধানে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ ও ‘রাষ্ট্রধর্ম’ সোনার পাথরবাটিই বটে। একদা হিন্দু রাষ্ট্র নেপাল ধর্মনিরপেক্ষ নীতি গ্রহণ করেছে, আর বাংলাদেশ ও ভারত ধর্মকে রাষ্ট্রের বর্ম ও ভোটের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে।

মতবিনিময় সভায় ঐক্য পরিষদের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে সরকারের কাছে তারা পাঁচ দফা দাবি পেশ করেছিল। এর মধ্যে ছিল সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয় ও জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন গঠন, সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন, অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইনের যথাযথ বাস্তবায়ন, সমতলের আদিবাসীদের জন্য ভূমি কমিশন গঠন, বর্ণবৈষম্য বিলোপ আইন প্রণয়ন এবং পার্বত্য ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইনের বাস্তবায়ন। আওয়ামী লীগ নির্বাচনী ইশতেহারে সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয় নিয়ে কোনো কথা না বললেও জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন গঠন, সংখ্যালঘু ও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর প্রতি বৈষম্যমূলক সব ধরনের আইন ও ব্যবস্থার অবসান করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। সাড়ে চার বছর পর একটিও বাস্তবায়িত হয়নি। 

২০০১ সালের নির্বাচনের পর সংখ্যালঘুদের ওপর ভয়াবহ নির্যাতন নেমে এসেছিল। বিএনপি তার বিচার করেনি। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরও  দু–একটি ব্যতিক্রম ছাড়া কোনো ঘটনার বিচার হয়নি। বিচার হয়নি এই সরকারের শাসনামলে সংঘটিত রামু, গোবিন্দগঞ্জ, সাঁথিয়ায় সংঘটিত সাম্প্রদায়িক হামলারও। ২০২১ সালে দুর্গোৎসবের সময় কুমিল্লার একটি পূজামণ্ডপের ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন স্থানে হিন্দুদের বাড়িঘর ও মন্দিরে হামলা হয়েছে। কোনোটির বিচার হয়নি।

২০২২ সালের জনশুমারি অনুযায়ী, দেশের মোট জনসংখ্যার ৭ দশমিক ৯৫ শতাংশ হিন্দু। ১৯৫১ সালের জনশুমারিতে হিন্দু ছিল ২২ শতাংশ। ১৯৭৪ ও ২০১১ সালে এটা নেমে আসে যথাক্রমে ১৪ শতাংশ ও ৮ দশমিক ৪ শতাংশে। এই যে বাংলাদেশে ধারাবাহিকভাবে হিন্দু জনসংখ্যা কমে যাচ্ছে, তার কারণ কী? প্রধানত নিরাপত্তাহীনতা। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অঙ্গীকার ছিল ধর্ম–বর্ণ–জাতিনির্বিশেষে প্রত্যেক নাগরিকের জানমালের নিরাপত্তা দেওয়া। সেটি রাষ্ট্র দিতে পারেনি, সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় থেকেও সহযোগিতার হাত বাড়ানো হয়নি বলে অনেক সংখ্যালঘু দেশ ছাড়ছেন। কেউ বাধ্য না হলে জন্মভূমি ত্যাগ করেন না।

অনেকে বলেন, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির আমলের চেয়ে আওয়ামী লীগ আমলে সংখ্যালঘুরা ভালো আছেন। কিন্তু কতটা ভালো আছেন? এ কথা ঠিক যে আওয়ামী লীগ আমলে সরকারি চাকরিতে সংখ্যালঘুদের সংখ্যা তুলনামূলক বেড়েছে। কিন্তু গ্রাম–গঞ্জে সংখ্যালঘুদের জমি, বাড়ি, সম্পত্তি দখল কি বন্ধ হয়েছে?

২০০১ সালের নির্বাচনের পর সংখ্যালঘুদের ওপর ভয়াবহ নির্যাতন নেমে এসেছিল। বিএনপি তার বিচার করেনি। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরও  দু–একটি ব্যতিক্রম ছাড়া কোনো ঘটনার বিচার হয়নি। বিচার হয়নি এই সরকারের শাসনামলে সংঘটিত রামু, গোবিন্দগঞ্জ, সাঁথিয়ায় সংঘটিত সাম্প্রদায়িক হামলারও। ২০২১ সালে দুর্গোৎসবের সময় কুমিল্লার একটি পূজামণ্ডপের ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন স্থানে হিন্দুদের বাড়িঘর ও মন্দিরে হামলা হয়েছে। কোনোটির বিচার হয়নি। বরং ফেসবুকে কথিত বার্তা ছড়ানোর অভিযোগে কিছু নিরক্ষর সংখ্যালঘু যুবককে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কতজন কোন আমলে চাকরি পেয়েছেন, কতজন সচিব হয়েছেন, তা দিয়ে সংখ্যালঘুদের সার্বিক নিরাপত্তা যাচাই করা যায় না। গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও ন্যায়বিচারই পারে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে। বাস্তবে আমরা সেই অবস্থা থেকে অনেক দূরে আছি। শিক্ষাবিদ আনিসুজ্জামান আক্ষেপ করে একটি কথা বলতেন, পাকিস্তান আমলে রাষ্ট্রটি সাম্প্রদায়িক ছিল। আর সমাজটি ছিল অসাম্প্রদায়িক। এখন রাষ্ট্রটি অসাম্প্রদায়িক হলেও সমাজটি সাম্প্রদায়িক হয়ে গেছে।

সেদিনের সেমিনারের বক্তারা দুঃখ করে বলেন, না, কেবল সমাজ নয়; রাষ্ট্রটিও সাম্প্রদায়িক হয়ে গেছে। গত ১৪ বছর মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও রাষ্ট্রের সাম্প্রদায়িক চরিত্র এতটুকু টাল খায়নি। পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির ২৫ বছর পরও সেখানকার জাতিগোষ্ঠীর মানুষ নিজ দেশে পরবাসী। আর সমতলের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষেরা জমি–বাড়ি হারিয়ে ক্রমেই নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছেন। ভোটের হিসাব–নিকাশে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুরা ক্রমেই ‘অচ্ছুত’ হয়ে পড়ছেন। 

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

sohrabhassan55@gmail.com