মতামত

ইসরায়েলি চিকিৎসকেরা কেন গাজার হাসপাতালে বোমা হামলার উসকানি দেয়?

গাজার আল–আহলি আরব হাসপাতালে হামলার পর সেখানে চিকিৎসারত ভয়ার্ত তিন শিশু
ছবি : এএফপি

‘পশ্চিমাদের নৈতিক মূল্যবোধের সুযোগে সন্ত্রাসীরা হাসপাতালের নিচে তাদের ঘাঁটি গেড়েছে। আর গাজাবাসী সেটা চেয়ে চেয়ে দেখেছে। তারা নিজেরাই নিজেদের ওপর ধ্বংস ডেকে এনেছে। যেকোনো উপায়ে সব জায়গা থেকে সন্ত্রাসবাদের মূলোৎপাটন করতে হবে। হাসপাতালের ভেতরে থাকা সন্ত্রাসীদের সদর দপ্তর গুঁড়িয়ে দেওয়া শুধু সঠিকই নয়, এটা আইডিএফের দায়িত্বও।’  

প্রথমে মনে হতে পারে হাসপাতালকে বোমা মেরে উড়িয়ে দিতে কোনো চরমপন্থী বা উগ্রবাদী হয়তো এই বিবৃতি দিয়েছেন। কিন্তু জেনে আশ্চর্য হবেন, এই বিবৃতিতে ইসরায়েলি চিকিৎসকেরা স্বাক্ষর করেছেন। বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই চিঠি ছড়িয়ে পড়েছে।  

এই বিবৃতি দেখে তাৎক্ষণিকভাবে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানানোর কথা। কিন্তু দেখা গেল এই চিঠি নিয়ে ইসরায়েলের চিকিৎসক সম্প্রদায়ের মধ্যে ‘যৌক্তিক’ বিতর্ক চলছে। বিতর্কের বিষয় হলো ফিলিস্তিনি হাসপাতালগুলোয় বোমা মারা উচিত নাকি অনুচিত।

ইসরায়েলি স্বাস্থ্যব্যবস্থায় আমরা যে ছয়জন ফিলিস্তিনি চিকিৎসক কাজ করছি, তাঁরা অসুস্থ বোধ করছি। ভেবে কূল পাই না, কী করে আমাদেরই সহকর্মী, যাঁদের সঙ্গে আমরা কাজ করি, তাঁরা বলছেন গাজার হাসপাতালে বোমাবর্ষণ করা হোক।

দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, আমরা খুব একটা বিস্মিত হইনি। আমরা ইসরায়েলি স্বাস্থ্যব্যবস্থার অংশ। এখানে প্রশিক্ষণ পেয়েছি, এখানেই চাকরি করছি। আমরা এই ব্যবস্থার ভেতরে থাকা বৈষম্য, সামরিকায়ন এবং কপটতার সঙ্গে খুব ভালোভাবে পরিচিত। বাইরে থেকে যারা দেখে, তারা মনে করে এখানকার হাসপাতালে আরব ও ইহুদিরা পারস্পরিক সম্প্রীতি ও শ্রদ্ধা বজায় রেখে একসঙ্গে কাজ করে।

এই চিঠির মাধ্যমে আমরা ফিলিস্তিনি ও গাজায় কর্মরত আমাদের সহকর্মীদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। একই সঙ্গে পৃথিবীকে জানাতে চাই আমাদের গভীর অক্ষমতা ও অসহায়ত্বের কথা। আমি ও এই বিশ্ব আপনাদের পরাজিত করেছে। আমরা শুধু এ টুকুই আশা করতে পারি, যে শান্তির সময়ে হয়তো আমরা বলতে পারব কোন পরিস্থিতি এই গণহত্যাকে ইন্ধন দিয়েছে। একই সঙ্গে যাঁরা বেঁচে থাকবেন, তাঁদের বেদনা লাঘবে অংশ নেব।

আমাদের ইসরায়েলি সহকর্মীরা গণহত্যার মধ্যে যে বিবৃতি দিয়েছেন, তা ইসরায়েলি স্বাস্থ্যব্যবস্থাটা কেমন তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। এই ব্যবস্থা এমন, যেখানে কিছু চিকিৎসক নির্লজ্জভাবে প্রকাশ্যে সেনাবাহিনীর পরামর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়।

তারা তাদের অবস্থান ও পেশাকে দুই পক্ষের বেসামরিক মানুষের জীবন বাঁচাতে কিংবা শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধানের জন্য ব্যবহার করে না। তারা স্বাস্থ্য অবকাঠামোয় হামলাকে ন্যায্যতা দেয় জেনে-শুনে-বুঝে। তারা জানে এই হামলায় তাদের মতোই চিকিৎসক ও রোগীরা প্রাণ হারাবে।  

সিনেটর জোসেফ ম্যাককার্থেই যেভাবে কমিউনিস্টদের খুঁজে খুঁজে বের করে নিশ্চিহ্ন করার নীতি নিয়েছিলেন, এরাও তাঁর পথ অনুসরণ করছে। ফিলিস্তিনি চিকিৎসকদের খুঁজে খুঁজে বের করছে। ফলে আমরা চলমান যুদ্ধ নিয়ে কোনো বুদ্ধিবৃত্তিক বা নৈতিক আলোচনায় যুক্ত হতে পারছি না। তারা প্রত্যাশা করে আমরাও যেন হামাসের হামলাকে নিন্দা জানাই এবং ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী দেশপ্রেমের ঝান্ডা উড়িয়ে যা করে যাচ্ছে তার স্তুতি গাই। নিরপরাধ ফিলিস্তিনি বেসামরিক মানুষের হত্যা ও ফিলিস্তিনি অধ্যুষিত এলাকায় আরও জোরালো অবরোধের দাবির সঙ্গে গলা মেলাই।  

প্রতিদিন গাড়ি চালিয়ে হাসপাতালে যাওয়ার পথে আমরা গাজা ও পশ্চিম তীরে ধ্বংস ও হত্যার খবর শুনি। যে মুহূর্তে হাসপাতালে পা দিই, সেই মুহূর্তে মুখ মাস্কে ঢেকে ফেলি। এমন ভাব করি যে সবকিছু ঠিকঠাক চলছে। তারপর সহকর্মীদের অনুসন্ধিৎসু চোখের সামনে প্রাত্যহিক বিশ্বস্ততার পরীক্ষা দিই। কফি বিরতিতে আমাদের সহকর্মীরা খুব স্বাভাবিক গলায় গাজাকে ধুলায় মিশিয়ে দেওয়ার গল্প করেন। আলোচনা করেন গাজার মানুষকে বাস্তুচ্যুত করতে পারলে কত সুবিধা হয় এসব নিয়ে।

আমরা দেখি যৌক্তিক কোনো কারণ ছাড়া আমাদের ফিলিস্তিনি সহকর্মীদের কীভাবে জেরা করা হচ্ছে, কীভাবে তাদের চাকরিচ্যুত করা হচ্ছে এবং লজ্জা দেওয়া হচ্ছে। হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো যে ক্রমেই ‘সংশোধন’ কেন্দ্রে পরিণত হচ্ছে তা বেশ টের পাচ্ছি আমরা। অন্য যেকোনো জায়গা হলে, আমাদের এখন রাস্তায় নেমে যুদ্ধ আর গণহত্যার বিরুদ্ধে স্লোগান দেওয়ার কথা ছিল। আমাদের পেশা ও অবস্থানকে কাজে লাগিয়ে হাসপাতাল ভবন, এর কর্মী ও বেসামরিক মানুষের জানমাল ধ্বংসের বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ হওয়ার কথা ছিল।

আমরা জানি কোনো পক্ষ বেছে নেওয়ার চেয়েও এই পরিস্থিতি অনেক জটিল। আমরা জানি যেকোনো মৃত্যুই দুঃখজনক, হোক তা একজন ইসরায়েলির অথবা ফিলিস্তিনির। আর সে কারণেই সঠিকভাবে বলতে গেলে, আমরা জানি যে এই ইতিহাসের শুরু ৭ অক্টোবর নয়। বরং আমাদের মানুষগুলো বহু দশক ধরে বাস্তুচ্যুত হয়েছে, অপমানিত হয়েছে। আর এসব কিছুতে ইসরায়েলি চিকিৎসকদের সায় ছিল।  

 আমাদের মানুষগুলো ইসরায়েলি বসতি স্থাপনকারীদের হাতে খুন হয়ে যাচ্ছে, নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, পঙ্গু হয়ে যাচ্ছে। এসব কিছু জেনেও আমরা রোজ কাজে আসি। তা-ও আমরা আমাদের ইসরায়েলি সহকর্মীদের জিজ্ঞেস করতে পারি না, ‘আপনারা কি এই হামলার নিন্দা করেন?’

আমরা একটা জবরদস্তিমূলক পরিবেশে থাকতে বাধ্য হচ্ছি। এখানে ফিলিস্তিনিদের মৃত্যু খুবই স্বাভাবিক বিষয়, এমনকি এই মৃত্যু উদ্‌যাপনের বিষয়। কিন্তু কোনো ইহুদির মৃত্যুকে এখানে দুঃখজনক বলে ধরা হয়। ইহুদিদের মৃত্যু এখানে অগ্রহণযোগ্য এবং প্রতিশোধের যোগ্য।

এটাই এখানে বাস্তবতা। ইসরায়েলের জাতীয় নিরাপত্তা এখানে অত্যন্ত মূল্যবান, আর ফিলিস্তিনের জাতীয় নিরাপত্তা ঠাট্টার বিষয়। জীবন ও মৃত্যুর মধ্যেও ইহুদিদের শ্রেষ্ঠত্ব দেখানো এখানে একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। বিশেষ করে এমন পরিস্থিতিতে যেখানে আমাদের ইসরায়েলি সহকর্মী, পশ্চিমা বিশ্ব এবং সেখানকার চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলোর আসল চেহারা বেরিয়ে আসছে।  

ফিলিস্তিনিদের অমানুষ হিসেবে চিত্রায়ণ করে গাজায় গণহত্যা চালানোয় পুরো বিশ্বের যুক্ততা আছে।

যুদ্ধ এবং স্বাস্থ্যব্যবস্থায় যুদ্ধের ভয়াবহ প্রভাবের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার ক্ষেত্রে চিকিৎসা পেশার একটি দীর্ঘ ও সমৃদ্ধ ইতিহাস আছে। চিকিৎসা পেশা বর্ণ, উপনিবেশ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। কারণ এ বস্তুগুলোই জাতিতে জাতিতে যুদ্ধ বাধায়।  

গাজার সবচেয়ে বড় আল–শিফা হাসপাতালে হামলা শুরু করেছে ইসরায়েল

ভিয়েতনাম, ইরাক ও আফগানিস্তানে যুদ্ধের বিরুদ্ধে চিকিৎসকেরা কী ভূমিকা নিয়েছিল, তা আমরা এখনো ভুলিনি। আমরা দেখেছিলাম কীভাবে মার্কিন চিকিৎসকেরা ৯/১১-এর পর ইরাক ও আফগানিস্তান দখলের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। কারণ তারা জানত যুদ্ধ কখনো নিরাপত্তা নিশ্চিত করে না, বরং আরও মৃত্যু ডেকে আনে।

কিন্তু ইসরায়েলে আমাদের ইহুদি সহকর্মীদের বড় অংশ বেসামরিক জনগণকে সুরক্ষা দেওয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নিল। ইসরায়েলের পুরো স্বাস্থ্যব্যবস্থা যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে। তারা শুধু যে যুদ্ধের পক্ষে তা-ই নয়; তারা ইসরায়েলের যুদ্ধ, দখলদারি এবং অ্যাপারথেইডের বিপক্ষে ফিলিস্তিনি চিকিৎসকদের কথা বলতে দেয় না। কোনো কর্মসূচিও পালন করতে দেয় না।  

এই দুঃখজনক, শোচনীয় পরিস্থিতিতে আমরা বেঁচে আছি, কাজ করছি। আমরা আমাদের পেশাগত দায়িত্ব ও শপথের প্রতি অবিচল থেকে নাম লুকিয়ে বেনামে চিঠি লিখি। আমরা আমাদের মনোবল হারিয়ে, মানুষ হিসেবে আমাদের যে চরিত্র তা হারিয়ে গণহত্যা প্রত্যক্ষ করছি। আমরা দেখছি, কীভাবে ফিলিস্তিনি শিশুরা ইসরায়েলিদের ফেলা ফসফরাস বোমার আঘাতে পুড়ছে, কীভাবে পুরো একটা জনগোষ্ঠী খাবার আর পানির তীব্র সংকটে ভুগছে। একটুও বিচলিত না হয়ে আমরা বলছি সবকিছু  স্বাভাবিক।  
আমাদের শুধু ফিলিস্তিনের নিরপরাধ মানুষকে চিকিৎসা দেওয়া থেকে বিরত রাখা হয়নি, আমরা রাষ্ট্রীয় অপরাধের বিষয়ে চুপ করে থাকতে বাধ্য হচ্ছি। মুখ খুললেই আমাদের চাকরি যায়, আমাদের নিরাপত্তা হুমকিতে পড়ে।

এই চিঠির মাধ্যমে আমরা ফিলিস্তিনি ও গাজায় কর্মরত আমাদের সহকর্মীদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। একই সঙ্গে পৃথিবীকে জানাতে চাই আমাদের গভীর অক্ষমতা ও অসহায়ত্বের কথা। আমি ও এই বিশ্ব আপনাদের পরাজিত করেছে। আমরা শুধু এ টুকুই আশা করতে পারি, যে শান্তির সময়ে হয়তো আমরা বলতে পারব কোন পরিস্থিতি এই গণহত্যাকে ইন্ধন দিয়েছে। একই সঙ্গে যাঁরা বেঁচে থাকবেন, তাঁদের বেদনা লাঘবে অংশ নেব।

(সুয়াদ, লায়লা এবং সামির ছদ্মনাম। এই চিঠিটি লিখেছেন ইসরায়েলে কর্মরত ছয় ফিলিস্তিনি চিকিৎসক। শারীরিক ও পেশাগত নিরাপত্তার স্বার্থে তাঁরা নাম প্রকাশ করেননি।)

আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত