এম হুমায়ুন কবীর। যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত। এ ছাড়া অস্ট্রেলিয়া ও নেপালেও রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লি সফর, ভূরাজনীতির চ্যালেঞ্জ, বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক ও আঞ্চলিক সহযোগিতা নিয়ে।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সোহরাব হাসান ও মনজুরুল ইসলাম
প্রথম আলো: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আসন্ন দিল্লি সফরকে কীভাবে দেখছেন? গতানুগতিক, না এর বিশেষ তাৎপর্য আছে?
হুমায়ুন কবীর: বিশেষ বলব না, তবে তাৎপর্য আছে। ২০১০ সালে যখন প্রধানমন্ত্রী দিল্লি যান, তখন থেকেই বাংলাদেশ ও ভারত সম্পর্কে গতি সঞ্চার হয়। এবার তিনি যে প্রেক্ষাপটে দিল্লি যাচ্ছেন, তা অনেকটা ভিন্ন। কোভিড-১৯ বৈশ্বিক পরিবেশ আমূল বদলে দিয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধে সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে। আমাদের আঞ্চলিক, ভূরাজনৈতিক ও পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ বেড়েছে। অতএব বর্তমানে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে এসব উপেক্ষা করা বা পাশ কাটিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না। তবে একটি সফর থেকে বেশি কিছু পাওয়া যাবে, তা–ও মনে করি না।
প্রধানমন্ত্রীর এবারের সফরে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য, যোগাযোগ, জ্বালানি ও প্রতিরক্ষাক্ষেত্রে সহযোগিতা গুরুত্ব পাবে। অনেকগুলো চুক্তি সইয়ের সম্ভাবনা আছে। এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কতটা লাভবান হবে? একটা অভিযোগ আছে, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারত বেশি সুবিধা নিয়ে থাকে।
হুমায়ুন কবীর: এ অভিযোগ তো আছেই। অন্যদিকে তিস্তার পানিবণ্টনের বিষয়টি দীর্ঘদিন ঝুলে থাকা ও সীমান্তে বিএসএফের হাতে মানুষ মারা যাওয়ার ঘটনায় বাংলাদেশের মানুষ অনেকটাই হতাশ। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কোন্নয়নে সর্বোচ্চ রাজনৈতিক পর্যায়ে হয়তো সদিচ্ছার অভাব নেই। কিন্তু বাস্তবায়নে যথেষ্ট ঘাটতি আছে। আঞ্চলিক বা উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে গত ১০ বছরে বাংলাদেশ যে ভালো উদ্যোগটি নিয়েছে তা হলো সহযোগিতার ক্ষেত্র সম্প্রসারিত করা। নেপাল ও ভুটানকেও আমরা মোংলা বন্দর ব্যবহার করার সুযোগ দিয়েছি। ভারতও বলেছে, বাংলাদেশ চাইলে তাদের বন্দর ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু এর বাইরেও তো সহযোগিতার ক্ষেত্র আছে। আমরা মিয়ানমার, থাইল্যান্ডসহ আশিয়ান পর্যন্ত যোগাযোগ বাড়াতে চাই।
প্রধানমন্ত্রীর সফরে সেপা (কম্প্রিহেন্সিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপ অ্যাগ্রিমেন্ট) চুক্তি হওয়ার সম্ভাবনা আছে। এতে সাফটার মাধ্যমে আমরা ভারতে যে শুল্ক সুবিধা পেতাম, তা কি কমে যাবে?
হুমায়ুন কবীর: মনে হয় না কমে যাবে। ভারত তো ৯৭ শতাংশ পণ্যে ইতিমধ্যে শুল্ক–সুবিধা দিয়েই রেখেছে। সেপা চুক্তি বলে ভারতও বাংলাদেশের কাছে শুল্ক সুবিধা চাইতে পারে। মূল সমস্যা হলো দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের বিরাট বাণিজ্যঘাটতি। এখানে যে পরিমাণ ভারতীয় পণ্য আমদানি হয়, তার তুলনায় ভারতে আমাদের পণ্য যায় খুবই কম। সেপা চুক্তিতে কেবল বাণিজ্যে নয়, বিনিয়োগের ওপরও জোর দেওয়া হয়েছে। আমরা যদি সেখানে পণ্য রপ্তানি বাড়াতে পারি, তাহলে বাংলাদেশ লাভবান হবে। ভারতে যে ১৩০ কোটি মানুষের বাজার, সেখানে খুব কম পরিমাণ পণ্যই বাংলাদেশ থেকে যায়। পাটসহ কয়েকটি পণ্যের ওপর অ্যান্টি–ডাম্পিং বাধা আছে। ভারতের নীতিনির্ধারকদের উচিত হবে এগুলো তুলে দেওয়া। আরেকটি বিষয় হলো সেপা চুক্তিতে কেবল বাণিজ্যের কথা নেই। বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করার কথাও আছে। বাংলাদেশে যদি ভারতের বিনিয়োগ বাড়ে, সেখানে আমাদের রপ্তানিও বাড়বে। বাংলাদেশে এখন কয়েক লাখ ভারতীয় চাকরি করেন। ভারতেও বাংলাদেশি নাগরিকদের জন্য সেই সুযোগ থাকা উচিত। ভারতের অ্যান্টি–ডাম্পিং নীতি ভুল বার্তা দেয়। ২০১৭ সালে প্রধানমন্ত্রীর দিল্লি সফরের সময়ও বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। কিন্তু প্রত্যাহার হয়নি।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার যেকোনো বৈঠক তিস্তার বিষয়টি উত্থাপিত হয়। প্রধানমন্ত্রী এ সফরে এ নিয়ে কোনো অগ্রগতির সম্ভাবনা দেখেন কি?
হুমায়ুন কবীর: না, দেখছি না। ২০১১ সাল থেকে ভারতের সর্বোচ্চ রাজনৈতিক নেতৃত্ব থেকে আমরা আশ্বাস পেয়ে আসছি। কিন্তু তাতেও সমস্যার সমাধান হয়নি। এবারও হয়তো আশ্বাস থাকবে। চেষ্টার কথা বলা হবে। তবে ইতিবাচক দিক হলো ১২ বছর পর যৌথ নদী কমিশনের বৈঠক হওয়া।
এত দিন বৈঠক না হওয়ার কারণ কি আমাদের আগ্রহের অভাব, না ভারতের অসহযোগিতা?
হুমায়ুন কবীর: আমি যত দূর শুনেছি, দুটোই। নিয়মিত জেআরসি বৈঠক হওয়া উচিত। এ বৈঠকে তো কেবল পানিবণ্টন নিয়ে কথা বলবে না। এ অঞ্চলের অভিন্ন নদীগুলোর পানিসম্পদকে আমরা কীভাবে কাজে লাগাতে পারি, কীভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যা মোকাবিলা করতে পারি, সেসব নিয়েও তো তারা আলোচনা করতে পারে। এবার তিস্তার বিষয়ে আলোচনা না হলেও কুশিয়ারা নদীর পানিবণ্টনে একটা সমঝোতায় তারা এসেছে। এটা ভালো দিক।
যৌথ নদীগুলোর পানিসম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহারের জন্য বাংলাদেশ বরাবর এ অঞ্চলের সব দেশের যৌথ উদ্যোগের কথা বলে আসছিল। এরই মধ্যে নেপালে জলাধার নির্মাণ করা ও নেপালে ও ভুটানে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করে ভারতের গ্রিড ব্যবহার করে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহের উদ্যোগও আছে। এ ব্যাপারে কতটা অগ্রগতি আছে?
হুমায়ুন কবীর: জলাধার নির্মাণের বিষয় কোনো অগ্রগতি আছে বলে আমার জানা নেই। তবে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের বিষয়ে ত্রিপক্ষীয় পর্যায়ে একাধিক বৈঠক হয়েছে। ভারত অনেকটা নমনীয়। বাংলাদেশের জ্বালানিনিরাপত্তার জন্য এটা জরুরি। ভারত থেকে বিদ্যুৎ কেনার পাশাপাশি আমরা নেপাল ও ভুটানে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পে বিনিয়োগ করে জ্বালানিনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারি।
বাংলাদেশ ও ভারতে দেড় ও দুই বছর পর নির্বাচন। এ প্রেক্ষাপটে প্রধানমন্ত্রীর দিল্লি সফরকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন। এর রাজনৈতিক তাৎপর্য কী?
হুমায়ুন কবীর: কূটনীতি তো রাজনীতির বাইরে নয়। বরং রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানেরা নিজ নিজ দেশের সর্বোচ্চ কূটনীতিক। বাংলাদেশ ও ভারতে কাছাকাছি সময়ে নির্বাচন হবে। সে ক্ষেত্রে উভয় দেশের সরকার তার জনগণের চাওয়া–পাওয়ার দিকটি নিশ্চয়ই বিবেচনা করবে। এ ধরনের শীর্ষ বৈঠকে রাজনৈতিক বিষয়ে আলোচনা হলেও তার রেকর্ড থাকে না। ফলে তঁারা কী আলোচনা করবেন, আমরা জানব না। যৌথ ইশতেহারে যেসব বিষয় উল্লিখিত হবে, সেটাই জানব।
সম্প্রতি পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক নিয়ে কিছু মন্তব্য করেছেন, যা নিয়ে অনেক সমালোচনা হয়েছে। একজন কূটনৈতিক হিসেবে কীভাবে দেখবেন?
হুমায়ুন কবীর: বিব্রতকর বিষয়। আমরা কেবল একটি স্বাধীন দেশ নই। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে। আমাদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদার জায়গাটি ভিন্ন। আমার দেশের সরকার গঠনে অন্য কোনো দেশের সহযোগিতার প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এ মন্তব্য অসম্মানজনক। যঁারা রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণের সঙ্গে যুক্ত থাকেন, তাঁদের কাছ থেকে এ ধরনের মন্তব্য কাঙ্ক্ষিত নয়।
আমাদের দুই বৃহৎ প্রতিবেশী চীন ও ভারত। আওয়ামী লীগ সরকার শুরুতে দুই দেশের সঙ্গে সম্পর্কের ভারসাম্য রক্ষার নীতি গ্রহণ করেছিল। এখনো কি সেই ভারসাম্য আছে?
হুমায়ুন কবীর: এখনো আছে। তবে ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি দ্রুত বদলাচ্ছে। তাই আমি মনে করি, আগামী দিনে এ ভারসাম্য রক্ষা হবে অনেক বেশি চ্যালেঞ্জের এবং এটি মোকাবিলা করতে আমাদের অভ্যন্তরীণ সামর্থ্য বাড়াতে হবে। জাতীয় ঐক্য সুদৃঢ় করতে হবে। সব রাজনৈতিক দলকে কিছু মৌলিক বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতে হবে।
কিন্তু বাংলাদেশ কি সে অবস্থায় আছে? রাজনৈতিক নেতৃত্ব তো সব ক্ষেত্রেই বিভাজিত?
হুমায়ুন কবীর: ঐকমত্য ও বিভাজন দুটোই আছে। রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বিভাজন ও বৈরিতা আছে। কয়েকবার ক্ষমতার পালাবদল হয়েছে। কিন্তু গত ৪৫ বছরে অর্থনৈতিক নীতির ক্ষেত্রে খুব বেশি পার্থক্য ঘটেনি। এর অর্থ অর্থনীতিতে ঐকমত্য আছে। রাজনীতিতে সেটা করতে পারলে জাতি হিসেবে আমাদের মর্যাদা ও সামর্থ্য বাড়বে।
ঐকমত্যের বড় জায়গা হতে পারত গণতন্ত্র। কিন্তু সেই গণতন্ত্র আছে কি?
হুমায়ুন কবীর: বাংলাদেশের বয়স ৫১ বছর হয়েছে। আমরা যে ধারায় গণতন্ত্র চর্চা করছি, সেটা খুব কাজে দেবে না। এখন নতুন করে ভাবতে হবে। নতুন করে সামাজিক চুক্তি করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে উৎসারিত রাষ্ট্র পরিচালনায় জনগণের অংশগ্রহণ অপরিহার্য। বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক পরিস্থিতিও আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে। ২০২৬ সাল থেকে আমরা উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যাচ্ছি। তখন আন্তর্জাতিক চাপ আরও বাড়বে। বর্তমান রাজনৈতিক সংস্কৃতি দিয়ে টিকে থাকা কঠিন হবে। আমাদের অনেক বেশি প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হতে হবে।
এ নতুন বন্দোবস্ত বলতে কি বোঝাচ্ছেন আপনি?
হুমায়ুন কবীর: ১৯৯১ সাল থেকে আমাদের স্বপ্ন অনেক বড় ছিল। গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন ছিল। যেকোনো কারণে হোক সেটি হয়নি। গণতান্ত্রিক চর্চা তো কেবল নির্বাচন নয়। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে জনগণের রাষ্ট্র করতে হলে। এখনকার রাজনৈতিক সংস্কৃতি দিয়ে আমরা খুব বেশি এগোতে পারব না। একটা বিষয় হলো আমরা বাইরের চাপ না হলে কিছু করি না। এ বৃত্ত থেকেও আমাদের মুক্ত হতে হবে।
প্রধানমন্ত্রীর দিল্লি সফরের আগে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকায় এলেন, অনেকটা তাদের আগ্রহেই?
হুমায়ুন কবীর: আগে থেকে চীন চাপে ছিল। ইউক্রেন যুদ্ধের পর সেই চাপটি আরও বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র চীনকে রাশিয়া থেকে দূরে সরাতে চায়। জাপান, অস্ট্রেলিয়া, ভারতের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতর। সর্বশেষ তাইওয়ান সংকট চীনকে আরও বিপদে ফেলেছে। এ অবস্থায় তারা বন্ধুদেশগুলোর কাছে গিয়ে বলতে চাইছে, তোমরা যে এক চীন নীতির সমর্থক, সে কথাটি জোর দিয়ে বলো। বাংলাদেশের কাছেও চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সেই প্রতিশ্রুতি চেয়েছেন।
তাহলে প্রধানমন্ত্রীর দিল্লি সফরের সঙ্গে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ঢাকা সফরের কোনো সম্পর্ক নেই?
হুমায়ুন কবীর: একেবারেই না। আমার ধারণা, একটি অ্যাজেন্ডাই ছিল এই সফরের উদ্দেশ্য। বাংলাদেশে আসার আগে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী আসিয়ান দেশগুলো সফর করেছেন, ইন্দোনেশিয়া সফর করেছেন।
আপনি আঞ্চলিক সহযোগিতার ওপর জোর দিয়েছেন। কিন্তু সার্ক তো মৃতপ্রায়।
হুমায়ুন কবীর: সার্কের এ অবস্থা অত্যন্ত দুঃখজনক। এই যে শ্রীলঙ্কার দেউলিয়া অবস্থা তৈরি হলো, আমরা দেশ হিসেবে তাদের সাধ্যমতো সহায়তা করেছি। ভারতও করেছে। কিন্তু আঞ্চলিক কোনো সংস্থা না থাকায় সমষ্টিগতভাবে উদ্যোগ নেওয়া সম্ভব হয়নি। কোভিডের সময়েও আমরা দেখেছি, অনেকেই সার্কের পুনর্জীবনের কথা বলেছেন। এখন আমরা গভীর সংকটে আছি। কোনো দেশের পক্ষে এককভাবে মোকাবিলা করা যাবে না। প্রতিবেশীদের সহায়তা দরকার। এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন করতে চাইলে সার্ককে পুনরুজ্জীবিত করার বিকল্প নেই। আসিয়ানকে সবাইকে সম্মান করে তারা ঐক্যবদ্ধ বলে। সার্ককে শক্তিশালী করতে পারলে বহির্বিশ্ব আমাদেরও সমীহ করবে। আর জলবায়ু পরিবর্তনের যে সমস্যা, সেটি কোনো দেশ সমাধান করতে পারবে না। অতএব পুরো পরিস্থিতি পুনর্মূল্যায়নের সময় এসেছে। সার্ক যেহেতু আমাদের চিন্তার ফসল, আমরা একে পরিত্যাগ করতে পারি না।
প্রধানমন্ত্রীর দিল্লি সফরে কি রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে আলোচনা হবে?
হুমায়ুন কবীর: রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে আলোচনা হবে। এর আগেও হয়েছে। কিন্তু ভারতের সাম্প্রতিক প্রতিক্রিয়া, মিয়ানমারের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ইত্যাদি বিবেচনায় নিলে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু আশা করা যায় না। মনে রাখতে হবে, রোহিঙ্গা সমস্যাটি কেবল বাংলাদেশের সমস্যা নয়। এটা আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক সমস্যা। এ সমস্যার কারণে আঞ্চলিক, বিশেষ করে মিয়ানমার, থাইল্যান্ড ও বাংলাদেশের মধ্যে যে সড়ক যোগাযোগ তৈরি হওয়ার কথা ছিল, তা–ও থমকে আছে। বিমসটেকও প্রায় অকার্যকর। রোহিঙ্গা সমস্যায় ভারতও ঝুঁকিতে আছে। আমরা মনে করি, তারা আরেকটু সক্রিয় হতে পারে।
ভারতকে ট্রানজিট সুবিধা দেওয়া নিয়ে অনেক সমালোচনা হয়েছে। এ থেকে বাংলাদেশ কতটা লাভবান হবে?
হুমায়ুন কবীর: পরীক্ষামূলকভাবে এটি চলছে এখন। বাংলাদেশে ট্রানজিট নিয়ে যেমন সমালোচনা আছে, তেমনি পুরোপুরি চালু না হওয়ায় ভারতও খুশি নয়। আবার পরিবহন ভাড়া ও শুল্ক নিয়েও মতভেদ আছে। ট্রানজিটের বিষয়টি সম্পূর্ণ বাণিজ্যিক। ব্যবসায়ীরা লাভবান হলেই ট্রানজিটে আগ্রহী হবেন। আর আমরা সব সময় বহুমুখী ট্রানজিট সুবিধার কথা বলে আসছি। মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডের সঙ্গে সরাসরি সড়ক যোগযোগ করতে বাংলাদেশ ২০১৬ সালে ভারতের কাছে ট্রানজিটের প্রস্তাব দিয়ে রেখেছে। এ নিয়ে আলোচনাও হয়েছে। এরপরই দেখা গেল রোহিঙ্গা সংকট।
একটা ধারণা আছে যে বাংলাদেশ বা দক্ষিণ এশীয় বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র অনেকটা ভারতের ওপর নির্ভরশীল ছিল। এ অবস্থার কি কোনো পরিবর্তন হয়েছে?
হুমায়ুন কবীর: যুক্তরাষ্ট্র এখন সরাসরি কথা বলতে চায়। যুক্তরাষ্ট্র যে বাংলাদেশের সঙ্গে নানা বিষয়ে কৌশলগত সম্পর্ক গড়ে তুলছে, এটা তারই প্রমাণ। কিন্তু ভারতের গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী বিষয়টিতে দিল্লির অস্বস্তি আছে।
যুক্তরাষ্ট্র যে র্যাবের সাতজন সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে, এর প্রভাব কতটা পড়তে পারে আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে?
হুমায়ুন কবীর: এটি হঠাৎ করে হয়নি। আমরা স্বীকার করি আর না করি, বৈশ্বিক রাজনীতির গতিপ্রকৃতিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব ও ভূমিকা রয়েছে। তারা অনেক কিছু নির্ধারণ করে দেয়। ২০০১ সালে তারা জঙ্গিবাদের বিষয়টি সামনে নিয়ে আসে। জঙ্গিবাদ দমন করতে তারা আফগানিস্তান, ইরাক ও লিবিয়ায় সেনা অভিযান পর্যন্ত চালিয়েছে। এখন আর তাদের অগ্রাধিকারে জঙ্গিবাদ নেই। বাইডেন প্রশাসন আসার পর তারা গণতন্ত্র, মানবাধিকার, সুশাসন ও দুর্নীতি দমনের বিষয়টি সামনে এনেছে। ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে তারা গণতান্ত্রিক বিশ্ব ও অগণতান্ত্রিক বিশ্ব—এ দুই ভাগে গ্রহকে ভাগ করতে চাইছে। আর বাংলাদেশসহ ছয়টি দেশে যে তারা নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে, তার উদ্দেশ্য মানবাধিকার সমুন্নত রাখা। আমরা যদি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সংহত করতে পারি, তাহলে সম্পর্কের হিসাব–নিকাশ এক রকম হবে, আর যদি না পারি, অন্য রকম হবে।
প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।
হুমায়ুন কবীর: আপনাদেরও ধন্যবাদ।