আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে সংঘটিত হত্যাসহ বিভিন্ন অপরাধের বিচার শুরু হয়েছে
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে সংঘটিত হত্যাসহ বিভিন্ন অপরাধের বিচার শুরু হয়েছে

স্বৈরাচার ঠেকাতে সাংবিধানিক আদালত কেন দরকার

১৯৯০ সালের কথা। ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের কাছে একটি বাসায় তিন জোটের লিয়াজোঁ কমিটির বৈঠক চলছে। সেখানে জেনারেল এরশাদের বিদায় সুগম করার বিধি রচনা হচ্ছে। বাইরের ঘরে সাংবাদিকদের ভিড়। কিছুদিন আগেও লিয়াজোঁ কমিটির এমন বৈঠক থেকে বের হয়েই অনেক নেতা এরশাদের মন্ত্রী হওয়ার শপথ নিতে গেছেন। তবে ওই সন্ধ্যায় বাতাসে ছিল এরশাদ পতনের ঘ্রাণ। 

১৯ নভেম্বরের বৈঠকটি থেকে তিন জোট প্রস্তাব দিল জেনারেল এরশাদ পদত্যাগ করবেন উপরাষ্ট্রপতি মওদুদ আহমদের কাছে দায়িত্ব দিয়ে। যিনি তিন জোটের পছন্দসই এক ব্যক্তিকে (প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ) উপরাষ্ট্রপতি নিয়োগ করার পর পদত্যাগ করবেন। বিচারপতি আহমদের ১০ সদস্যের উপদেষ্টা পরিষদ নিরপেক্ষ নির্বাচন দেবে। রাজনৈতিক দলগুলো অবাধ গণতন্ত্রের চর্চা শুরু করে দেবে। জনগণ ভাবল, এরপর সংসদীয় গণতন্ত্রের নহর থেকে ফল্গুধারা বইতে থাকবে। 

কিন্তু মানুষ ভাবে এক, বিধাতা করেন আরেক। নির্বাচনে বিজয়ের মুকুট শেখ হাসিনা পেলেন না। তাই তিনি নতুন ঘোষণা দিলেন। নির্বাচিত সরকারকে একদিনও শান্তিতে থাকতে দেবেন না। এরপর তো গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় দেশের রাজনীতিতে কত কিছু ঘটে গেল। বিএনপি বিচারপতিদের অবসরের বয়স বাড়ায়, যার সঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সম্ভাব্য প্রধান উপদেষ্টা কে হবেন তার সম্পর্ক ছিল। এর বিরোধিতা করে ২০০৬ সালে লগি-বইঠার সহিংস আন্দোলন শুরু করে আওয়ামী জোট। এই পরিস্থিতি ক্ষমতায় নিয়ে আসে ফখরুদ্দীন-মইন সরকারকে। পরে তিনি ক্ষমতায় এসে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করলেন, প্রতিষ্ঠা করলেন স্বৈরাচারী ব্যবস্থা।

ইতিহাস বলে, দেশের প্রধান তিনটি দলই গণতন্ত্রের জন্য লিখিত অঙ্গীকারে স্বাক্ষর করেও তা ভঙ্গ করার ছলাকলায় জড়িত ছিল। তাদের বিরত করার কোনো ক্ষমতাই জনগণের হাতে ছিল না। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিল নিরুপায়। তিন জোটের সরকার পরিবর্তনের রূপরেখায় ভবিষ্যৎ সরকারগুলোর জবাবদিহির কোনো ব্যবস্থা ছিল না। এরশাদ পতনের সাফল্যে উল্লসিত জনগণও সেদিকে নজর দেয়নি। 

বাংলাদেশে আওয়ামী লীগও আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন প্রণয়ন করে ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে ভূতাপেক্ষ অপরাধের বিচার করে। তাই নতুন আদালতে বিচার হলে তাদের আপত্তি করার কথা নয়। 

এখন সংবিধান সংস্কারের নতুন কথা উঠেছে, কমিশন গঠন করা হয়েছে। প্রশ্ন করা যায়, এই সংস্কার কেমন হবে? রাজনৈতিক দলগুলোর প্রস্তাবে গড়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ব্যর্থ হয়েছে। আবার কি ‘কেঁচে গণ্ডূষ’ করতে হবে? 

বাংলাদেশের আইনে সব রকম অঙ্গীকার ভঙ্গের সাজা আছে। নাই কেবল রাজনৈতিক দলগুলোর অঙ্গীকার ভঙ্গ করার কোনো বিচার, কোনো শাস্তি। তেমন ব্যবস্থাও সংবিধানে বা দণ্ডবিধিতে নেই। রাজনীতিকেরা বলেন, জনগণ পরবর্তী নির্বাচনে রাজনৈতিক অঙ্গীকার ভঙ্গের শাস্তি দেওয়ার সুযোগ পায়। নির্বাচনই যদি না হয় বা নৈশ নির্বাচন হয়, তাহলে? এ কারণে ১০-১৫ বছর পরপর আন্দোলনের ঘোরচক্রে দেশের রাজনীতি বাঁধা পড়ে গেছে। 

এ থেকে উদ্ধার পাওয়ার উপায় সাংবিধানিক আদালত গঠন করে বিচারের ব্যবস্থা করা। প্রসঙ্গত, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সাংবিধানিক আদালতের দৃষ্টান্ত দেওয়া যায়। থাইল্যান্ডে সাংবিধানিক আদালত অসাংবিধানিকভাবে রাজনৈতিক অধিকার ও স্বাধীনতা ব্যবহার করার জন্য কোনো ব্যক্তি বা রাজনৈতিক দলের বিচার করতে পারে। ইন্দোনেশিয়ায় ২০০৩ সালে প্রতিষ্ঠিত সাংবিধানিক আদালতের রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করার ক্ষমতা রয়েছে। সে দেশের বিচার ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা সহজ নয়। স্লোভাক প্রজাতন্ত্রের সাংবিধানিক আদালত কোনো রাজনৈতিক দল, দলের আন্দোলন ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করতে পারে। 

জার্মানির মৌলিক আইনে দেওয়া ক্ষমতায় সাংবিধানিক আদালত দেশের ‘স্বাধীন গণতান্ত্রিক ধারা’ ব্যাহত বা অবলুপ্ত করতে চায়—এমন কোনো রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করতে পারে। ১৯৫০-এর দশকে এমন ঘটনা ঘটেছে দুইবার। ১৯৫২ সালে সোশ্যালিস্ট রাইখ পার্টি নামের একটি নব্য নাৎসিবাদী দল ও ১৯৫৬ সালে জার্মানির কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ করা হয়। ২০০৩ সালে নয়া নাৎসিবাদী দল ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি নিষিদ্ধ করার চেষ্টা হয়, কিন্তু কৌশলগত কারণে মামলাটি আর চলেনি।

স্পষ্ট অর্থে সাংবিধানিক আদালত বাংলাদেশে নেই। সুপ্রিম কোর্টের কাছে সংবিধানের ব্যাখ্যা চাওয়ার বিধান আছে। সে মতে, আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন নির্বাচনের ব্যবস্থা তুলে দেওয়ার জন্য সুপ্রিম কোর্টের কাছে ধরনা দেয়। আদালত সরকারের আকাঙ্ক্ষা পূরণের মাধ্যমে দায়িত্ব পালন করে।

বাংলাদেশে একটি সাংবিধানিক আদালত গঠন করা প্রয়োজন। যে আদালত ক্ষমতাসীন থাকা দলকেও স্বৈরাচারে পরিণত হওয়ার পথে বাধা দিতে পারবে। কোনো রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধও করতে পারবে। যার আইনে ক্ষমতাসীনের দায়মুক্তির সুযোগ থাকবে না। উচ্চশিক্ষিত আইনজীবী, শিক্ষাবিদ, সমাজবিদদের নিয়ে একটি কমিশন বা কমিটিকে এ-সংক্রান্ত আইন রচনার দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে। 

বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বাতিল করার আইন আছে। কিন্তু দলের ঘোষণাপত্র বা নির্বাচনী ইশতেহারে দেওয়া অঙ্গীকার ভঙ্গের কারণে তা করা যায় না। দল নিবন্ধন আইনটি সংশোধন ও সাংবিধানিক আদালতের মাধ্যমে কার্যকরভাবে প্রয়োগ করে রাজনৈতিক দলগুলোকে আইন মানতে বাধ্য করা যায়। 

অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে আশঙ্কা হয়, যে দল ক্ষমতা পাবে, তারাই না আবার রাবণ হয়ে যায়। এটাও নিবারণ করা সম্ভব। এ জন্য সাংবিধানিক আদালতের বিচারক নিয়োগ ও আইন সংশোধনে প্রধান বিরোধী দলের সম্মতি নেওয়ার বিধান অবশ্যই থাকতে হবে। সর্বসাম্প্রতিক নির্বাচনে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ভোট যে দল পাবে, তাদেরকেই প্রধান বিরোধী দল বলে গণ্য করতে হবে। 

আশু সমস্যা সমাধানের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের উদ্দেশ্যে স্বৈরাচারী ও তার দলবলের বিরুদ্ধে অবিলম্বে মামলা করা উচিত। প্রয়োজনে পরে এই আদালত মামলাগুলো বিচারের জন্য সাংবিধানিক আদালতে পাঠিয়ে দিতে পারেন। 

স্বৈরাচারপন্থীরা হয়তো হইচই করবে, ইউটিউবে শত শত ভিডিও দেখা যাবে যে কোনো আইনে ভূতাপেক্ষ অপরাধের বিচার করা যায় না। বিশ্বে অবশ্য এমন নজির আছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ভার্সাই চুক্তির ২২৭ নম্বর অনুচ্ছেদ ব্যবহার করে জার্মানির কাইজারের বিচার করা হয়েছিল। ওই অনুচ্ছেদের বলে প্রথমত আইনটির অস্তিত্বের আগেকার অপরাধের জন্য বিচার করা হয়েছিল, দ্বিতীয়ত মিত্রশক্তির ট্রাইব্যুনালে যেসব অপরাধের জন্য বিচার করা হয়, সেগুলো বিশ্বের কোনো আইনের বইয়েই অপরাধ বলে গণ্য ছিল না। কিন্তু বিশ্ববাসী তা মেনে নেয়। 

বাংলাদেশে আওয়ামী লীগও আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন প্রণয়ন করে ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে ভূতাপেক্ষ অপরাধের বিচার করে। তাই নতুন আদালতে বিচার হলে তাদের আপত্তি করার কথা নয়। 

রাজার এবার নিজের আইন পালন করার পালা। 

 ● কাজী জাওয়াদ সাংবাদিক ও অনুবাদক